বিভাগ-ক
(i) ফ্রান্সে ক্যাপিটেশন ছিল – (d) উৎপাদন কর।
(ii) রোবসপিয়র ছিলেন – (a) জেকোবিন।
(iii) জেকোবিন দলের সদস্য ছিলেন – (b) টিপু সুলতান।
(iv) ফ্রান্সে ডাইরেক্টরি শাসন শুরু হয় – (b) ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে।
(v) সিজালপাইন প্রজাতন্ত্র ছিল – (d) ইটালিতে।
(vi) মহাদেশীয় অবরোধের পালটা ছিল – (b) অর্ডারস-ইন-কাউন্সিল।
(vii) ন্যায্য অধিকার নীতি-র ফলে ফ্রান্সে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল – (d) বুরবোঁ রাজবংশ।
(vii) ফ্রান্সে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল – (b) ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে।
(ix) হাঙ্গেরির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন (c) লুই কসুথ।
(x) শিল্পবিপ্লবের ফলে তৈরি হওয়া শ্রেণি দুটি ছিল – (b) পুঁজিপতি-শ্রমিক।
(xi) চার্টিস্ট আন্দোলন ছিল – (a) শ্রমিক আন্দোলন।
(xii) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ‘রত্ন’ বলা হত (b) ভারতকে।
(xiii) রাশিয়ায় ভূমিদাসদের মুক্তির আইন জারি করেছিলেন – (b) দ্বিতীয় আলেকজান্ডার।
(xiv) প্যারিস সম্মেলনে মোট চুক্তি হয়েছিল – (b) পাঁচটি।
(xv) স্পেনে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল (c) ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে।
(xvi) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল – (a) জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে।
(xvii) ডি-ডে ছিল – (b) ৬/৬/১৯৪৪।
(xviii) পোলিশ করিডোর ছিল – (c) বার্লিনে।
(xix) জাতিপুঞ্জের সদর দফতর অবস্থিত – (b) নিউ ইয়র্কে
(xx) ভেটো শব্দের অর্থ – (a) প্রস্তাব নাকচ করা।
বিভাগ-খ
উপবিভাগ : A
(i) করভি ছিল ফ্রান্সে প্রচলিত এক প্রকার কর, যাতে বাধ্যতামূলকভাবে বিনা পারিশ্রমিকে বেগার খাটতে হত।
(ii) ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর ট্রাফালগারের যুদ্ধ হয়েছিল।
(iii) WHO-এর অর্থ হল World Health Organisation বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
(iv) হো-চি-মিন ছিলেন ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি।
উপবিভাগ : B
(i) কনসার্ট অফ ইউরোপ তৈরি হয়েছিল ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে। – সত্য।
(ii) সেফটি ল্যাম্প উদ্ভাবন করেন জন কে। – মিথ্যা। [ সঠিক উত্তর : হামফ্রে ডেভি ]
(iii) এপ্রিল থিসিস ঘোষণা করেন ট্রটস্কি। – মিথ্যা। [ সঠিক উত্তর : লেনিন ]
(iv) জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হল ১৫টি দেশ। – সত্য।
উপবিভাগ : C
বামস্তম্ভের সঙ্গে ডানস্তম্ভের মিলকরণ :
ডানস্তম্ভ
(i) কার্বোনারি → (b) গুপ্ত সমিতি
(ii) কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো → (d) ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ
(iii) জন হে → (a) উন্মুক্ত দ্বার নীতি
(iv) তিন সম্রাটের চুক্তি → (c) বিসমার্ক
উপবিভাগ : E
(i) ব্যাখ্যা (b) দার্শনিকরা ফরাসি প্রভৃতির সমালোচনা করেছিলেন।
(ii) ব্যাখ্যা – (a) ফরাসি অর্থনীতি ছিল সামন্ততান্ত্রিক ও বৈষম্যমূলক।
(iii) ব্যাখ্যা – (a) ইংল্যান্ডকে পর্যুদস্ত করার জন্য।
(iv) ব্যাখ্যা (c) নেপোলিয়ন পোপের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন।
বিভাগ-গ
3 (i) ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন টেনিস কোর্টের শপথ হয়েছিল।
(ii) রোবসপিয়র তাঁর সন্ত্রাসের শাসনের মাধ্যমে ফ্রান্সে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালান। এর ফলে আতঙ্কিত হয়ে জেকোবিনরা ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুলাই রোবসপিয়র ও তাঁর অনুগামীদের বন্দি করে পরের দিন অর্থাৎ ২৮ জুলাই তাঁদের গিলোটিনে হত্যা করে। এই ঘটনাই ‘থামিডোরীয় প্রতিক্রিয়া’ নামে পরিচিত।
(iii) রাশিয়া অভিযানের ব্যর্থতার ফলে উজ্জীবিত নেপোলিয়নের শত্রুরা অর্থাৎ রাশিয়া, প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, ইংল্যান্ড প্রভৃতি মোট তেরোটি দেশ জোটবদ্ধ হয়ে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে- তাঁর বিরুদ্ধে লিপজিগের যুদ্ধে অংশ নেয় বলে এই যুদ্ধকে ‘জাতিসমূহের যুদ্ধ’ বলা হয় ।
(iv) ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করলে রাশিয়া যে বিশেষ কৌশল বা পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল তা ‘পোড়ামাটি নীতি’ নামে পরিচিত। ফরাসি বাহিনী যত রাশিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করছিল রাশিয়াও তার এলাকা পরিত্যাগ করে ওই এলাকার খাদ্য, জল প্রভৃতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য নষ্ট করে বা পুড়িয়ে দিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছিল। এর ফলে নেপোলিয়নের সৈন্যবাহিনী মনোবল হারিয়ে অগ্রসর হতে সাহস পায়নি।
(v) ফ্রান্সের উদারপন্থী নেতা ছিলেন অ্যাডলফ থিয়ার্স। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ফরাসি রাজা দশম চার্লসের বিরুদ্ধে উদারপন্থী নেতা থিয়ার্সের নেতৃত্বে ফরাসিবাসী জুলাই বিপ্লব সংঘটিত করে। জুলাই অর্ডিন্যান্স জারির সঙ্গে সঙ্গে থিয়ার্সের নেতৃত্বে প্যারিসের জনসাধারণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
(vi) ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল মূলত রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে। কিন্তু রাশিয়ার প্রাধান্য খর্ব করা এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইউরোপের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে তুরস্কের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া প্রভৃতি দেশ।
(vii) রবার্ট আওয়েন ছিলেন ব্রিটিশ সমাজতন্ত্রবাদের জনক। তিনি প্রথম ‘সোশ্যালিজম’ কথাটি ব্যবহার করেছিলেন। আওয়েন এক নতুন সমাজের কথা বলেছেন, যার নাম তিনি দেন ‘New Harmony’। তিনি বৃহদায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠার ও শ্রমিক শোষণের তীব্র বিরোধী ছিলেন এবং মানুষের নৈতিক উন্নতির থেকে সামাজিক পরিবর্তনের ওপর বেশি জোর দিতেন।
(viii) কার্ল মার্কসের পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রী সাঁ সিমোঁ, চার্লস ফ্যুরিয়ের, রবার্ট আওয়েন প্রমুখ সমাজতন্ত্রীগণ যে সমাজতন্ত্রী আদর্শ প্রচার করেছিলেন, তার কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল না। তাঁরা শোষণের বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছিলেন, সাম্যের আদর্শ প্রচার করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা বাস্তব পথের সন্ধান দিতে পারেননি। এজন্য কার্ল মার্কস ও তাঁর অনুগামীরা ওই সমাজতন্ত্রীদের ‘কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী’ এবং তাঁদের আদর্শকে কাল্পনিক সমাজতন্ত্র’ বা ইউটোপীয় সমাজতন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন।
(ix) রুশ শব্দ ‘নারদ’ থেকেই ‘নারদনিক’ কথাটির উদ্ভব হয়েছে। এর অর্থ জনগণ। রাশিয়ার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কৃষকদের অবস্থার উন্নতির উদ্দেশ্যে তাদের বিপ্লবমুখী করার যে নীতি গ্রহণ করেন, তা ‘নারদনিক আন্দোলন’ নামে পরিচিত হয়।
(x) ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে ‘বিশ্বযুদ্ধ’ বলা হয়। কারণ এত ব্যাপক, ভয়াবহ ও সর্বগ্রাসী যুদ্ধ পৃথিবীতে এর আগে কখনও সংঘটিত হয়নি এবং বিশ্বের প্রায় সব দেশই এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যোগ দিয়েছিল।
(xi) ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি ও জাপান ‘কমিন্টার্ন বিরোধী ‘চুক্তি’ স্বাক্ষর করে। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইটালি এই মিত্রজোটে যোগ দিলে ইটালি, জার্মানি ও জাপানের মধ্যে যে জোট গড়ে ওঠে তা ‘রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষজোট’ নামে পরিচিত। চতুর্থ কোনো শক্তি যদি আক্রমণ করে তাহলে পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করবে এই শর্তে চুক্তি হয়।
(xii) জার্মানির একনায়কতন্ত্রী নেতা হিটলারের নানাবিধ শাস্তি বিঘ্নকারী কাজকর্মে বাধা প্রদান না করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তাঁকে সন্তুষ্ট করার যে নীতি গ্রহণ করেছিল, তা ইঙ্গ-ফরাসি তোষণনীতি নামে পরিচিত। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের কাছে নাৎসিবাদ অপেক্ষা সমাজতন্ত্রবাদই বেশি বিপজ্জনক বলে প্রতিপন্ন হয়েছিল। হিটলার ছিলেন সাম্যবাদের প্রধান শত্রু। তাই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স হিটলারের মাধ্যমে সাম্যবাদকে রোধ করতে চেয়েছিলেন।
(xiii) ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮ এপ্রিল জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অগণিত মানুষের প্রাণহানি, ভয়াবহ ধ্বংসকাণ্ড, বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি, মারণাস্ত্রের ব্যবহার ইত্যাদি বিশ্বজনমানসে যে আতঙ্ক ও ব্যাকুলতার সৃষ্টি করে। তার থেকে মুক্ত হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মানুষ অগ্রণী হয়। এই শান্তি স্থাপনের প্রধান পদক্ষেপ স্বরূপ গড়ে ওঠে জাতিসংঘ।
(xiv) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর অক্ষশক্তির কাছ থেকে প্রাপ্ত অনুন্নত দেশগুলিকে অছি পরিষদের অধীনস্থ করা হয় কারণ এই সমস্ত অঞ্চলের অধিবাসীরা তখনও পর্যন্ত স্বাধীনতা প্রাপ্তির উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। জাতিপুঞ্জের অছি পরিষদের লক্ষ্য হল এই সমস্ত অনুন্নত দেশগুলিকে জাতিপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণে এবং কয়েকটি বৃহৎ রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে রেখে তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি ঘটিয়ে স্বাধীনতা পাওয়ার উপযুক্ত করে তোলা।
বিভাগ-ঘ
উপবিভাগ : A
(i) ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লব ছিল ফরাসি জনগণের তৎকালীন ফরাসি সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের মানসিকতার ফল। আর এই পরিবর্তনে নারীদের ভূমিকা কোনোমতেই উপেক্ষণীয় নয়। তাঁরাও বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ, সন্ত্রাসের শাসন, ১৭৮৯-এর অক্টোবরের ঘটনা, রুটির দাঙ্গা প্রভৃতি বিপ্লবের বৃহৎ ঘটনাবলির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল।
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে নারীদের কোনোরকম রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। তারা চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী গৃহে স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকা পালন করত। কিন্তু বিপ্লবের তরঙ্গ যখন ফরাসি দেশে আছড়ে পড়ে, তখন ফরাসি নারীসমাজও অন্তরালে না থেকে বিপ্লবকে সফল করার জন্য উদ্যত হয়। বহু মহিলা ‘লে এমিয়েস দা লা ভেরিট’ [Les Amies de la Verite] প্রভৃতি মহিলা ক্লাবে যোগদান করে এবং এর মাধ্যমেই বিপ্লবে যোগদান করে। তারা বিক্ষুব্ধ জনতাকে বাস্তিল দুর্গ ভেঙে ফেলায় উৎসাহ জোগায়, সমাজে পুরুষের আইনগত প্রাধান্যের বিষয়ে প্রশ্ন তোলে, এস্টেট জেনারেলে নারীদের প্রতিনিধিত্বের দাবি জানায়, পুরুষের সমান নারীর সুযোগসুবিধা ও অধিকার লাভের দাবিতে সোচ্চার হয়। মেরি অলিম্পে ডি গুজ, এত্তাপালম, মাদাম বি বি প্রমুখ মহিলা বিপ্লবী আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়াও জিরন্ডিস্ট দলের ডি কর্ডেড আর্মন্ট এবং জেকোবিন দলের মাদাম রোল্যান্ড, পাওলিন লিওন প্রমুখের নামও এ বিষয়ে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
ফরাসি বিপ্লবে নারীরা যে এক পরিবর্তনমুখী চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কেননা নারীরা বস্তুগত প্রয়োজন তথা জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের দাবিতে সাঁকুলো জনতার বিপ্লবী কাজকর্মের সহযোগীরূপে বিভিন্ন বাদ-প্রতিবাদে শামিল হয়। তারা পুরাতন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে নতুন ব্যবস্থার প্রতিস্থাপনে উৎসাহ প্রদান করে। পরিশেষে বলা যায় বিপ্লবের সামাজিক শক্তিরূপে তারা যে ক্রিয়াশীল ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
(ii) ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে স্বৈরাচারী বুরবোঁ (Bourbon) রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এই বিপ্লব ফ্রান্সের পাশাপাশি সমগ্র ইউরোপেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
ফরাসি বিপ্লনের প্রভাব :
পুরাতন ব্যবস্থার অবসান : ফরাসি বিপ্লব ফ্রান্সের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্টের পর তিনটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। চার্চের নিজস্ব আদালত, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও বিপুল সম্পত্তির পাশাপাশি অভিজাত সম্প্রদায়ের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত সমস্ত সুযোগসুবিধার বিলোপ ঘটে। প্রতিষ্ঠিত হয় সাম্যের অধিকার।
পুরাতন রাজতন্ত্রের অবসান : ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে স্বৈরাচারী ও দৈবানুগৃহীত রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইংল্যান্ডের অনুকরণে প্রতিষ্ঠিত হয় সাংবিধানিক রাজতন্ত্র।
জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা : ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন অংশে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা ছিল, বিপ্লবের ফলে তার অবসান ঘটে। ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান’ এবং দেশের সর্বত্র একই শাসন প্রবর্তিত হওয়ার ফলে জাতীয় ঐক্যের পথ প্রশস্ত হয়।
