ম্যান্ডারিন’ শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ-সহ চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার পরিচয় দাও

ম্যান্ডারিন’ শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ-সহ চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার পরিচয় দাও

অথবা, চিনে ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো

ম্যান্ডারিন' শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ-সহ চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার পরিচয় দাও
ম্যান্ডারিন’ শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ-সহ চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার পরিচয় দাও

চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার পরিচয়

প্রাচীন কালে চিনে সম্রাট এবং গ্রাম বা শহরের শাসনব্যবস্থায় আঞ্চলিক শাসকদের মধ্যবর্তী স্থানে এক ধরনের সরকারি কর্মচারী শ্রেণির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হত। এরা ম্যান্ডারিন নামে পরিচিত হতেন। চৌ বংশের (খ্রিস্টপূর্ব ১১২২-২৫৫ অব্দ) রাজাদের আমলে চিনে ম্যান্ডারিনদের নিয়োগের প্রথাটি গড়ে উঠেছিল। মাঞ্জু রাজবংশের (১৬৪৪-১৯১১/১৯১২ খ্রিস্টাব্দ) শাসনকালে প্রদেশ থেকে জেলাস্তর পর্যন্ত প্রশাসনিক বিভাগগুলিতে এই ম্যান্ডারিন নামক আমলাতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী প্রশাসনিক ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল।

ম্যান্ডারিন শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ

ম্যান্ডারিন হল বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পণ্ডিত। ইংরেজি ম্যান্ডারিন (Mandarin) শব্দটি এসেছে পোর্তুগিজ ম্যান্ডারিম (Mandarim) শব্দটি থেকে। এই শব্দটি পোর্তুগিজরা মালয়ীদের (মালয়েশিয়ার অধিবাসী) কাছ থেকে গ্রহণ করেছিল বলে অনেকে মনে করেন। তাছাড়া এটাও মনে করা হয় যে, মন্ত্রিণ শব্দ থেকে মালয়ীরা এই শব্দটি গ্রহণ করেছিল। বিশিষ্ট মালয়েশিয়ান অধ্যাপক উংকু আবদুল আজিজ (Ungku Abdul Aziz)-এর মতানুসারে, মালাক্কায় বসবাসকারী পোর্তুগিজগণ চিনের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সঙ্গে দেখা করার সময় তাদের মেন্তেরিন (Menterin) বলে অভিহিত করত।

ম্যান্ডারিনদের যোগ্যতা

চিনের প্রতিভাধর ও সুদক্ষ কর্মচারী অর্থাৎ ম্যান্ডারিনদের বিশেষ কিছু যোগ্যতা থাকতে হত। যেমন-

(a) শিক্ষাগত যোগ্যতা: ম্যান্ডারিন হতে গেলে কনফুসীয় আদর্শ সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের পাশাপাশি সাহিত্য, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান থাকা ছিল আবশ্যিক।

(b) প্রশাসনিক দক্ষতা: ম্যান্ডারিনদের প্রশাসনিক কাজে দক্ষ হতে হত। কারণ- তাদের দক্ষতার উপরেই নির্ভর করত সরকারের স্থায়িত্ব ও খ্যাতি।

(c) চিনা ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা: ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীদের চিনের অতীত ঐতিহ্য সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান থাকতে হত। তারা চিনা ঐতিহ্যের বিভিন্ন বিষয়ে পণ্ডিত হতেন।

(d) রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা: ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীর অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতাকে প্রাধান্য দেওয়া হত।

ম্যান্ডারিনদের নির্বাচন ও নিয়োগ

শিক্ষিত ও চরিত্রবান ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে ম্যান্ডারিন নির্বাচন করা হত। প্রথমদিকে চিনা সম্রাটদের আত্মীয়-পরিচিতরা রাজকর্মচারী পদে নিযুক্ত হতেন। পরবর্তী পর্যায়ে কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার সূচনা হয়। পরীক্ষার্থীদের কনফুসীয় নীতিধর্মের আদর্শ সম্পর্কিত জ্ঞান যাচাইয়ের পাশাপাশি রাজা-প্রজার সম্বন্ধ, সামাজিক ও পারিবারিক সদাচার, চিরাচরিত ধর্মানুষ্ঠান বিষয়ে জ্ঞান ও রাজকার্য সম্পাদনের দক্ষতাও নিরূপণ করা হত। পরিশেষে পরীক্ষায় উপযুক্ত গুণসম্পন্ন প্রার্থীদের তাদের গুণগতমান অনুযায়ী কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক বা স্থানীয় অঞ্চলে নিয়োগ করা হত।

ম্যান্ডারিনদের পদমর্যাদার স্তর ও পোশাক-পরিচ্ছদ

চিনের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পদমর্যাদা অনুসারে ম্যান্ডারিনদের দুটি স্তর ছিল। যথা-

(a) উচ্চপদস্থ ম্যান্ডারিন : চিনের সম্রাটের প্রধানমন্ত্রীর সমগোত্রীয়রা ছিলেন সর্বোচ্চ স্তরের ম্যান্ডারিন। বিভিন্ন প্রদেশের শাসক ও গভর্নর পদেও ম্যান্ডারিনরা নিযুক্ত হতেন।

(b) সাধারণ ম্যান্ডারিন : পরবর্তী পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন স্তরে ম্যান্ডারিনগণ নিযুক্ত হতেন। তারা উচ্চপদস্থ ম্যান্ডারিনদের অধীনে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতেন।

অন্যদিকে ম্যান্ডারিনদের পোশাক- পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, তারা গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা কোটজাতীয় পোশাক পরিধান করতেন, যা সম্ভবত সিল্ক দিয়ে তৈরি হত। তারা বহু মূল্যবান অলংকার সংবলিত পোশাক পরতেন। উচ্চপদস্থ ম্যান্ডারিনগণ পদ্মরাগমণিযুক্ত টুপি পরতেন। একেবারে সাধারণ ও নিম্নশ্রেণিভুক্ত ম্যান্ডারিনরা সোনা, রুপো, প্রবাল প্রভৃতি দ্বারা নির্মিত টুপি ব্যবহার করতেন।*

ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার বিভিন্ন বিভাগ

চৌ লি (Zhou Li) নামক গ্রন্থ অনুযায়ী, চৌ রাজাদের আমলে সমগ্র প্রশাসনিক ক্ষেত্র ছয়টি ম্যান্ডারিন বা পণ্ডিত পরিচালিত বিভাগ বা বোর্ড-এ বিভক্ত ছিল। যথা- (i) স্বর্গ বিভাগ : সম্রাটের খাদ্য, পোশাক-সহ প্রশাসনের তত্ত্বাবধান করত। (ii) পৃথিবী বিভাগ: জনকল্যাণমূলক কাজকর্ম পরিচালনা করত। (iii) বসন্ত বিভাগ: ধর্মানুষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করত। বিভিন্ন (iv) গ্রীষ্ম বিভাগ: প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধ বিষয়ক দায়িত্ব পালন করত। (v) শরৎ বিভাগ: ন্যায়বিচার ও দণ্ডবিধান করত। (vi) শীত বিভাগ: যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিসাধন করত।

ম্যান্ডারিনদের পদচ্যুতি

ম্যান্ডারিনদের দীর্ঘকাল একই স্থানে না রেখে অন্যত্র বদলিও করা হত। তাছাড়া সম্রাটের বিরাগভাজন হলে বা কর্তব্যকর্মে অবহেলা করলে অথবা নীতিবিরুদ্ধ কোনও কাজে লিপ্ত হলে সম্রাট ম্যান্ডারিনদের পদচ্যুত করার অধিকারী ছিলেন।

ম্যান্ডারিনদের কার্যাবলি

চিনের কেন্দ্রীয় সরকারের মুখ্য সচিবালয়ের অধীনে থাকা ম্যান্ডারিনদের নানা দায়িত্ব পালন করতে হত। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার আয়োজন, বাণিজ্যিক শুল্ক ও অন্যান্য কর আদায়ের মতো যাবতীয় প্রশাসনিক দায়িত্ব তারা পালন করতেন। পাশাপাশি রাজাকে বিভিন্ন কাজে সহায়তা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করতেন তারা। ম্যান্ডারিনরা কেন্দ্রীয় শাসক ও আঞ্চলিক প্রশাসনের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করতেন। এ ছাড়া প্রদেশ বা স্থানীয় এলাকার শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য তদারকি, বৈদেশিক সম্পর্ক ইত্যাদি কাজেও যুক্ত থাকতেন ম্যান্ডারিনরা।

ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার অবসান

চিনে বিভিন্ন রাজবংশ ও সাম্রাজ্যের উত্থানপতন ঘটলেও সুশিক্ষিত ও পণ্ডিত রাজকর্মচারী, অর্থাৎ ম্যান্ডারিনদের নিয়ে গঠিত আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব টিকেছিল সুদীর্ঘকাল ধরে। ক্রমশ এই ব্যবস্থা অবসানের পথে এগিয়ে যায়। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে পাশ্চাত্য শিক্ষাধারার চাপে ম্যান্ডারিনদের নিয়োগ সংক্রান্ত পরীক্ষার বিলুপ্তি ঘটে। অতঃপর ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে চিনে মাঞ্জু রাজবংশের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ম্যান্ডারিন ব্যবস্থারও অবসান ঘটে ও গড়ে ওঠে আধুনিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা।

আরও পড়ুন – গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো

Leave a Comment