মানবজীবনে পরিবেশের প্রভাব প্রবন্ধ রচনা
'চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ- শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।'
-সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবজীবনে পরিবেশের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই পরিবেশেই মানুষের বেড়ে ওঠা, বিকাশ, সমৃদ্ধি। জন্মের উষালগ্ন থেকেই পরিবেশের সঙ্গে চলে তার অভিযোজন। পরিবেশের লালন-পালন, আদর-যত্নে, প্রেম ও ভালোবাসায় একটি শিশু পরিণত হয় পরিপূর্ণ এক মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষে। পরিবেশ তাই মানুষের দ্বিতীয় জননী।
পরিবেশ বলতে পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে বোঝায়। আমাদের চারপাশে আমরা যা কিছু দেখি, যার দ্বারা প্রভাবিত হই তাই পরিবেশ। আমাদের ঘরবাড়ি, গাছপালা, জলবায়ু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, কলকারখানা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সকল সমন্বয়ে যে ভৌগোলিক ও সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি হয় তাই-ই পরিবেশ। জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, সাফল্য, নৈরাশ্য, উৎসাহ, উদ্দীপনা সবকিছুই পরিবেশের দান। তবে মানুষের জীবনে প্রাকৃতিক পরিবেশের অবদান অপরিসীম। প্রকৃতির মধ্যেই মানুষের বেড়ে ওঠা। প্রকৃতির কাছ থেকে আমরা যেমন বেঁচে থাকার রসদ পাই তেমনই প্রকৃতিকেই আমাদের মানসিক গঠনের বড়ো শিক্ষক বলে মনে করি। মনে পড়ে সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’ কবিতাটি। ‘আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদার হতে ভাইরে’ কিন্তু বড়ো কষ্টের, বর্তমান নগর সভ্যতার আগ্রাসনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
মানুষের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সমাজজীবনের প্রভাব অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। একটি সুস্থ সমাজ, সুস্থ মানবিক গুণসম্পন্ন, নৈতিক চরিত্র, আদর্শের স্বচ্ছ ধারণা দেয়। সামাজিক পরিবেশের প্রাথমিক পর্যায় হল পরিবার। একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার প্রাথমিক বিকাশ ঘটে পরিবারে। বাবা-মা তার প্রাথমিক শিক্ষক। এরপর বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিনতে থাকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের। পরিবারের সদস্যদের ভালো আচরণ যেমন শিশুরা অনুসরণ করে তেমনই বড়োদের অশালীন অভব্য আচরণও তারা অনুকরণ করে। তাই শিশুদের মানসিক গঠনের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বাড়ির পরিবেশের গন্ডি পেরিয়ে শিশু প্রবেশ করে বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয় তার কাছে দ্বিতীয় গৃহ। বিদ্যালয়ে এসে সে পরিচিত হয় শিক্ষক-শিক্ষিকা, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে। ভালো-মন্দ অনেক কিছু শেখার থাকে সেখান থেকে। মানসিক চরিত্র গঠনে বিদ্যালয় নিঃসন্দেহে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পরিবেশ থেকেই ছাত্রছাত্রীরা শ্রদ্ধা, ভক্তি, অধ্যবসায়, শৃঙ্খলাবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, সততা, সর্বোপরি দেশাত্ববোধ প্রভৃতি গুণাবলির শিক্ষা লাভ করে। তাই বিদ্যালয়ের পরিবেশ যথার্থ হলে শিশু একটি আদর্শ মানুষে পরিণত হতে পারে।
শিক্ষালাভের পর সেই শিশুটি প্রবেশ করে বৃহত্তর সমাজজীবনে। এখানেই ঘটে তার সামগ্রিক বিকাশ। সামাজিক মূল্যবোধ, ন্যায়নীতির শিক্ষা হয় সামাজিক পরিবেশ থেকে। পারিপার্শ্বিক সামাজিক পরিবেশ যতটা উন্নত হবে জনগণ ততটাই উন্নত ধরনের চিন্তাধারার অধিকারী হবে।
সংস্কৃতি ও কৃষ্টি জাতির পরিচায়ক। মানবজীবনে সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। মানুষের মনের ক্ষুধা মেটায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-কবিতা, নাচ, গান, নাটক প্রভৃতির মাধ্যমে। সাংস্কৃতিক পরিবেশ ঠিক থাকলে মানুষের মধ্যে সহানুভূতি, মৈত্রীবোধ, সহিষ্ণুতা প্রভৃতি চেতনা বোধ জাগে। সাংস্কৃতিক পরিবেশ হল জাতীর সর্বাঙ্গীণ উন্নতির সোপান। পরিবেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব জনগণের। আমরা যদি পরিবেশকে কলুষিত করি তবে পরিবেশ কিন্তু ঠিক তার প্রতিশোধ নেবে। তাই দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, বিবেকবান মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য। মানুষের মধ্যে এই বিষয়ে সচেতনতা না বাড়লে আমাদের অস্তিত্বের সংকটে পড়তে হবে। উন্নত ও নির্মল পরিবেশ চরিত্রবান ও আদর্শ মানুষ গড়ে তোলে।
আরও পড়ুন – প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রবন্ধ রচনা