ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের কারণগুলি আলোচনা করো

ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের কারণগুলি আলোচনা করো

অথবা, ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের জন্য কি একমাত্র ধর্মই দায়ী ছিল

ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের কারণগুলি আলোচনা করো
ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের কারণগুলি আলোচনা করো

ভূমিকা

খ্রিস্টানরা তাদের পবিত্রভূমি জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের জন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রায় দুশো বছর ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতক ব্যাপী এই যুদ্ধ ইতিহাসে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে পরিচিত। এইসকল ধর্মযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মগুরু পোপ। ইউরোপের বিভিন্ন রাজা, সামন্তবৃন্দ এবং পবিত্র রোমান সম্রাট এই ধর্মযুদ্ধে অংশ নেন।

ধর্মযুদ্ধের কারণসমূহ

ঐতিহাসিকদের মতে, ধর্মযুদ্ধের (crusade) প্রধান কারণ ছিল বিধর্মী মুসলমানদের হাত থেকে খ্রিস্টানদের পবিত্রভূমি ও তীর্থস্থান জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করা। তবে কেবলমাত্র ধর্মীয় কারণ নয়, দীর্ঘস্থায়ী এই ধর্মযুদ্ধের পশ্চাতে আর্থিক, সামাজিক প্রভৃতি নানাকারণ সক্রিয় ছিল।

(1) ধর্মীয় কারণ: নানাবিধ ধর্মীয় আবেগ ক্রুসেডের জন্য দায়ী ছিল। (i) মহান যিশুর জন্মস্থান হিসেবে জেরুজালেম ছিল খ্রিস্টানদের কাছে তীর্থস্থানস্বরূপ। অন্যদিকে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মহম্মদ জেরুজালেমে মিরাজ যাত্রা করেছিলেন। তাই এটি মুসলমানদের কাছেও ছিল পবিত্রভূমি। খলিফা ওমরের আমলে জেরুজালেম মুসলমানদের অধিকৃত হলে খ্রিস্টান জগতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। খ্রিস্টান সমাজ তাদের পবিত্রভূমি পুনরুদ্ধারের দাবিতে সোচ্চার হয়। (ii) তবে একাদশ শতকে সেলজুক তুর্কিদের উত্থান ধর্মযুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে। প্রাথমিকভাবে আরবীয় মুসলমানরা খ্রিস্টানদের পবিত্রভূমি পরিদর্শনে বাধা দেয়নি। কিন্তু উগ্র সেলজুক তুর্কিরা অকারণে খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের বিব্রত করতে থাকে। তীর্থভ্রমণে বাধাদান, অতিরিক্ত কর আদায় ইত্যাদির ফলে খ্রিস্টানদের জেরুজালেম পরিদর্শন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের চাপে পোপ ধর্মযুদ্ধের ডাক দেন।

(2) অর্থনৈতিক কারণ: ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ধর্মযুদ্ধের ডাক দেওয়া হলেও, এর পশ্চাতে অর্থনৈতিক কারণও সক্রিয় ছিল। (i) রোমান সাম্রাজ্যের অর্থনীতির মূলভিত্তি ছিল ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্য। ইসলামের দ্রুত উত্থান ও প্রসার ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যেও প্রভাব ফেলে। দশম শতকের মধ্যে ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যে খ্রিস্টানদের উৎখাত করে আরব বণিকরা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ফলে ভূমধ্যসাগর কার্যত মুসলমান হ্রদ-এ পরিণত হয়। এই পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য মুসলমানবিরোধী সংগ্রামে খ্রিস্টান বণিকদের সমর্থন ধর্মযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে। অধ্যাপক কে আলি বলেছেন-“ভূমধ্যসাগরে বাণিজ্যিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা ধর্মযুদ্ধের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।” (ii) ইটালির নগররাষ্ট্রগুলি ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করত। এখন মুসলিম কর্তৃত্ব বৃদ্ধি ইটালির নাবিকদের বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে ইটালির বণিকেরা তাদের জাহাজের সম্ভার নিয়ে পোপের দেশে সমবেত হন এবং ধর্মযুদ্ধে পোপের হাত শক্ত করেন।

(3) সামাজিক কারণ : সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির প্রত্যাশাও ক্রুসেডের অন্যতম কারণ ছিল। (ⅰ) পোপ প্রচার করেন যে, ক্রুসেডে অংশ নিলে ভূমিদাসরা সামন্তপ্রভুর নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবে। দরিদ্র শ্রেণির মানুষ নতুন জয় করা দেশগুলিতে বসবাস করে মুখ্য জীবনের আস্বাদ পাবে। (ii) ধর্মযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহিদ হলে প্রতিটি ধর্মযোদ্ধা স্বর্গলাভের পুণ্য অর্জন করবে। এইসকল প্রচার সাধারণ মানুষ ও ভূমিদাসদের ধর্মযুদ্ধে আগ্রহী করে তোলে।

(4) রাজনৈতিক কারণ: ইসলামের আবির্ভাব ও দ্রুত উত্থান রাজনৈতিকভাবে খ্রিস্টানদের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ করেছিল। বিভিন্ন খ্রিস্টান রাজ্য মুসলমানদের হস্তগত হয়েছিল। খ্রিস্টান রাজন্যবর্গ রাজনৈতিকভাবে মুসলমানদের অগ্রগতি রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এমতাবস্থায় পোপ ধর্মযুদ্ধের ডাক দিলে রাজন্যবর্গ তাঁর আহ্বানে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসেন।

মূল্যায়ন

নানা কারণের সমাবেশে ক্রুসেড সংগঠিত হয়েছিল। এইসকল কারণের মধ্যে অন্যতম ছিল ধর্ম। অর্থনীতি ও রাজনীতি ধর্মের হাতে হাত মিলিয়ে ক্রুসেড সংগঠিত করেছিল। পি কে হিট্টির ভাষায়, “চার্চের ক্রস, সৈনিকের তরবারি এবং বণিকের অর্থভাণ্ডার মিলিত হয়ে ক্রুসেডের সূচনা করেছিল।”

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment