আন্তর্জাতিক আইন বলতে কী বোঝ? এর প্রকৃতি আলোচনা করো। |
আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা
আন্তর্জাতিক আইনের সর্বসম্মত কোনো সংজ্ঞা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে যেসব সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে সেগুলিকে তিনভাগে ভাগ করে উল্লেখ করা যায়। যেমন-
সনাতন সংজ্ঞা
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যেসব নিয়ম, রীতিনীতি, প্রথা প্রভৃতি সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেগুলিকে বলা হয় আন্তর্জাতিক আইন। আন্তর্জাতিক আইন বিশারদ ওপেনহাইম (Oppenheim) বলেছেন যে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সড়া দেশগুলি পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য প্রথা, রীতিনীতি, নিয়মকানুন মেনে চলে সেগুলিকে বলা হয় আন্তর্জাতিক আইন। একইরকমভাবে লরেন্স (S) Lawrence) বলেছেন যে, যেসব নিয়মনীতির দ্বারা সভা দেশগুলির আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা হয় সেইসব নিয়মনীতিকে বলে আন্তর্জাতিক আইন।
আধুনিক সংজ্ঞা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রীতিনীতিতে বিশাল পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনের ধারায় আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কিত বিষয়টিরও পরিবর্তন ঘটে যায়। স্টার্ক (I G Starke) মনে করেন, আন্তর্জাতিক আইন বলতে এমন সব নিয়ম ও আচরণের নীতিকে বোঝায় যেগুলিকে সমগ্র দেশ নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য মেনে চলতে বাধ্য থাকে। এইসব নিয়মের মধ্যে উল্লেখযোগ হল- প্রথমত, আন্তর্জাতিক সংস্থার বিডির কাজ ও তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখা এবং রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্কিত আইনের অনুশাসন কার্যকর করা। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক ভরে ব্যক্তি এবং বিভিন্ন অরাষ্ট্রীয় সত্তা বিষয়ক বিভিন্ন অধিকার এবং কর্তব্যসমূহ।
মার্কসবাদীদের সংজ্ঞা
Soviet Institute of International Relations-ও আইনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছিল যে, যেসব নিয়মাবলি আন্তর্জাতিক শান্তি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং সমাজতান্ত্রিক-আন্তর্জাতিকতা গড়ে তোলার ব্যাপারে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে সেইসব নিয়মাবলিকে বলা হয় আন্তর্জাতিক আইন।
আন্তর্জাতিক আইনকে আইন বলা যায় কি না/আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতি
আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকৃত অর্থে আইন বলা যায় কি না-এ ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী দুটি মত গড়ে উঠেছে। অনেকে আন্তর্জাতিক আইনকে আইন না বলার সমর্থনে যুক্তি দেখিয়েছেন, আবার অনেকে আন্তর্জাতিক আইনকে ‘আইন’ পদবাচ্য বলে উল্লেখ করেছেন।
সমর্থন না করার যুক্তি
যাঁরা আন্তর্জাতিক আইনকে ‘আইন’ হিসেবে স্বীকৃতি দেননি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-হক্স, জন অস্টিন, সলিসবেরি, হল্যান্ড প্রমুখ। এঁদের যুক্তিগুলি হল-
প্রথমত, আন্তর্জাতিক আইন যেহেতু কোনো সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ নয়, তাই একে আইন বলা যায় না।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আইনকে কার্যকর করে শাসন বিভাগ, কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যেহেতু কোনো শাসন বিভাগ নেই সেহেতু আন্তর্জাতিক আইনকে বলবৎ করাও সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আদালত আইনের বৈধতা বিচার করে থাকে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের বৈধতা বিচার করা সম্ভব নয়।
চতুর্থত, রাষ্ট্রীয় আইন, অমান্যকারীকে শাস্তি ভোগ করতে হয় এবং এই আইন শান্তি বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রযুক্ত হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন অমান্যকারী রাষ্ট্রকে বলপ্রয়োগের দ্বারা শাস্তি দেওয়া যায় না।
পঞ্চমত, কোনো রাষ্ট্রে সেই রাষ্ট্রের আইনসভা আইন প্রণয়নের কাজ করতে পারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নের ব্যাপারে এরূপ কোনো আইনসভা নেই।
ষষ্ঠত, কোনো রাষ্ট্রের আইন স্বাভাবিকভাবেই যেমন সুস্পষ্ট তেমনই তা সুনির্দিষ্ট। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন সুনির্দিষ্ট বা সুস্পষ্ট নয়।
সমর্থন করার যুক্তি
হেনরি মেইন, ওপেনহাইম, লরেন্স, ফেনউইক প্রমুখ আন্তর্জাতিক আইনকে ‘আইন’ বলে মেনে নিয়েছেন। তাঁরা আন্তর্জাতিক আইনকে আইন বলে মেনে নেওয়ার পিছনে যেসব যুক্তি দেখিয়েছেন তা হল-
প্রথমত, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যেমন কিছু সংখ্যক মানুষ, যারা ‘অপরাধী’ শ্রেণিভুক্ত কেবল তারাই আইন মান্য। করে শান্তির ভয়ে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই অবচেতন মনে আইন মেনে নেয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক কারণে রাষ্ট্রগুলিকে আইন মান্য করতে বাধ্য করা হয়। বিভিন্ন রাষ্ট্র আজ এ কথা উপলব্ধি করতে শিখেছে যে ভয়াবহ যুদ্ধ, মতবিরোধ থেকে আন্তর্জাতিক আইন বিশ্বকে নিষ্কৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের জন্যই বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক দৃঢ় হতে পেরেছে।
দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক আইনকে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট করার জন্য পূর্বে বিভিন্ন সময়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেমন- প্যারিস ঘোষণা (1856 খ্রিস্টাব্দে), হেগ সম্মেলন (1899, 1907, 1930 খ্রিস্টাব্দে) এর কার্যপ্রক্রিয়া লক্ষণীয়। আবার সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণসভা (1947 খ্রিস্টাব্দের 21 নভেম্বর) ‘আন্তর্জাতিক আইন কমিশন’ গঠন করে। এর ফলে আহিন গঠনের বিষয়টি সুস্পষ্টতা লাভ করে।
তৃতীয়ত, প্রতিটি রাষ্ট্রেই আইনভঙ্গকারী কিছু অপরাধী থাকে। তাই বলে আইন খর্ব হয় না। আইনের মর্যাদা থাকে যথাযথ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কখনো-কখনো কোনো রাষ্ট্র আইন ভঙ্গ করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের মর্যাদা তাতে ক্ষুগ্ধ হয় না।
চতুর্থত, বিশ্বের সকল রাষ্ট্র যাতে আন্তর্জাতিক আইন মান্য করে সে ব্যাপারে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ তৎপর। নিরাপত্তা পরিষদ আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
পঞ্চমত, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের আন্তর্জাতিক বিচারালয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিরোধ মেটানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে। কোনো রাষ্ট্র যাতে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ না করে অথবা আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করছে কি না সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আদালত সতর্ক দৃষ্টি রাখে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সন্ধি, চুক্তি প্রভৃতির ব্যাখ্যা আন্তর্জাতিক আদালত দিয়ে থাকে।
উপসংহার:
এইসব আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অইিন হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনের স্বীকৃতির পিছনে বিশ্বের শান্তিপ্রিয় সভা রাষ্ট্রগুলির সম্মতি রয়েছে। সেইসব রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক আইনকে মেনে চলেছে। ওপেনহাইম এই কারণে মন্তব্য করেছেন যে, আইনের পরিধির খুব নিকটেই আন্তর্জাতিক আইন অবস্থান করছে। গিলক্রাইস্ট, অনুরূপভাবে মন্তব্য করেছেন যে, আন্তজাতিক আইন হল ‘আধা-আইন’, ‘আধা-নৈতিকতা”।