সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় বা পতনের কারণগুলি উল্লেখ করো

ভূমিকা
খ্রিস্টীয় নবম থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ও চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছিল। কিন্তু চতুর্দশ শতক থেকেই সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় ও পতনের লক্ষণগুলি ফুটে ওঠে। মরিস ডব, পল সুইজি, হেনরি পিরেন, মাইকেল পোস্তান প্রমুখ ঐতিহাসিকরা সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় ও পতনের কারণগুলি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন।
(1) উৎপাদন পদ্ধতির দুর্বলতা: মরিস ডব সামন্ততন্ত্রের পতনের জন্য উৎপাদন ব্যবস্থার গতিহীনতাকে দায়ী করেছেন। তাঁর মতে, দশম শতক থেকে ইউরোপের জনসংখ্যা যেভাবে বেড়েছিল, ম্যানরগুলিতে উৎপাদন সেভাবে বাড়েনি। এমনকি বহু কৃষক ও ভূমিদাস প্রভুদের অত্যাচার ও অতিরিক্ত করের চাপে ম্যানর ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। ফলে উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হয়, যা সামন্ততন্ত্রের পতনকে ডেকে আনে।
(2) ব্যাবসাবাণিজ্যের উন্নতি: ঐতিহাসিক হেনরি পিরেন, পল সুইজির মতে, একাদশ শতকের শেষ দিকে ইউরোপে ব্যাবসাবাণিজ্যের উন্নতির ফলে নতুন শহর গড়ে উঠতে থাকে। গ্রামের শোষিত ও নির্যাতিত বহু কৃষক ও ভূমিদাস নতুন জীবিকার সন্ধানে গ্রামের ম্যানর ছেড়ে শহরে পালিয়ে আসে। ফলে ম্যানরগুলিতে উৎপাদন ব্যাহত হয়। তা ছাড়া ম্যানরগুলি বাণিজ্যিক পণ্যের চাহিদাও মেটাতে ব্যর্থ হয়। অর্থাৎ ব্যাবসাবাণিজ্যের উন্নতি সামন্ততন্ত্রের পতনকে ত্বরান্বিত করে।
(3) জনসংখ্যা হ্রাস : ঐতিহাসিক পোস্তান, লাদুরী প্রমুখের মতে, চতুর্দশ শতক থেকেই ভয়াবহ প্লেগ, দুর্ভিক্ষ, মহামারির কারণে ইউরোপের জনসংখ্যা ভীষণভাবে হ্রাস পায়। কৃষকের অভাবে কৃষি উৎপাদন ভীষণভাবে ব্যাহত হলে সামন্ততন্ত্রের কৃষি-অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।
(4) কৃষক ও ভূমিদাস বিদ্রোহ: সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষকরা ছিল শোষিতশ্রেণি। করের চাপে তাদের অনেক সময় অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটাতে হত। এর পাশাপাশি প্রভুরা অনেক সময় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনও চালাত। ফলে অনেক সময়ই তারা প্রভুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত। এই বিদ্রোহে শামিল হত বহু কারিগর ও দিনমজুরও।
(5) ভূমিদাস বিদ্রোহ: সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরাধীন ভূমিদাসদের জীবন ছিল সবচেয়ে দুর্বিষহ। প্রভুরা তাদের ওপর শোষণ ও অমানুষিক অত্যাচার চালাত। তাই তারা বাধ্য হয়ে প্রভুর জমি ছেড়ে পালাত, নতুবা বিদ্রোহে শামিল হত। ভূমিদাস বিদ্রোহগুলি ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের ভিতকে আলগা করে দিয়েছিল।
মূল্যায়ন
সবশেষে বলা যায় যে, পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের পতনের জন্য কোনো একটিমাত্র কারণ দায়ী ছিল না। সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার দুর্বলতা, ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসার, নগরের বিকাশ, জনসংখ্যার হ্রাসবৃদ্ধি, কৃষক ও ভূমিদাস বিদ্রোহ প্রভৃতি নানা কারণের সমন্বয়ে ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের পতন ঘটেছিল।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর