ফরাসি চিন্তাবিদ জ্যাঁ বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে আলোচনা করো

ফরাসি চিন্তাবিদ জ্যাঁ বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে আলোচনা করো

ফরাসি চিন্তাবিদ জ্যাঁ বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে আলোচনা করো
ফরাসি চিন্তাবিদ জ্যাঁ বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে আলোচনা করো

ভূমিকা

ষোড়শ শতকের ফ্রান্স তথা ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হলেন জ্যাঁ বোঁদা (১৫৩০-১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দ)। ফ্রান্সের অ্যাঙ্গরস নামক স্থানে এক সাধারণ দরিদ্র পরিবারে তাঁর জন্ম। তিনি ছিলেন একাধারে ফ্রান্সের প্রখ্যাত দার্শনিক, আইনবিদ এবং রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। ঐতিহাসিক অ্যালেন বলেছেন- “বোঁদা ছিলেন ষোড়শ শতকের ফরাসি এবং সমকালীন সকল রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মধ্যে সম্ভবত  সবচেয়ে প্রভাবশালী।” তিনি অ্যারিস্টট্লের রাষ্ট্রতত্ত্বের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

রচিত গ্রন্থ

জ্যাঁ বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে বিখ্যাত এবং সর্বাধিক আলোচিত দুটি গ্রন্থ হল-‘মেথড ফর দ্য ইজি কম্প্রিহেনশন অফ হিস্ট্রি’ এবং ‘সিক্স বুকস অফ দ্য কমনওয়েলথ’। প্রথম গ্রন্থে তিনি ইতিহাসের বিভিন্ন দিক ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করেছেন। আর দ্বিতীয় গ্রন্থে তিনি মূলত রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে নানা ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন দিক

(1) রাষ্ট্রের সংজ্ঞা ও উৎপত্তি: জ্যাঁ বোঁদা রাষ্ট্রের সংজ্ঞা ও উৎপত্তি বিষয়ে অনেকাংশেই অ্যারিস্টট্লের মতকে সমর্থন করেছেন। রাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যের মূলকথা হল, রাষ্ট্র হল বিভিন্ন পরিবারের সমষ্টি, যা কিনা সার্বভৌম শক্তির দ্বারা শাসিত এবং শক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ রাষ্ট্র হল পরিবারের সম্মিলিত রূপ। পরিবার বৃদ্ধি বা সম্প্রসারিত হয়েই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। তবে অ্যারিস্টরে মতে, ব্যক্তির সুখসমৃদ্ধিকে তিনি রাষ্ট্রের অপরিহার্য লক্ষ্য বলে মনে করেননি। রাষ্ট্রের উৎপত্তির ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের বিশেষ ভূমিকা ছিল বলে তিনি মনে করেন।

(2) রাষ্ট্র ও সরকার: জ্যাঁ বোঁদা রাষ্ট্র ও সরকারকে মূলত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন, যথা-রাজতান্ত্রিক, অভিজাততান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক। তিনি ছিলেন অবশ্য রাজতন্ত্রের সমর্থক। বহু শ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত মিশ্র রাষ্ট্রকে তিনি নৈরাজ্যের নামান্তর বলেছেন। তবে তিনি মনে করতেন রাষ্ট্র এবং সরকার কখনোই এক নয়। সাত

(3) সার্বভৌমিকতা : রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে জ্যাঁ বোঁদার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা। সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “সার্বভৌমত্ব হল { নাগরিক ও প্রজাদের ওপর আইনের দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা” (Sovereignty is the supreme power of the state over citizens and subjects unrestrained by laws)। বোঁদার মতে, “রাষ্ট্রই একমাত্র চরম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী”। এই ক্ষমতাবলে রাষ্ট্র তার অধীনস্থ সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর চরম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

(4) নাগরিকতা: বোঁদা সংকীর্ণ অর্থে নাগরিকতাকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, “নাগরিক হল সেই সকল স্বাধীন মানুষ, যারা একটি সার্বভৌম ক্ষমতার দ্বারা নিয়ন্ত্রণাধীন।” তিনি রাষ্ট্রের সকল জনগণ বা অধিবাসীকে নাগরিক বলে গণ্য করার বিরোধী ছিলেন। পরিবারের প্রধান ব্যক্তিকেই তিনি কেবলমাত্র নাগরিক বলে গণ্য করেন। ক্রীতদাসদের তিনি নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেননি।

(5) রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও কার্যাবলি: জ্যাঁ বোঁদা ফ্রান্সে ক্যাথোলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ভয়াবহ ধর্মযুদ্ধকে সামনে থেকে দেখেছেন। তাই তিনি রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ ছাড়াও তিনি জনকল্যাণকে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাঁর মতে, “রাষ্ট্রকে হতে হবে জনকল্যাণকামী।”

(6) বিপ্লবতত্ত্ব: বোঁদার রাষ্ট্রতত্ত্বের একটি মৌলিক চিন্তাধারা হল ‘বিপ্লবতত্ত্ব’। তাঁর মতে, ঐশ্বরিক, প্রাকৃতিক ও মানবিক কারণে রাষ্ট্রের অবক্ষয় ঘটে। রাষ্ট্রের অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের পরিবর্তনের পাশাপাশি সার্বভৌম ক্ষমতাও হস্তান্তরিত হয়। রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার এই হস্তান্তরকেই তিনি বিপ্লব বলেছেন।

(7) সীমাবদ্ধতা: বোঁদার রাষ্ট্র সংক্রান্ত তত্ত্বে বেশ কিছু ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়। যথা- (i) রাষ্ট্র সম্পর্কিত বোঁদার মতবাদ সুস্পষ্ট নয়। স্যাবাইনের মতে, “রাষ্ট্র সম্পর্কিত বোঁদার চিন্তাধারা অবিন্যস্ত”। (ii) বোঁদার রাষ্ট্রতত্ত্বে ব্যক্তি ও তার অধিকারকে উপেক্ষা করা হয়েছে। (iii) তিনি সার্বভৌম ক্ষমতাকে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ও অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে আবার ব্যক্তির সম্পত্তির ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের তিনি বিরোধী ছিলেন। (iv) তাঁর রাষ্ট্রদর্শন প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিল না। (v) বিপ্লব সম্পর্কেও তাঁর ধারণা ছিল অত্যন্ত অস্পষ্ট।

মূল্যায়ন

নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আধুনিক পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে জ্যাঁ বোঁদার অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। তিনি ছিলেন আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বের অন্যতম পথপ্রদর্শক। আধুনিক সার্বভৌমত্ব তত্ত্বের ভিত্তি তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন। ম্যাক্সি বলেছেন, “বোঁদাই সর্বপ্রথম সার্বভৌমিকতার স্পষ্ট সংজ্ঞা দিয়েছেন।” তাই ঐতিহাসিক মুরে সহ অনেকেই তাঁকে সার্বভৌমত্ব ধারণার জনক বলে অভিহিত করেছেন। রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর অন্যান্য অবদানগুলি হল, রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভিত্তিস্থাপন ইত্যাদি।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment