ভৌগোলিক অভিযানে স্পেনের ভূমিকা আলোচনা করো

ভূমিকা
পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে ভৌগোলিক আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত দেশগুলির মধ্যে অগ্রগণ্য ছিল স্পেন। কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের পর তুর্কিদের দ্বারা প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বাণিজ্যের ভূমধ্যসাগরীয় পথ অবরুদ্ধ হয়। ফলে ইউরোপের বেশ কিছু দেশের বণিক ও নাবিকরা বিকল্প পথের সন্ধান করা শুরু করেন। এ কাজে সর্বাপেক্ষা উদ্যোগী ছিল স্পেন ও পোর্তুগাল। যদিও এটিই সমুদ্র অভিযান তথা ভৌগোলিক আবিষ্কারের একমাত্র কারণ নয়। ইউরোপীয় রাজাদের রাজনৈতিক সম্প্রসারণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, খ্রিস্টান ধর্মপ্রচার ইত্যাদিও কারণ হিসেবে কাজ করেছিল। এই ভৌগোলিক অভিযান স্পেনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল পোর্তুগাল। ফলে উভয়দেশের মধ্যে সমুদ্র অভিযান নিয়ে তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়।
(1) বিরোধের নিষ্পত্তি: স্পেন ও পোর্তুগালের সমুদ্র অভিযান নিয়ে বিরোধের নিষ্পত্তি করার জন্য পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে একটি ‘বুল’ বা নির্দেশনামা জারি করে উভয়দেশের মধ্যে অভিযানের এলাকা নির্দেশ করে দেন। কিন্তু এই নিষ্পত্তিও স্থায়ী হয়নি। ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে এই দুটি দেশের মধ্যে টর্ভেসিল্লাস-এর চুক্তি (Treaty of Tordisillas) স্বাক্ষরিত হয় যার দ্বারা আটলান্টিক মহাসাগরের পূর্ব দিক পোর্তুগালের এবং পশ্চিম দিক স্পেনের অভিযানের এলাকা বলে স্থির হয়।
(2) কলম্বাসের অভিযান: জন্মসূত্রে ইতালীয় হলেও সুদক্ষ নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস ছিলেন স্পেনের ভৌগোলিক অভিযানের প্রাণপুরুষ। স্পেনীয় নৌবাহিনীর এই নাবিক স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলার সক্রিয় সহযোগিতা লাভ করেন। তিনি আটলান্টিক মহাসাগরে পরপর চারটি অভিযান চালান। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ৩ আগস্ট কলম্বাস নিনা, পিন্টা ও সান্তামারিয়া নামে তিনটি জাহাজ নিয়ে স্পেনের পালোস বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করেন। এরপর তিনি বর্তমান আমেরিকার বাহামা দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছোন। সমুদ্রের অপর প্রান্তের এই নতুন মহাদেশ যে নতুন তা কলম্বাস বুঝতে পারেননি। তিনি ভেবেছিলেন এটিই ভারত। তাই বাহামা দ্বীপপুঞ্জের নাম দেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং সেখানকার অধিবাসীদের নাম দেন রেড ইন্ডিয়ান। মূলত এটিই ছিল আমেরিকা মহাদেশ। এরপর তিনি পরপর অ্যান্টিলেস, হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া, কোস্টারিকা প্রভৃতি অঞ্চলে অভিযান করেন।
(3) আমেরিগোর অভিযান: আমেরিগো ভেসপুচির সর্বাধিক কৃতিত্ব হল তিনি কলম্বাস আবিষ্কৃত অজানা অঞ্চলটিকে নতুন মহাদেশ বলে চিনতে পারেন ও সেটিকে ‘নতুন বিশ্ব’ নামে অভিহিত করেন (১৫০৩ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ১৪৯৭ থেকে ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চারবার আমেরিকা অভিযান করেন। ১৫০৭ খ্রিস্টাব্দে আমেরিগো ভেসপুচির নামানুসারে নতুন মহাদেশের নাম দেওয়া হয়-আমেরিকা।
(4) বালবোয়ার অভিযান: ভাস্কো নুনিজ ডি বালবোয়া ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে স্পেন থেকে দক্ষিণ আমেরিকার দিকে অভিযান শুরু করেন। এই বছরই তিনি হিসপানিওলায় পৌঁছোন। বর্তমান কলম্বিয়া থেকে ৪০ মাইল দক্ষিণে ‘সোনায় ভরা একটি সাগরের’ জনশ্রুতি শুনে সেটি আবিষ্কারের উদ্যোগ নেন। অবশেষে ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে সেই নতুন সমুদ্র আবিষ্কার করেন এবং নাম দেন দক্ষিণ মহাসাগর।
(5) ম্যাগেলানের অভিযান: ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান জলপথে পৃথিবী পরিক্রমণের পরিকল্পনা করেন ও এ বিষয়ে স্পেনে রাজার আর্থিক সহায়তা লাভ করেন। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্পেনের সেভিল বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করেন পাঁচটি জাহাজ নিয়ে। বালবোয়া আবিষ্কৃত নতুন মহাসাগরের শান্ত ঢেউ দেখে তার নতুন নাম দেন প্রশান্ত মহাসাগর। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি নতুন দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার করেন ও স্পেনের যুবরাজ ফিলিপের নাম অনুসারে এর নাম দেন ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ। এখানেই স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে ম্যাকটানের যুদ্ধে ম্যাগেলান নিহত হন (১৫২১ খ্রিস্টাব্দে)। তাঁর সহকর্মী জুয়ান সেবাস্টিয়ান এলক্যানো ম্যাগেলানের অসমাপ্ত যাত্রাপথে নেতৃত্ব দিয়ে ১৫২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ সেপ্টেম্বর স্পেনে ফিরে আসেন। এইভাবে প্রথম জলপথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ সম্পূর্ণ হয় এবং ম্যাগেলানকেই এর প্রথম কৃতিত্ব দেওয়া হয়।
(6) স্পেনের সফলতার কারণ: পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে ভৌগোলিক অভিযানে স্পেনের সফলতার পিছনে একাধিক কারণ ছিল-
- স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলা নাবিকদের ভৌগোলিক অভিযানে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।
- ভৌগোলিক অভিযানের মাধ্যমে নতুন দেশ-মহাদেশ দখল করে সেখানকার অর্থসম্পদ হস্তগত করার বাসনা থেকে স্পেনের রাজশক্তি নাবিকদের উৎসাহ ও সহায়তা করেছিল।
- স্পেনীয় নাবিকদের নৌবিদ্যায় দক্ষতা ও দুঃসাহস ছিল অপরিসীম।
- স্পেনের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাদের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের জন্য ভৌগোলিক অভিযানে উৎসাহও সাহায্যজুগিয়েছিল।
মূল্যায়ন
ভৌগোলিক অভিযানে স্পেনের অবদান অনস্বীকার্য। স্পেনের সামুদ্রিক অভিযানের ফলে যেমন নতুন মহাদেশ-মহাসাগর আবিষ্কৃত হয়েছে, তেমনি ম্যাগেলানের জলপথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ দ্বারা পৃথিবীর গোলাকৃতি প্রমাণিত হয়েছে। তবে স্পেনের অভিযানের নিন্দাজনক ধ্বংসাত্মক দিকও রয়েছে। হার্মান্দো কোর্টেস ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে মেক্সিকোর প্রাচীন অ্যাজটেক সভ্যতা ধ্বংস করেন এবং সেখানকার বহু নিরীহ আদিবাসীদের হত্যা করেন। একইভাবে ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সিসকো পিজারো পেরুর ইনকা সভ্যতা ধ্বংস করেন।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর