পুঁইমাচা গল্পের বিষয়বস্তু

পুঁইমাচা গল্পের বিষয়বস্তু
পুঁইমাচা গল্পের বিষয়বস্তু

উদ্ধৃতিঃ “সমাজে থাকতে হলে সেই রকম মেনে চলতে হয়।”

তাৎপর্যঃ উক্ত কথাটি বলেছে সহায়হরির স্ত্রী অন্নপূর্ণা। পল্লিগ্রামের সমাজ নানা সংস্কারে পরিপূর্ণ। আর এই সংস্কারকে কাজে লাগিয়েই গ্রামের মাতব্বররা সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে ওঠেন। সহায়হরির বড়ো মেয়ে ক্ষেন্তি বিবাহযোগ্যা, তার বয়স প্রায় ১৪-১৫ বছর। তার বিয়ের একটি সম্বন্ধ এসে আশীর্বাদ হয়েও ভেঙে গেছে। তাই সমাজের কাছে সে ‘উচ্ছ্বগ্‌গ্ন’। অর্থাৎ, তাকে আর কোনো পুরুষ গ্রহণ করবে না। সহায়হরি তার যদি শীঘ্র বিয়ে দিতে না পারে, তাহলে সমাজ তাকে একঘরে করে দেবে। অর্থাৎ, কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার অধিকার থাকবে না তাদের। একেই দরিদ্র, তার ওপর সমাজের এই চোখরাঙানি অন্নপূর্ণাকে বিব্রত ও আশঙ্কিত করে তুলেছিল। তাই সে স্বামীকে উক্ত কথাগুলো বলে।

উদ্ধৃতিঃ “পিনটার বয়স খুঁজিতে যাইলে প্রাগৈতিহাসিক যুগে গিয়া পড়িতে হয়।”

তাৎপর্যঃ সহায়হরি চাটুজ্যের বড়ো মেয়ে ক্ষেন্তির হাতে সরু সরু কাঁচের চুড়িতে যে সেফটিপিন লাগানো ছিল, সেটির সম্পর্কে উদ্ধৃত কথাটি বলা হয়েছে।

আলোচ্য গল্পে পল্লিগ্রামের দারিদ্র্যজীর্ণ একটি ব্রাহ্মণ পরিবারের আলেখ্য তুলে ধরা হয়েছে। তিন কন্যার মুখে অন্ন তুলে দিতে গিয়ে সহায়হরি ও অন্নপূর্ণার নিদারুণ করুণ অবস্থা। মেয়ের সাজপোশাকের দিকে নজর দেওয়া তো দূরের কথা, শুধু কাচের চুড়িতেই সাজগোজের শখ মিটে যায় ক্ষেন্তির। তবে সেগুলিকে সংলগ্ন রাখার জন্য যে সেফটিপিনটা ব্যবহৃত হয়েছে, তা অনেক দিনের পুরোনো, প্রায় জং ধরা। একদিকে জীবনের সরলতা, অন্যদিকে দারিদ্র্যের কশাঘাত নির্দেশিত হয়েছে এই সেফটিপিনটির মাধ্যমেই।

উদ্ধৃতিঃ “আহা কি অমর্তই তোমাকে তারা দিয়েছে-”

তাৎপর্য: সহায়হরির বড়ো মেয়ে ক্ষেন্তি কারওর ফেলে দেওয়া

হলদে হয়ে যাওয়া পুঁইডাঁটা অনেক আগ্রহের সঙ্গে বয়ে নিয়ে এসেছিল। তবে পল্লির সংসারে যতই দৈন্য বাসা বাঁধুক না কেন, কেউই অনুকম্পার সঙ্গে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় না। ফেলে দেওয়া জিনিসের ওপরেই তাদের অলিখিত অধিকার। ক্ষেন্তি যখন পেকে যাওয়া পুঁইডাঁটাগুলো নিয়ে ঘরে আসে, তখন অন্নপূর্ণা না দিতে পেরেছে অদৃষ্টকে দোষ, না নালিশ জানাতে পেরেছে গ্রামের মাতব্বরদের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে। তাই নিজের মেয়েকেই সে ধমকেছে অন্যায়ভাবে। সে তার মেয়ের চোখ খুলে দিতে চায় যে, ফেলে দেওয়া জিনিসের মধ্যে কোনো অমৃত লুকিয়ে থাকে না এবং কারওর ফেলে দেওয়া জিনিস কুড়িয়ে আনা নেহাতই বোকামি।

উদ্ধৃতি: “…তাহার চোখ দুটো জলে ভরিয়া আসিয়াছে।”

তাৎপর্যঃ ক্ষেন্তিকে যখন তার মা অন্নপূর্ণা তার সংগৃহীত পাকা

পুঁইডাঁটাগুলো ফেলে দিতে বলে তখন ক্ষেন্তির চোখে জল এসে গিয়েছিল। আসলে ক্ষেন্তি পুঁইশাক খুব ভালোবাসত। তাই ওই বস্তুটি পাকা না কচি- -এসব জাতবিচার তার ছিল না। কিন্তু অন্নপূর্ণা তাকে বুঝিয়ে দিতে চায় যে, পল্লিগ্রামে পারিবারিক দারিদ্র্যই উপেক্ষার কারণ হতে পারে না। দরিদ্রের মানমর্যাদা আছে। তাই ফেলে ছিটিয়ে দেওয়া জিনিসের ওপর তাদের অসংগত অধিকার চিরকালীন নয়। তারাও গ্রামের সদস্য, মান্য নাই হতে পারে। কিন্তু এই বাস্তব জ্ঞান ক্ষেন্তির নেই। তাই তাকে আঘাত দিয়ে শেখানো ছাড়া উপায়ও নেই। এই শিক্ষার জন্যই আজ ক্ষেন্তির চোখে জল।

উদ্ধৃতিঃ “কি ভাবিয়া অন্নপূর্ণার চোখে জল আসিল,”

তাৎপর্যঃ অন্নপূর্ণা মা, ক্ষেন্তি-পুঁটি-রাধীর মা। তাই বাইরেটা তার

যতই কঠিন হোক না কেন, অন্তরের দিক থেকে সে অত্যন্ত স্নেহপ্রবণা। পল্লিগ্রামের সমাজে যে বৈষম্য, বঞ্চনা ও লাঞ্ছনা প্রতিনিয়ত দরিদ্রকে দরিদ্রতর করে তুলছে, সেটা বোঝানোর জন্যই সে মাঝে মাঝে রুক্ষ ব্যবহার করে ক্ষেন্তির প্রতি। ক্ষেন্তিকে সে আঘাত দিয়ে বাস্তবকে চেনাতে চায়। কিন্তু, বালিকা কন্যার সামান্য পুঁইশাকের ওপর এতটাই লোভ, তা দেখে মা হয়ে সে নিজেকে সামলাতে পারে না। তাই যে পুঁইডাঁটাগুলো সে রাধীর হাত দিয়ে ফেলিয়ে দিয়েছিল, সেগুলোই আবার নিজের হাতে তুলে আনে, রেঁধে দেয়, আর ক্ষেন্তির সাগ্রহ খাওয়া দেখে স্নেহে ও দুঃখে তার চোখে জল এসে যায়।

উদ্ধৃতিঃ “ইতিহাসটা হইতেছে যে….”

তাৎপর্য: এ ইতিহাস ব্যক্তিগত ইতিহাস, এতে স্বার্থের অঙ্ক

জড়িয়ে। কালীময়বাবু শ্রীমন্ত মজুমদারের কাছে অনেক টাকা ধার করেছিলেন। শোধ দিতে পারছিলেন না। তাই তিনি শ্রীমন্তবাবুর দুশ্চরিত্র ছেলের সঙ্গে সহায়হরির বড়ো মেয়ে ক্ষেন্তির বিয়ে ঠিক করে দিয়েছিলেন, ক্ষতিপূরণ হিসেবে। কিন্তু ছেলের চরিত্রের কথা জানতে পেরে আশীর্বাদের পরেও সহায়হরি বিয়ে ভেঙে দেয়। এতে কালীময়বাবুর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না। এটাই ছিল ইতিহাস।

উদ্ধৃতিঃ “জামার ইতিহাস নিম্নলিখিত রূপ।”

তাৎপর্যঃ হরিপুরের রাসের মেলা থেকে, ক্ষেন্তি যখন ছোটো ছিল, সহায়হরি তার জন্য একটি কালো সার্জের জামা এনে দিয়েছিল নগদ আড়াই টাকা মূল্যে। ক্রমে তার পারিবারিক আবহাওয়া দারিদ্র্যের ঝটিকায় বিপর্যস্ত হয়। এখন ওই রকম নতুন জামা কিনে দেওয়ার কথা সে কল্পনাতেও আনতে পারে না। তবে ক্ষেন্তির খুব প্রিয় সেই জামাটি। তাই জামাটি ছিঁড়ে গেলেও রিফু করে এতদিন চালাচ্ছিল। কিন্তু তার স্বাস্থ্যোন্নতি হওয়ার ফলে জামাটি আর তার গায়ে হয় না। এই জামার ইতিহাসের কথাই এখানে বলা হয়েছে।

