চার্বাক জড়বাদ কী? চার্বাক জড়বাদকে কীভাবে খণ্ডন করা হয়

চার্বাক জড়বাদ কী? চার্বাক জড়বাদকে কীভাবে খণ্ডন করা হয়
চার্বাক জড়বাদ কী? চার্বাক জড়বাদকে কীভাবে খণ্ডন করা হয়

চার্বাক জড়বাদ

যে দার্শনিক মতবাদ অনুযায়ী, দাবি করা হয় যে, জড়ই একমাত্র সত্য এবং জগতের সমস্ত কিছুই হল এই জড়ের অভিব্যক্তি, তা-ই জড়বাদ। চার্বাকদের মতবাদকে জড়বাদী বলা হয় এ কারণেই যে, এই সম্প্রদায়ের দার্শনিকরা দাবি করেন, জগতের সমস্ত কিছুই ক্ষিতি, অপ্, তেজ এবং মরুৎ-এই চারটি জড় উপাদানে গঠিত। অজড়াত্মক কোনো কিছুকেই চার্বাকগণ স্বীকার করেন না।

চার্বাক জড়বাদের খন্ডন

চার্বাকগণ তাঁদের জ্ঞানতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে জড়বাদের প্রচার করেন। এই জড়বাদের পিছনে বিভিন্ন রকম যুক্তি-তর্ক থাকলেও এরূপ মতবাদটি কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। যে-সমস্ত কারণে চার্বাকদের মতবাদটি গ্রহণযোগ্য নয়, সেগুলি হল-

[1] অধ্যাত্মবাদের সম্পূর্ণ বিরোধী মতবাদ

চার্বাক জড়বাদের বিরুদ্ধে মূল আপত্তি এই যে, তাঁদের মতবাদ অধ্যাত্মবাদের সম্পূর্ণ বিরোধী এক মতবাদ। তাঁরা এই জগতের সমস্ত কিছুকেই ক্ষিতি, অপ্, তেজ এবং মরুৎ-এই চারটি জড়ভূতের প্রকাশ বলেছেন। কিন্তু এই জড়ভূতের বাইরে থাকা অধ্যাত্ম বিষয়গুলিকেও যে অস্বীকার করা যায় না, তা ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য সম্প্রদায়গুলিতে উল্লেখ আছে। জগৎকে পরিপূর্ণভাবে জানতে ও বুঝতে জড়েরও যেমন প্রয়োজন, তেমনি অধ্যাত্ম বিষয়গুলিরও প্রয়োজন আছে। সুতরাং চার্বাক জড়বাদ হল একটি একপেশে মতবাদ।

[2] স্মৃতির ব্যাখ্যা অচল

চার্বাকদের জড়বাদ অনুসারে স্মৃতির ব্যাখ্যাটি অচল হয়ে পড়ে। স্মৃতির অর্থ হল-পূর্বজ্ঞাত কোনো বিষয়ের পুনরুদ্রেক। কিন্তু এই ব্যাপারটি একমাত্র তখনই সম্ভব হতে পারে, যদি আত্মাকে অপরিবর্তিত ও নিত্যরূপে গণ্য করা হয়। দেহের পরিবর্তন হলেও আত্মাকে যদি অপরিবর্তিত না বলা হয়, তাহলে স্মৃতির ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কিন্তু চার্বাকগণ আত্মার চিরন্তন অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন। অথচ স্মৃতির বিষয়টিকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না-তা প্রমাণিত সত্য।

[3] চেতনার অযৌক্তিক ব্যাখ্যা

শুধুমাত্র জড়ভূতের মাধ্যমে চার্বাকগণ যে চেতনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা একেবারেই অযৌক্তিক। জড় এবং চেতনার বিষয় দুটি যে সম্পূর্ণভাবে বিপরীত, তাতে কোনো সন্দেহই নেই। জড় এবং চেতনার স্বভাবও পরস্পরবিরুদ্ধ। সুতরাং এদের পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট এবং সেকারণেই তারা একসঙ্গে থাকতে পারে না। মৃতদেহে কি কোনো চৈতন্য থাকে? সুতরাং চেতনা হল দেহের অতিরিক্ত কোনো এক সত্তার ধর্ম-যা আত্মারূপে গণ্য। দেহের অতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্ব তাই প্রমাণিত।

[4] অন্যান্য প্রমাণগুলিকে অস্বীকার করার অযৌক্তিকতা

চার্বাকগণ শুধুমাত্র প্রত্যক্ষকেই প্রমাণ রূপে গণ্য করেছেন। প্রত্যক্ষ ছাড়া অনুমান, উপমান এবং শব্দ প্রভৃতিকে তাঁরা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু অনুমান প্রভৃতিকে প্রমাণরূপে গণ্য না করলে আমাদের জ্ঞানের অগ্রগতির দ্বার রুদ্ধ হয়ে পড়ে। কারণ, আধুনিক বিজ্ঞান থেকে শুরু করে সমস্ত প্রকার আলোচনাই মূলত অনুমানেরওপর নির্ভর করে এগিয়ে চলেছে। সুতরাং অনুমান প্রভৃতিকে অস্বীকার করার অর্থই হল জ্ঞানের প্রসারণের পরিবর্তে তাকে সংকুচিত করা। সুতরাং, অনুমান প্রভৃতিকে অস্বীকার করার পক্ষে কোনো যুক্তিই নেই। এ হল একটি সংকীর্ণ ও অসার দৃষ্টিভঙ্গি মাত্র।

[5] চার্বাক উপসম্প্রদায়গুলির পারস্পরিক বিরোধিতার ফলে এই মতবাদের অনিশ্চয়তা

চার্বাকদের মধ্যে বিভিন্ন উপসম্প্রদায় দেখা যায়। সেগুলির মতবাদ অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পরবিরুদ্ধ। প্রমাণ হিসেবে প্রত্যক্ষ সম্বন্ধে ধূর্ত সম্প্রদায় যা বলে, সুশিক্ষিত চার্বাক সম্প্রদায় তা বলে না। ধূর্তরা বলেন, প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। কিন্তু সুশিক্ষিত চার্বাকগণ বলেন, প্রত্যক্ষ ছাড়াও অন্য প্রমাণ থাকতে পারে। সুতরাং চার্বাকদের মতবাদের কোনো নিশ্চয়তাই নেই।

Leave a Comment