মন্তব্যের উৎস
প্রবন্ধকার সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ‘পঁচিশে বৈশাখ’ প্রবন্যে রবীন্দ্রনাথের সকল প্রকার সাহিত্যকর্মে শ্রেষ্ঠত্ব লাভের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সবার প্রথমেই তাঁর ‘উত্তম উপন্যাস’ লেখার কথা বলেন।
যুক্তি
রবীন্দ্রনাথ কখনও কবিতা, কখনও নাটক, গান, কখন ও ছোটোগল্প রচনা আবার কখনও চিত্রাঙ্কনের প্রতিও ঝোঁক দেখিয়েছেন। কিন্তু, কার্যত আজীবন তিনি কোনো-না-কোনো উপন্যাস রচনায় নিবৃত্ত থেকেছেন। তাঁর উপন্যাস রচনার সূত্রপাত মাত্র ১৬ বছর বয়সে। ১৮৭৭ সালে ‘করুণা’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। যদিও সেটি কখনও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। ১৮৭৭ থেকে ৭৮ সাল পর্যন্ত ‘ভারতী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটি এবং অসমাপ্ত অবস্থাতেই সেটি বন্ধ হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম সার্থক উপন্যাস হল- ‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’ ১৮৮৩ সালে রচিত একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস।
১৮৮৭ সালে রচিত ‘বালক’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসটিও একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস, যা থেকে পরবর্তীকালে ‘বিসর্জন’ নাটকটি রচিত হয়, এই উপন্যাসটি একটি শিল্পগুণান্বিত রচনা।
১৯০৩ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটি ‘নবপর্যায় বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এটি একটি পারিবারিক ও সামাজিক উপন্যাস। গঠনরীতির দিক দিয়ে উপন্যাসটি দ্বন্দ্বমূলক। মহেন্দ্র, আশালতা, বিহারী ও বিনোদিনী-র জীবন নিয়ে রচিত এই উপন্যাসটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে।
১৯০৬ সালে প্রকাশিত ‘নৌকাডুবি’ও রবীন্দ্রনাথের একটি পারিবারিক ও সামাজিক উপন্যাস। ১৯১০ সালে রচিত ‘গোরা’ উপন্যাসে স্বদেশ চেতনার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছে। ‘চতুরঙ্গ’ (১৯১৬) তাঁর একটি চেতনাশ্রয়ী উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ জিজ্ঞাসার ভিন্নতর রূপ ফুটে উঠেছে ‘ঘরে-বাইরে’ (১৯১৬) উপন্যাসে। ‘যোগাযোগ’ (১৯২৯) প্রকাশিত হয় ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায়। সমাজ ও পরিবারের প্রকৃত রূপটিই ফুটে ওঠে এই উপন্যাসে। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘শেষের কবিতা’ (১৯২৯) উপন্যাসে কাব্যরস বিদ্যমান, তাই তা কাব্যোপন্যাসৰূপেই ভূষিত হয়েছে। এই উপন্যাসটি আদ্যন্ত একটি রোমান্টিক উপন্যাস।
এ ছাড়াও, রবীন্দ্রনাথ দুটি আখ্যানধর্মী গদ্য রচনা করেন- যেগুলি উপন্যাসের গুণসম্পন্ন হলেও উপন্যাসের মর্যাদা লাভ করতে পারেনি, এগুলি হল ‘দুই বোন’ (১৯৩৩), ‘মালঞ্চ’ (১৯৩৪)। রবীন্দ্রনাথ রচিত শেষ উপন্যাসটি হল, রাজনৈতিক উপন্যাস ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৪)। এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ সশস্ত্র বিপ্লববাদের তীব্র বিরোধিতা করেন এবং উপন্যাসটিকে স্বয়ং তিনিই ‘লিরিকের তোড়া’ আখ্যা দিয়েছেন।
সুতরাং, বিষয়বৈচিত্র্য, ভাষাশৈলী, আখ্যানধর্মিতা, লিরিক, রচনাশৈলী প্রভৃতি সব বিষয়ই রবীন্দ্র উপন্যাসে যেভাবে স্থান করে নিয়েছে; তাতে রবীন্দ্রনাথ যে একজন উত্তম ঔপন্যাসিক ছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। তাই সৈয়দ মুজতবা আলীর এই মন্তব্য সর্বান্তঃকরণে যথাযথ।