উদ্ধৃতিঃ “মুখ যদি মনের দর্পণস্বরূপ হয়,…”

তাৎপর্য : এখানে অন্নপূর্ণার বড়ো মেয়ে ক্ষেন্তির কথা বলা হয়েছে। ক্ষেন্তি খেঁদির মায়ের নিন্দা করে, নিজের মায়ের প্রশংসা করে কিছু নারকেল কোরা পেয়েছিল অন্নপূর্ণার কাছ থেকে। এটা তার অন্যতম প্রিয় খাদ্যবস্তু। যখন, পরম তৃপ্তিভরে সে নারকেল কোরা খাচ্ছিল, তখন তার চোখমুখের দীপ্তিতে পরম প্রশান্তি ও মানসিক তৃপ্তি ফুটে বেরোচ্ছিল। এই প্রসঙ্গেই লেখক উক্ত বর্ণনাটি দিয়েছেন।

উদ্ধৃতিঃ “এরকম পাত্র হঠাৎ মেলাও বড় দুর্ঘট কিনা!”

তাৎপর্যঃ ‘দুর্ঘট’ অর্থাৎ বিষয়টা হল, ক্ষেন্তি সমাজের চোখে উচ্ছ্বগ্‌গু করা মেয়ে। কারণ, বিয়ের আশীর্বাদ হয়েও তার বিয়ে হয়নি। তার ক্ষেত্রে স্বামীর ঘর করা প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু একজন বয়স্ক পাত্র জোটায় অন্নপূর্ণা ও সহায়হরি দুজনেই তার বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। সে পাত্র নাকি বেশ সংগতিপন্ন; শহরাঞ্চলে বাড়ি; সিলেট, চুন ও ইটের ব্যাবসায় নাকি দু-পয়সা করেছে। ক্ষেন্তির এরকম স্বামী জোটা ভাগ্যের সুপ্রসন্নতাই বটে। এই প্রসঙ্গেই এ কথা বলা হয়েছে।

উদ্ধৃতিঃ “তার অনাচারী লোভী মেয়েটি আজ বাড়িতে নাই…”

তাৎপর্যঃ শূন্যতাদীর্ণ মাতৃহৃদয়ের অভিঘাত এখানে স্পষ্ট। বড়ো

মেয়ে ক্ষেন্তি শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ার পর তার জন্য আকুলতা বেড়েছে অন্নপূর্ণার। ছোট্ট ঘরের টুকরো টুকরো অনুষঙ্গের মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে তার অস্তিত্ব। তাই মাচায় রোদে দেওয়া আমসত্ত্ব তুলতে গিয়ে অন্নপূর্ণার হঠাৎ মনে হয়েছে মেয়ের কথা। ক্ষেন্তি আমসত্ত্ব খেতে খুব ভালোবাসত। আমসত্ত্বের একটা কোণ একটু ছিঁড়ে দিতে হত তার মিনতির সুরে। অন্নপূর্ণার মন হুহু করত। সমুদ্রের উপরে ঢেউ দেখা যায়, কিন্তু অন্তরের যে স্রোত বয়ে চলে, তার অস্তিত্ব অন্নপূর্ণার হৃদয়ে।

উদ্ধৃতিঃ “এরূপ শীত তাঁহারা কখনো জ্ঞানে দেখেন নাই।” 

তাৎপর্যঃ আধুনিককালে ছোটোগল্প সাধারণত মনোবিশ্লেষণধর্মী

হয়। আর সেই মনোবিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কথা বলে প্রকৃতি। এই গল্পে শীতের এরূপ প্রাদুর্ভাব একটা সাংকেতিক ব্যঞ্জনায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে। শীত রুক্ষ, কষ্টদায়ী এবং মৃত্যুর প্রতীক। শীতের প্রকোপে দরিদ্র মানুষের দশা কী হয়, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু তার থেকেও বড়ো কথা হল, ক্ষেন্তির চির-অনুপস্থিতি সহায়হরির পরিবারকে যেন ম্রিয়মান করে তুলেছিল। আনন্দ – উচ্ছ্বাসহীন জীবন যেন তাদের মৃত্যুমুখী করে তুলেছিল। পৌষ- পার্বণের দিনেও আগের মতো উচ্ছ্বাস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। বাইরের শীত যেন পরিবারের অন্তরটাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

Leave a Comment