ইউরোপে প্রভাব : ফ্রান্সের মতো ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ফরাসি বিপ্লবের গভীর প্রভাব পড়েছিল। নেপোলিয়ন Napoleon) ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল জয় করার ফলে ওইসব ফলে ফরাসি বিপ্লবের মহান আদর্শগুলি (সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা) ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে ইউরোপবাসী এক নতুন জীবনদর্শনের সন্ধান পায়।
সর্বোপরি ফরাসি বিপ্লবে ফরাসি জনগণের সাফল্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুক্তি আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিল।
উপবিভাগ : B
(iii) নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের ব্যর্থতা তাঁর সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূলে প্রবল নাড়া দিয়েছিল। নেপোলিয়ন আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘সম্ভবত আমি মস্কো গিয়ে ভুল করেছিলাম।’
নেপোলিয়নের পতনে রাশিয়া অভিযানের ভূমিকা :
নেপোলিয়নের অপরাজেয় ভাবমূর্তিতে আঘাত : রাশিয়া অভিযানের ব্যর্থতায় নেপোলিয়নের অপরাজেয় ভাবমূর্তি ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল।
নেপোলিয়নের কূটকৌশলের পরাজয় : নেপোলিয়ন প্রায় বিনা বাধায় রাজধানী মস্কো পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। তারপর তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। আসলে তিনি রাশিয়ার কূটকৌশলের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
নেপোলিয়ন বিরোধী ইউরোপীয় শক্তির উল্লাস : রাশিয়া অভিযান ব্যর্থ হওয়ার ফলে ফ্রান্স বিরোধী ইংল্যান্ড, প্রাশিয়া-সহ অনেক দেশ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফ্রান্সেও তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু হয়েছিল।
ফ্রান্সের অধীনস্থ দেশে প্রতিবাদ : নেপোলিয়নের যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করতে হত সাধারণ মানুষকে। এজন্য তাদের ওপর বাড়তি কর আরোপ করা হত। নেপোলিয়নের পরাজয় তাদের উৎসাহিত করেছিল। ফলে তারা শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হয়।
(iv) নেপোলিয়নের সিংহাসন আরোহণের প্রাক্কালে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছিল। তাই ক্ষমতা লাভ করে তিনি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। নেপোলিয়নের অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি হল-
অর্থনৈতিক সংস্কার :
সব ব্যয়সংকোচের নীতি : নেপোলিয়ন অর্থনৈতিক দিক থেকে ফ্রান্সকে শক্তিশালী করার জন্য প্রথমেই সরকারি দপ্তরগুলিকে কঠোরভাবে ব্যয়সংকোচের নির্দেশ দেন।
কর আদায়ে গুরুত্ব : তিনি নিয়মিতভাবে কর আদায়ের ব্যবস্থা করেন। তিনি সমস্ত বাড়তি কর বাতিল করে কেবলমাত্র কয়েকটি কর নির্দিষ্ট করে দেন। প্রত্যক্ষ কর অপেক্ষা পরোক্ষ কর আদায়কেই তিনি বেশি গুরুত্ব দেন এবং লবণ ও সুরার ওপর পরোক্ষ কর আরোপ করেন।
ক্ষুদ্র ব্যাংক অফ ফ্রান্স স্থাপন : আর্থিক পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে ‘ব্যাংক অফ ফ্রান্স’ (Bank of France) স্থাপন করেন।
উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ : ব্যাবসাবাণিজ্যের উন্নতির জন্য তিনি চেম্বার অফ কমার্স ও স্টক এক্সচেঞ্জ স্থাপন, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও বন্দরগুলির উন্নয়নের চেষ্টা করেন।
আইন সংস্কার : নেপোলিয়ন ফ্রান্সে প্রচলিত বিভিন্ন আইন বাতিল করে সমগ্র ফ্রান্সের জন্য যে আইন সংহিতা কার্যকর করেছিলেন তা কোড নেপোলিয়ন (Code Napoleon) নামে পরিচিত। ২২৮৭টি আইন সংবলিত এই আইন সংহিতাটি তিন ভাগে বিভক্ত ছিল ও বাণিজ্যিক আইন। দেওয়ানি আইন, ও ফৌজদারি আইন
বৈশিষ্ট্য : ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শে রচিত নেপোলিয়নের আইন সংহিতার বৈশিষ্ট্যগুলি হল – @ আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান, ও যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে নিয়োগ, ও সামন্ততান্ত্রিক বৈষম্যের বিলুপ্তি, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারের স্বীকৃতি প্রভৃতি।
উপবিভাগ : C
(v) ১৮১৫-১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখ। ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার আদর্শের চরম বিরোধী মেটারনিখ সমস্ত রকমের উদারনৈতিক সংস্কারমূলক চিন্তাধারাকে অবদমিত করার মনোভাব নিয়ে অস্ট্রিয়া এবং ইউরোপের সর্বত্র মেটারনিখতন্ত্রকে কায়েম করতে উদ্যত হন।
১৮১৫-১৮২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশই মেটারনিখ ব্যবস্থার আওতায় ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে ইউরোপের বেশ কিছু দেশ বিপ্লবী আদর্শ এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে মেটারনিখ ব্যবস্থার বিরোধিতা শুরু করে। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ইটালি, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম সর্বত্র উদারনৈতিক ও গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা বিস্তার লাভ করতে শুরু করে।
মেটারনিখতন্ত্রের অভিঘাতে ফ্রান্সে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় ফেব্রুয়ারি বিপ্লব। সমগ্র ফ্রান্সের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপেও এর প্রভাব পড়ে। ফ্রান্সের পাশাপাশি অস্ট্রিয়া ও জার্মানিতেও ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে মেটারনিখ ব্যবস্থা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের অধীন হাঙ্গেরিতে জাতীয়তাবাদী নেতা লুই কসুথের নেতৃত্বে ব্যাপক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দরুন হাঙ্গেরি স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। একইভাবে বোহেমিয়াতে চেক জাতি আন্দোলনে সাফল্য লাভ করে। অন্যদিকে জার্মানিতে মেটারনিখ পুরাতনতন্ত্রকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে কার্লসবাড় ডিক্রি জারি করেন। মেটারনিখ ব্যবস্থা বলবৎ করার মাধ্যমে জার্মানির ঐক্যের পথে অন্তরায় সৃষ্টির সবরকম চেষ্টা হলেও ঐক্যের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন সকল বাধা দূর করে দেয়। মেটারনিখের পুরাতনতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার অভিসন্ধিকে ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে ইটালিতে শুরু হয় ঐক্য আন্দোলন যার ফলস্বরূপ মেটারনিখ ব্যবস্থা প্রসূত পুরাতনতন্ত্রের আবরণ সরিয়ে ইটালি ভৌগোলিক সংজ্ঞা থেকে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। শেষ পর্যন্ত ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মার্চ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে সর্বসাধারণের তীব্র গণ আন্দোলনের দরুন মেটারনিখ পদত্যাগ করে ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান, ফলে মেটারনিখতন্ত্রের পতন ঘটে।
(vi) ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লবের ফলে অলিয়েন্স বংশের লুই ফিলিপ সিংহাসনে বসেছিলেন। খুব অল্পদিনের মধ্যে তার বিরুদ্ধে ফ্রান্সে ব্যাপক ক্ষোভ জমে। তার বিরুদ্ধে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ঘটে। এই বিপ্লবে তিনি পরাজিত হন। এই বিপ্লবের প্রভাব নিম্নরূপ-
দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র : ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে বুর্জোয়া রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং ফ্রান্সে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন লা-মার্টিন।
ভোটাধিকার : ফ্রান্সে দশ জন সদস্য নিয়ে ‘কার্য নির্বাহক সমিতি’ গঠিত হয়। তারা প্রাপ্তবয়স্কের ভিত্তিতে ভোটাধিকারের স্বীকৃতি দেয়। এর ফলে নিম্নবিত্তরা ভোটদানের অধিকার পায়।
আইনসভা গঠন : সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৭৫০ জন। তাদের ভোটে নেপোলিয়নের ভাইপো লুই নেপোলিয়ন নির্বাচিত হয়ে তৃতীয় নেপোলিয়ন নাম নিয়ে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন।
জনকল্যাণ : নতুন প্রজাতান্ত্রিক সরকার একগুচ্ছ জনকল্যাণের কর্মসূচি গ্রহণ করে। যেমন—শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা বেঁধে দেয়। সকলের কাজের অধিকারের স্বীকৃতি দেয়। জাতীয় কর্মশালা স্থাপন করে বেকারদের কাজের সুযোগ করে দেয়। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দকে বলা হয় বিপ্লবের বছর’। ফেব্রুয়ারি বিপ্লব থেকে প্রেরণা নিয়ে ইউরোপের প্রায় ১৫টি দেশে গণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তা সত্ত্বেও ‘ফেব্রুয়ারি বিপ্লব’ স্থায়ী হয়নি। কারণ বহু রক্ষণশীল ব্যবস্থা এই বিপ্লবকে ব্যর্থ করেছিল।
উপবিভাগ : D
(vii) শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্পোন্নত দেশগুলি তাদের উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রির বাজার এবং প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানির জন্য নতুন বাজারের খোঁজে সচেষ্ট হয়। কারণ উদ্বৃত্ত পণ্য ইউরোপের দেশগুলিতে বিক্রির সুযোগ ছিল না।
উৎপন্ন পণ্য বিক্রির বাজার : শিল্পোন্নত দেশগুলি নিজ দেশীয় শিল্পের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের ও আন্তর্জাতিক বাজার দখলের জন্য অন্য দেশের শিল্পের ওপর অত্যধিক শুল্ক আরোপ করে। যেমন বেলজিয়াম, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ উচ্চ হারে আমদানি শুল্ক বসিয়ে ব্রিটিশ পণ্য আমদানি প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। এর ফলে শিল্পোন্নত দেশগুলি ঔপনিবেশিক বাজার দখলের জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে।
মূলধন বিনিয়োগের ক্ষেত্র : ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে নতুন সংকট দেখা দেয়। নতুন শিল্পস্থাপনের সুযোগ কমতে থাকায় মূলধনের চাহিদা কমে যায়। ফলে মূলধনের পাহাড় গড়ে ওঠে। এর ফলে শিল্পোন্নত দেশগুলির পুঁজিপতি বা বণিকরা মূলধন বিনিয়োগের জন্য নতুন অঞ্চল খুঁজতে থাকে এবং এই দেশগুলি এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ দখলের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে।
উগ্র জাতীয়তাবাদের বহিঃপ্রকাশ আফ্রিকা ব্যবচ্ছেদ। বস্তুত ১৮৭০-এর দশকের নব সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম শিকার আফ্রিকা। আফ্রিকার উত্তর ভাগ এবং পূর্ব-পশ্চিম উপকূলের কিছু অঞ্চলে ইউরোপীয়দের উপনিবেশ ছিল। স্ট্যানলি, লিভিংস্টোন, স্কট, স্পেক প্রমুখ ধর্মপ্রচারক ও দুঃসাহসী অভিযাত্রীদের প্রচেষ্টায় ইউরোপীয়দের কাছে আফ্রিকা উন্মুক্ত হয়। অফুরন্ত বনজ সম্পদ, যেমন মোম, গজদন্ত, চামড়া এবং খনিজ সম্পদ, যেমন কয়লা, তামা, অভ্র, ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতিতে সমৃদ্ধ আফ্রিকা। প্রকৃতির অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ এই অঞ্চল দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়েছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, ইটালি, পোর্তুগাল, স্পেন ও ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ।
উপনিবেশবাদের সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদের সম্বন্ধ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ডেভিড থমসন বলেছেন, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ ছিল উগ্র জাতীয়তাবাদের যুগ। তাঁর মতে, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর জার্মানি ও ইটালিতে উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল। এই দেশগুলি মনে করত যে, উপনিবেশে আধিপত্য স্থাপন না করলে তাদের শক্তি বাড়বে না; আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের সম্মান থাকবে না। সেজন্য এই দেশগুলি উপনিবেশ দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল।
(viii) আফ্রিকা ব্যবচ্ছেদ : ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ইউরোপের কাছে আফ্রিকা ছিল অন্ধকারময় মহাদেশ। এই সময় উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়া ছিল ফরাসি উপনিবেশ এবং দক্ষিণে উত্তমাশা অন্তরীপ, কেপ কলোনি ছিল ইংল্যান্ডের দখলে। টিউনিস ও ত্রিপোলি ছিল তুর্কি সাম্রাজ্যভুক্ত আর বাকি আফ্রিকা ছিল অনাবিষ্কৃত। আফ্রিকা সম্বন্ধে জানার পরেই ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে আফ্রিকা সম্পর্কে উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। অল্প সময়ের মধ্যেই ইউরোপ আফ্রিকার দেশগুলিতে নিজ অধিকার কায়েম করতে শুরু করে।
দ্বিতীয় লিওপোল্ড : আফ্রিকায় উপনিবেশ বিস্তারের ক্ষেত্রে বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্ট্যানলি কঙ্গো আবিষ্কার করলে আফ্রিকা সম্বন্ধে আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড কঙ্গো উপত্যকার উন্নয়নের জন্য ব্রাসেলস্ শহরে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করেন। এখানে আফ্রিকা মহাদেশে ব্যাবসাবাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়। এই সম্মেলনে ‘International African Association’ নামে এক সংগঠন গড়ে তোলা হয়। কিন্তু এই সংগঠনকে প্রতিটি দেশ অমান্য করে উপনিবেশ গড়তে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে।
বেলজিয়াম কঙ্গো দেশের খনিজ সমৃদ্ধ অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপনে আগ্রহী হলে ব্রিটেন ও পোর্তুগাল তার বিরোধিতা করে। ফ্রান্স ও ব্রিটেন উভয়েরই কঙ্গো নদী দিয়ে চলাচল প্রয়োজন ছিল। ইঙ্গ-পোর্তুগাল কঙ্গো নদী কমিশন’ নামে এক যুগ্ম কমিশন গঠিত হয়। ব্রিটেন অ্যাঙ্গোলার ওপর পোর্তুগালের অধিকার স্বীকার করে নেয়। বেলজিয়াম জার্মানি ও ফ্রান্সের সাহায্য প্রার্থনা করে। ফ্রান্স কঙ্গো নদীর উত্তরে এবং জার্মানি টোগোল্যান্ড, সেন্ট লুসিয়া উপসাগরীয় অঞ্চল, ক্যামেরুন প্রভৃতি অঞ্চলে উপনিবেশ বিস্তারে আগ্রহী হয়। ইটালিও আবিসিনিয়া উপকূলে উপনিবেশ স্থাপন করে। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার ১১ অংশ ছিল ইউরোপীয় উপনিবেশ; মাত্র ২০ বছরের মধ্যে যা ১০ অংশে পরিণত হয়।
বার্লিন সম্মেলন : এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক সংকট সৃষ্টি হলে সেই সংকট নিরসনের জন্য ইউরোপের নানা দেশের প্রতিনিধিগণ ১৮৮৪-৮৫ খ্রিস্টাব্দে বার্লিনে এক সম্মেলনে মিলিত হন। এই সম্মেলনে আফ্রিকায় ইউরোপীয় শক্তিগুলি উপনিবেশ স্থাপনে সবুজ সংকেত লাভ করে। বলা হয় যে, কোনো রাষ্ট্র আফ্রিকা দখল করতে চাইলে ইউরোপীয় শক্তিবর্গকে জানাতে হবে। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের বার্লিন কংগ্রেসে আফ্রিকাকে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেওয়ার পাকাপাকি ব্যবস্থা করা হয়।
উপবিভাগ : E
(ix) ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব সমকালীন সমগ্র বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। ঐতিহাসিক ই এইচ কার (E H Carr) বলেছেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বলশেভিক আন্দোলন একটি বিশ্ব আন্দোলনে পরিণত হয়।
সামাজিক প্রভাব :
সাম্যবাদী ভাবধারার বিস্তার : রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তার প্রভাবে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাম্যবাদী ভাবধারার বিস্তার ঘটে।
সমাজে শ্রমিক শ্রেণির মর্যাদা বৃদ্ধি : রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার সাম্যবাদী ভাবধারার গতিরোধ করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি শ্রমিক কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে।
নাগরিকের সমানাধিকার : রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার অনুরূপ নাগরিকের সমানাধিকারের নীতি বিশ্বের অনেক দেশ গ্রহণ করেছিল।
নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার প্রদান : রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় রাষ্ট্রকে গির্জা থেকে পৃথকীকরণ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার আদর্শ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুসৃত হয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব :
ব্যক্তিমালিকানার অবসান : রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় ব্যক্তিমালিকানা ও ব্যক্তিগত মুনাফার নীতি পরিত্যক্ত হয়। কলকারখানার উৎপাদন ও বণ্টন রাষ্ট্রের অধীনে আনা হয়। পৃথিবীর অনেক দেশ এই নীতির দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে প্রভাবিত হয়।
জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ : রাশিয়ায় জমিদারের জমি বাজেয়াপ্ত করে তা কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।
কৃষিক্ষেত্রে প্রভাব : রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার কৃষকরা উদবৃত্ত ফসল নিজেরা বাজারে বিক্রি করতে পারত ও নগদ মূল্যে কর দিত। কৃষির উন্নতির জন্য কৃষি ব্যাংক ও সমবায় ব্যবস্থা গঠন করা হয়। এই কৃষিনীতির দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ প্রভাবিত হয়েছে।
শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়ন : রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় শ্রমিকদের দৈনিক কাজের সময়সীমা ৮ ঘণ্টা নির্দিষ্ট করা হয়। শ্রমিকদের বিনামূল্যে চিকিৎসা, দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুসারে উপযুক্ত মজুরি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। শ্রমিকদের উন্নয়নের এই নীতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গৃহীত হয়েছে।
পুঁজিবাদের বিকল্প : ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় আর্থিক মহামন্দা শুরু হলে বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব পড়লেও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই মন্দার প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল। এর ফলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করে।
রুশ বিপ্লব বিশ্ব অর্থনীতিতেও আলোড়ন সৃষ্টি করে। কৃষি-শিল্পের জাতীয়করণ, গণবণ্টন ব্যবস্থার গণমুখীকরণ, শোষণহীন সমাজ বিশ্বের সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে এবং বহু দেশ তার অনুকরণ করে।
( x ) স্পেনের গৃহযুদ্ধ : স্পেনের গৃহযুদ্ধ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে একটি চাঞ্চল্যকর তথা বেদনাদায়ক ঐতিহাসিক ঘটনা। এই গৃহযুদ্ধ আঞ্চলিক সংকট থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। কিন্তু ক্রমশ এটি একটি ব্যাপক মহাদেশীয় সমস্যার চরিত্র ধারণ করে।
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে সমাজতন্ত্রী, সাম্যবাদী ও প্রজাতন্ত্রী দল ‘পপুলার ফ্রন্ট’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পপুলার ফ্রন্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন ক্যাসারিস কুইরোগা এবং রাষ্ট্রপতি হন ম্যানুয়েল আজানা। ফ্রন্ট সরকার বিদ্রোহীদের নিরস্ত্র করতে সেনাবাহিনীর একাংশের ব্যাপক বদলি, গ্রেফতার ও অনেককে দেশ থেকে বহিষ্কার করেন। জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে এই সময় ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসন দেওয়া হয়। এই ঘটনায় সেনাবাহিনীর অনেকে ফ্রাঙ্কোর পক্ষে ফ্রন্ট সরকারের বিরোধিতা করেন। যাজক, জমিদার, বুর্জোয়া, শিল্পপতি, দক্ষিণপন্থী দল ফ্রাঙ্কোর পক্ষ অবলম্বন করে। শুরু হয় স্পেনে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে মরক্কোর স্পেনীয় সেনারা সর্বপ্রথম এই যুদ্ধের সূচনা করে। গৃহযুদ্ধে ফ্রাঙ্কোকে সমর্থন করে জার্মানি ও ইটালি। রাশিয়া পপুলার ফ্রন্ট সরকারকে সাহায্য পাঠায়। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করে। তিন বছর ব্যাপী যুদ্ধের শেষে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল গণতান্ত্রিক শক্তিকে পরাজিত করে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
নতুন মারণাস্ত্রের পরীক্ষানিরীক্ষা হয় এই যুদ্ধের মাধ্যমে এবং ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। এজন্য স্পেনীয় গৃহযুদ্ধকে ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া’ বলে। শেষে ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে স্পেনে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
গুরুত্ব স্পেনের গৃহযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বহু রাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধের ব্যাপকতার ফলে জাতিসংঘের আদর্শের অসারতা প্রমাণিত হয়। সর্বোপরি স্পেনে ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিস্ট সরকার জয়লাভ করায় পশ্চিম ইউরোপে ফ্যাসিবাদী প্রভাব পড়ে।
উপবিভাগ : F
(xi) বিশ্ব ইতিহাসের সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণ থেকে শুরু করে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর জাপানের আত্মসমর্পণের সময়কালের মধ্যে এই যুদ্ধের প্রকৃত বিশ্বজনীন রূপটি ধরা পড়ে।
বিশ্বজনীন রূপ : বিশ্বযুদ্ধ নামকরণের মধ্যে এই যুদ্ধের বিশ্বজনীন রূপটি ধরা পড়ে। তা ছিল—
বিস্তার : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে বিস্তৃত হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় এই যুদ্ধে বিস্তারের ব্যাপকতা লক্ষ করা যায়।
এই যুদ্ধে ইংল্যান্ড আক্রান্ত হয়েছিল। রাশিয়ার অভ্যন্তরে জার্মানবাহিনী ঢুকে পড়ে। উত্তর আফ্রিকায় তীব্র যুদ্ধ হয়। ভূমধ্যসাগর জার্মানি ও ইটালির নিয়ন্ত্রণে আসে। গ্রিস আক্রান্ত হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ (থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস, ব্রহ্মদেশ), আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ জাপান জয় করে।
এভাবে প্রায় সবকটি মহাদেশে এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে কয়েকটি রাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলেও তাদের মিত্র বা উপনিবেশগুলি এই যুদ্ধে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে।
এ ছাড়া এই সময় বিমানবহর উন্নত হয়েছিল। পৃথিবীর সর্বত্র দুই পক্ষের বিমানবহরের আক্রমণ প্রতি-আক্রমণ চলে। নৌবহর সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। উত্তর সাগর, আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগর, ভূমধ্যসাগর দু-পক্ষের নৌবহরের যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে ওঠে। আর এই সময় মোটরগাড়ি ব্যাপক চালু হওয়ায় স্থলবাহিনীর চলাচলের গতি বাড়ে।
ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতি : যুদ্ধ মানে ধ্বংস এবং জীবন ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি। এই যুদ্ধে ইউরোপের প্রায় প্রত্যেকটি দেশ ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। জার্মান আক্রমণ ও পোড়ামাটি নীতির জন্য রাশিয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উত্তর আফ্রিকার দেশগুলি দুপক্ষের যুদ্ধক্ষেত্র হওয়ায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার নৌ-ঘাঁটিটি ধ্বংস হয়ে যায়। মার্কিন আণবিক বোমা বর্ষণে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দুটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহু প্রাণহানি ঘটে।
এই যুদ্ধে প্রায় ৫ কোটি মানুষ নিহত ও ৪ কোটি মানুষ আহত হয়। খরচ হয় প্রায় ১ লক্ষ ১১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। এ ছাড়া ধ্বংস হওয়া সম্পদের পরিমাণ আরও কয়েকগুণ বেশি ছিল।
প্রভাব : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতির ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। আর্থিক অভাব, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি মানুষকে অসহনীয় দুর্দশার মধ্যে ফেলে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধবিরোধী গণমত প্রবল আকার ধারণ করে।
(xii) হিরোশিমা-নাগাসাকি ঘটনা :
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর জাপান হাওয়াই দ্বীপে অবস্থিত মার্কিন নৌঘাঁটি পার্ল হারবারে বোমাবর্ষণ করে ধ্বংস করে দেয়। এর পরদিনই মিত্রশক্তিভুক্ত আমেরিকা জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মিত্রশক্তির নেতারা জাপানের বন্ধু জার্মানির আত্মসমর্পণের (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ, ৭ মে) পর জাপানকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। কিন্তু জাপান তাতে কর্ণপাত না করে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জাপান ছিল মিত্রপক্ষের বিরোধী অক্ষশক্তি। জাপানের কমান্ডারদের প্রধান কার্যালয় ছিল হিরোশিমা নামক জনবহুল শহর।
হিরোশিমাতে বোমাবর্ষণ : আমেরিকা জাপানের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৬ আগস্ট সকাল ৮:১৫ মিনিটে জাপানের হন-সু দ্বীপের শিল্পশহর হিরোশিমায় ‘লিটল বয়’ নামে প্রথম পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করলে শহরটি কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
নাগাসাকিতে বোমাবর্ষণ: এর তিনদিন পর আমেরিকা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৯ আগস্ট রাত ৩:৪৭ মিনিটে জাপানের নাগাসাকিতে ‘ফ্যাটম্যান’ নামে দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমাবর্ষণ করলে নাগাসাকি শহরটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।
আত্মসমর্পণ : হিরোশিমা ও নাগাসাকি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলে জাপান ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়।
ধ্বংসলীলা : পারমাণবিক বোমাবর্ষণের ফলে হিরোশিমা শহরে ৭৮ হাজার জাপানি এবং নাগাসাকিতে প্রায় ৪০ হাজার নিরীহ জাপানি মারা যায়। প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ আহত ও বিকলাঙ্গ হয়। হিরোশিমার ওপর নিক্ষিপ্ত বোমাটি প্রায় ২০ হাজার টন টি-এন-টি বা বিস্ফোরকের সমান ছিল। নাগাসাকির ওপর নিক্ষিপ্ত বোমাটি ছিল ২২ হাজার টন টি-এন-টির সমতুল্য। জাপানের সর্ববৃহৎ ৬০টি শহরের কমপক্ষে ত্রিশ শতাংশ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। হিরোশিমার ওপর বোমাবর্ষণ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে ভয়ংকরতম দিক . এবং এই ঘটনা প্রমাণ করেছিল যে অল্প সময়ে বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড দ্বারা খুব দ্রুত যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব।
বিভাগ-ঙ
5 (i) শহরে জনতার অংশগ্রহণের মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লব সর্বাত্মক হয়ে উঠেছিল। তারাই ছিল ফরাসি বিপ্লবের সবথেকে বড়ো সমর্থক। এই বিপ্লবে শহুরে দরিদ্র জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। এই শহুরে জনতার এক বৃহদংশ ছিল মুটে, ছোটো দোকানদার, গৃহভৃত্য, দিনমজুর, কারিগর প্রভৃতি।
অ্যালবার্ট সবুল তাঁর ‘দ্য সাঁকুলোৎ’ গ্রন্থে বলেছেন – বিপ্লব অনেকাংশে ছিল তাদেরই সৃষ্টি। অনেকের মতে, রাজাকে স্টেটস্ “জেনারেলের অধিবেশন ডাকতে বাধ্য করেছিলেন অভিজাতরা কিন্তু বুর্জোয়ারা রাজাকে তাদের দাবি মানতে বাধ্য করেছিল এবং শহরের নীচুতলার মানুষ বাস্তিল দুর্গের পতনের মতো ঘটনা ঘটিয়ে বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।
শহরের দরিদ্র জনতাদের জীবনে একটি বড়ো সমস্যা ছিল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। দিন দিন জিনিসপত্রের দাম বাড়ত কিন্তু তাদের মজুরি বাড়ত না। এজন্য তারা মাঝে মাঝে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করত।
বাস্তিল দুর্গের পতন : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গ আক্রমণের সময় থেকে ফরাসি সমাজের শহুরে মানুষের সঙ্গে ফরাসি বিপ্লবের সংযোগ ঘটে। শহরের দরিদ্র জনগণ বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করেছিল। অনেক মানুষ রক্ষীদের গুলিতে প্রাণ হারায়।
ভার্সাই অভিযান : বাস্তিল দুর্গের পতনের সূত্র ধরে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ অক্টোবর খাদ্যের দাবিতে বিপুল সংখ্যক জনতা ভার্সাই অভিযান করে। তারা রাজরক্ষীদের হত্যা করে সমগ্র রাজপরিবারকে ভার্সাই থেকে প্যারিসে আসতে বাধ্য করে। এই সময় থেকে রাজা তৃতীয় শ্রেণির উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে বন্দি হয়ে যান।
টুইলারিস রাজপ্রাসাদ আক্রমণ : সম্রাট ষোড়শ লুই-এর গোপনে পালানোর প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে শহুরে জনগণ রাজতন্ত্রের অবসান এবং প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠনের দাবি জানায়। প্যারিসের রাজা ব্রিসোপন্থী জিরন্ডিন দলের মন্ত্রীদের কয়েকজনকে বরখাস্ত করলে শহুরে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন টুইলারিস রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে।
চর দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব : এই ঘটনার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ রাজা ব্রান্সউইক ঘোষণাপত্র জারি করলে শহুরে জনগণ দ্বিতীয়বার টুইলারিস রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে (১০ আগস্ট, ১৭৯২ খ্রি) এবং সম্রাটকে বন্দি করে। এই ঘটনা দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব নামে পরিচিত।
জেকোবিন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা : ন্যাশনাল কনভেনশনে জিরন্ডিন ও জেকোবিনদের মধ্যে সংঘাত দেখা দিলে শহুরে জনগণ ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মে – ২ জুন ন্যাশনাল কনভেনশন ঘেরাও করে রাখে। অবশেষে জেকোবিনদের হাতে ক্ষমতা আসে এবং প্রতিষ্ঠিত হয় জেকোবিন প্রজাতন্ত্র।
পরিশেষে বলা যায়, ফরাসি বিপ্লবে শহুরে সমাজের নীচুতলার মানুষদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকলেও তারা খুব একটা লাভবান হয়নি। তাদের কাছে এই বিপ্লব ছিল মরুভূমির মরীচিকার মতো, যার পিছনে তারা ছুটেছিল তার অনেকটাই থেকে গিয়েছিল অধরা।
যে-কোনো আন্দোলন, বিপ্লব বা বিদ্রোহের মতো ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালেও অদ্ভুত ও অবাস্তব সব অভিযোগের ভিত্তিতে সাধারণ মানুষ যাজক, অভিজাত, রাজা, রানি প্রমুখের বিরুদ্ধে গুজব রটিয়ে জনচেতনা বৃদ্ধি করেছিল তথা নানাভাবে বিপ্লবকে প্রভাবিত করেছিল।
প্রথমত, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন গুজব রটে যে, রাজা ষোড়শ লুই তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে চলেছেন। এরপরেই তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা স্টেটস্ জেনারেলের সভাকক্ষ বন্ধ দেখে গুজবটি সত্য বলে ভাবেন এবং টেনিস কোর্টের শপথের মাধ্যমে বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেন।
দ্বিতীয়ত, আবার বাস্তিল দুর্গ আক্রমণকালে গুজব ছড়ায় যে, অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই কামানের মুখ জনতার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে জনমানসে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়।
তৃতীয়ত, জর্জ লেভের (Lefebre)-এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, বাস্তিল দুর্গের পতনের পর কৃষকরা চার্চ ও সামন্তপ্রভুদের দেয় করগুলি বন্ধ করে দিলে কৃষক সমাজে গুজব ছড়ায় যে, ভূস্বামীরা গুন্ডাদের দিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে এর ফলে বিক্ষুব্ধ কৃষকরা আরও হিংস্র হয়ে উঠলে শেষ পর্যন্ত সংবিধান সভা সামন্ততান্ত্রিক আধিপত্যের অবসান ঘটায়।
সর্বোপরি, কোবান (Cobban)-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ড (১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের ২-৬ সেপ্টেম্বর) ঘটার আগে গুজব রটে যে বিদেশি সেনাদল প্যারিসের মাত্র ২০০ মাইল দূরে রয়েছে। তারা প্যারিসে এসে বন্দি অভিজাতদের মুক্ত করবে এবং বিপ্লবীদের ওপর আঘাত হানবে ফলই হল সেপ্টেম্বরের হত্যাকাণ্ড। অতএব এই আতঙ্কের
এইভাবে ফরাসি বিপ্লবের বিভিন্ন পর্যায়ে নানান ‘গুজব’ বিপ্লবকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল।
(ii) ফ্রান্সের ইতিহাসে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই বিপ্লবের কারণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
কারণ :
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণগুলি হল
খাদ্য সংকট : ১৮৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দে খাদ্যসংকটের ফলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায় যা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের দুর্দশা বৃদ্ধি করে, যা দূর করা লুই ফিলিপের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
জনগণের ক্ষোভ : সমসাময়িক রাজনৈতিক দলগুলির কেউই ফিলিপকে সমর্থন করেনি। বুর্জোয়া পার্লামেন্ট যেহেতু রাজাকে নিয়োগ করে সেই কারণে শ্রমিক, কৃষক ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ভোটাধিকার না পেয়ে ফিলিপের ওপর ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
লুই ফিলিপের ভ্রান্ত বৈদেশিক নীতি : লুই ফিলিপের ভ্রান্ত বৈদেশিক নীতি ফরাসিবাসীকে আরো হতাশ করে। যুদ্ধ এড়ানোর জন্য পোল্যান্ড ও ইটালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নিরপেক্ষ থাকা, বেলজিয়ামের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব না দেওয়া, স্পেনের রানি ইসাবেলার বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ না করা প্রভৃতি একাধিক সিদ্ধান্ত তাঁর জনপ্রিয়তা নষ্ট করে।
বুর্জোয়াদের আধিপত্য : তাঁর আমলে দেশে বুর্জোয়াদেরই স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। বুর্জোয়াদের স্বার্থের কথা ভাবতে গিয়ে তিনি দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েন। ফলে নাগরিক রাজা হিসেবে যে জনপ্রিয়তা তিনি লাভ করেছিলেন তা ক্রমেই হারিয়ে যায়।
প্রত্যক্ষ কারণ : লুই ফিলিপের রাজত্বে ফরাসি জনগণ যখন হতাশাগ্রস্ত, তখন থিয়ার্স, লা-মার্টিন প্রমুখ উদারপন্থী নেতারা ভোটাধিকার সম্প্রসারণের ও আইনসভার নির্বাচনে দুর্নীতি বন্ধের দাবি জানায়। লুই ফিলিপ ও তাঁর প্রতিক্রিয়াশীল প্রধানমন্ত্রী গিজো এই দাবি মানতে অস্বীকার করলে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে এক জনসভার আয়োজন করা হয়। কিন্তু পুলিশ গুলি চালিয়ে এই জনসভা ভেঙে দিলে আন্দোলন সশস্ত্র রূপ নেয়। শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের চাপে লুই ফিলিপ পদত্যাগ করলে ফ্রান্সে জুলাই রাজতন্ত্রের পতন ঘটে।
ফলাফল :
ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা : ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায়ে উদারপন্থীরা ফ্রান্সকে প্রজাতন্ত্ররূপে ঘোষণা করে। এইভাবে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে।
জনসাধারণের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা : ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ধনী বুর্জোয়াদের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় জনসাধারণের প্রাধান্য।
সর্বজনীন ভোটাধিকারের স্বীকৃতি : ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি স্বীকৃত হয় এবং এর ভিত্তিতেই আইনসভার সদস্যদের নির্বাচিত করার প্রস্তাব গৃহীত হয় ৷
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে লুই নেপোলিয়ন তৃতীয় নেপোলিয়ন নামধারণ করে নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট ঘোষণা করেন ও দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
সর্বোপরি ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর ফ্রান্সের প্রজাতান্ত্রিক সরকার দাসব্যবস্থার উচ্ছেদসাধন করে। এর ফলে বহু মানুষ স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করার সুযোগ পায় ।
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবের অগ্নিশিখা ফ্রান্সের সীমা অতিক্রম করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে প্রভাবিত করেছিল।
অস্ট্রিয়া: ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা, হাঙ্গেরি প্রভৃতি স্থানে গণ আন্দোলন শুরু হয়। ফলে মেটারনিখতন্ত্রের পতন ঘটে।
জার্মানি : জার্মানির ব্যাভেরিয়া, হ্যানোভার, স্যাক্সনি, প্রাশিয়া প্রভৃতি রাজ্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চাপে মেটারনিখের রক্ষণশীল নীতির পরিবর্তন ঘটে।
হাঙ্গেরি : ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সূত্র ধরে হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট অঞ্চলের অধিবাসীরা অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে মুক্তি আন্দোলনে লিপ্ত হয়। আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত অস্ট্রিয়ার সম্রাট হাঙ্গেরিয়ানদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন।
ইটালি : ইটালির বিভিন্ন রাজ্য, যেমন— সিসিলি, নেপলস, রোম, ভেনিস, টাসকানি প্রভৃতি অঞ্চলে গণবিদ্রোহ দেখা দেয়। আন্দোলনের ফলে ভেনিস ও রোমে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বোপরি ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বোহেমিয়ায় চেক ও শাভগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করে চেকোশ্লোভাকিয়া রাষ্ট্র গঠন করে।
(iii) ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। রুশ বিপ্লব ছিল জনগণের দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের প্রকাশ। ঐতিহাসিক লিপসন (Lipson) বলেছেন যে, রুশ বিপ্লবের কারণ রাশিয়ার ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এই বিপ্লবের জন্য রাশিয়ার দীর্ঘদিনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অন্যায়-অবিচার দায়ী ছিল।
সামাজিক পটভূমি :
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়ার সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়।
শ্রেণিবিভক্ত সমাজ : রাশিয়ার সমাজব্যবস্থা মূলত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল o অভিজাত ও ♚ কৃষক-শ্রমিক শ্রেণি। এছাড়াও ছিল মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়।
অভিজাত : রুশ সমাজে অভিজাতরা ছিলেন সংখ্যায় মুষ্টিমেয়। কিন্তু তারা জার সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট ছিলেন বলে দেশের শাসনব্যবস্থায় তারা ছিলেন প্রধান স্তম্ভ। দেশের বেশিরভাগ জমিরও মালিক ছিলেন তারা।
কৃষক ও শ্রমিক : রুশ সমাজে কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণি ছিল জনসংখ্যার বেশিরভাগ অংশ। ভূমিদাস মুক্তির আইন অনুসারে ভূমিদাসরা কৃষকের মর্যাদা পেয়েছিল। আবার কৃষকেরা জমি বিক্রি করে অনেকে ভূমিদাসের পর্যায়ে নেমে যায়। এদের অবস্থা দুর্বিষহ ছিল, সারা বছর তারা খেতে পেত না।
মধ্যবিত্ত : রুশ সমাজে মধ্যবিত্ত লোক ছিল প্রায় নগণ্য। সমাজে এদের ভূমিকা ছিল না বললেই চলে।
সমাজে মদ্যপানের কু-অভ্যাস : দরিদ্র ও অশিক্ষিত কৃষক ও শ্রমিকরা নানারকম কু-অভ্যাসের শিকার হয়েছিল। তারা ‘ভদকা’ (Vodka) নামে এক ধরনের মদ পান করত।
শিক্ষার অভাব : জার আমলে রাশিয়ায় তেমন শিক্ষার প্রসার ঘটেনি। কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের বেশিরভাগই ছিল নিরক্ষর। রুশ সরকারও শিক্ষাবিস্তারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও সামন্ততান্ত্রিক শোষণে জর্জরিত আধা- মধ্যযুগীয় রাশিয়ার সমাজ ছিল গতিহীন ও পশ্চাৎপদ। এই দুরবস্থা রুশ বিপ্লবের সামাজিক পটভূমি রচনা করেছিল।
নতুন অর্থনৈতিক নীতি (NEP)
১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী সময় লেনিন রাশিয়ার উৎপাদন ব্যবস্থায় উগ্র সাম্যবাদ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে মার্কসবাদের বাস্তবানুগ প্রয়োগের কথা বলেন। লেনিন এই ব্যবস্থা কার্যকর করবার জন্য ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের পার্টি কংগ্রেসে এক নতুন ধরনের অর্থনীতি গ্রহণের কথা বলেন যা নব অর্থনীতি পরিকল্পনা বা New Economic Policy সংক্ষেপে NEP নামে খ্যাত। লেনিনের এই নব অর্থনীতিতে বলা হয় – (1) কৃষকদের উদ্বৃত্ত ফসল কেড়ে নেওয়া হবে না। (2) রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বাধীন জমিতে কৃষকদের মালিকানা থাকবে। (3)8i বৈদেশিক বাণিজ্য সরকারের হাতে এবং অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ব্যক্তিগত হাতে থাকবে। (4) ছোটো ও মাঝারি শিল্পগুলিতে ব্যক্তি মালিকানা বজায় থাকবে।
লেনিনের এই নতুন নীতি প্রয়োগের ফলে রাশিয়ায় ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রীয় মালিকানার এক আশ্চর্য সমন্বয় ঘটে। এভাবে লেনিন বাস্তবের কথা মাথায় রেখে বিশুদ্ধ মার্কসবাদ থেকে সরে এসে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি মালিকানাকেও স্বীকৃতি দেন, যা নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নামে খ্যাত। তাঁর এই নীতির ফলে রাশিয়া বিপর্যয় থেকে মুক্তি পায় এবং রুশ অর্থনীতির ভিত সুদৃঢ় হয়।