টীকা লেখো: মূল্যবিপ্লব

মূলাবিপ্লব
ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে এক অভাবনীয় মুদ্রাস্ফীতি দেখা গিয়েছিল। এই শতকের শুরুর দিকে মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় দ্বিগুণ, যা বর্ধিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল পাঁচগুণে। খাদ্যশস্যের দাম ৫.৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ইউরোপের আর্থসামাজিক জীবনে মুদ্রাস্ফীতির অভিঘাত এতটাই জোরালো ছিল যে, কোনও কোনও ঐতিহাসিক এই ঘটনাকে সাধারণ মূল্যবৃদ্ধির পর্যায়ভুক্ত না করে মূল্যবিপ্লব (Price Revolution) বলে আখ্যায়িত করেছেন।
(1) বির্তক: ইউরোপে ষোড়শ শতকের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনাকে ‘মূল্যবিপ্লব’ বলা যায় কিনা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। সাধারণত ষোড়শ শতকের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে বোঝাতে এই কথাটির ব্যবহার করা হয়। ব্রদেল (Braudel) এই শতকের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। সমসাময়িক কালের পর্যবেক্ষক জাঁ বোদাঁ-র চোখেও মূল্যবিপ্লব তথা মুদ্রাস্ফীতির বিষয়টি ধরা পড়েছিল।
(2) মূল্যবৃদ্ধির কারণসমূহ: ইউরোপে মূল্যবৃদ্ধির পশ্চাৎপটে থাকা কারণগুলিকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করেছেন।
- জনসংখ্যা বৃদ্ধি: রিয়েলিস্ট (Realist) ঐতিহাসিকদের মতে, বর্ধিত চাহিদাই হল মূল্যবৃদ্ধির কারণ, যার পিছনে দায়ী জনসংখ্যার তাৎপর্যপূর্ণ বৃদ্ধির বিষয়টি।
- মাত্রাতিরিক্ত মুদ্রার জোগান: আবার মনিটারিস্ট (Monetarist) শাখার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, আলোচ্য সময়ে আমেরিকা থেকে স্পেন হয়ে সমগ্র ইউরোপে প্রচুর পরিমাণে সোনা-রুপোর আমদানি ঘটেছিল। ফলে মুদ্রার জোগানও মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছিল। ঘটেছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৫৩১-৪০ খ্রিস্টাব্দে মূল্যবান ধাতু আমদানির মোট পরিমাণ ছিল ২৩৬.৩ টন, যা ১৫৯১-১৬০০ খ্রিস্টাব্দের সময়কালে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩০৯৩.৯ টনে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জাঁ বোদা তাঁর ন্যায্যমূল্য তত্ত্বে বলেছেন যে, মূল্যের ওঠানামা নির্ধারিত হয় পণ্য ও অর্থের প্রাচুর্য এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে। এই অর্থের প্রাচুর্যের পশ্চাৎপটে ছিল স্পেন অধিকৃত দক্ষিণ আমেরিকা থেকে বিপুল পরিমাণ সোনা ও রুপোর ইউরোপে আমদানি। পরবর্তীতে আর হ্যামিলটন (R Hamilton), এ ক্যাবার্ট (A Chabart) এই মতকে সমর্থন করেছেন। অন্যদিকে ব্রদেল যদিও আমেরিকা থেকে ইউরোপে ধাতু আমদানির তত্ত্ব মেনে নিয়েছেন, তবে পাশাপাশি তিনি এটাও বলেছেন যে, ধাতু নিষ্কাশনের পিছনে দায়ী ছিল ইউরোপের চাহিদা। অন্যদিকে চিপোল্লা (Cipolla) আবার মনে করেছেন, ইউরোপে মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি সূচিত হয়েছিল আমেরিকা থেকে সোনা-রূপো আমদানির আগেই।
- কর বৃদ্ধি: এ ছাড়া অপর একদল পণ্ডিতের মতে, ষোড়শ শতকে যে নতুন রাষ্ট্রের উত্থান ঘটেছিল, তার প্রভাবে প্রশাসনিক ব্যয়ও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই ব্যয়নির্বাহ করতে ওইসব রাষ্ট্রের শাসকগণ প্রজাদের উপর চাপাতেন বর্ধিত করের বোঝা। এর ফলে ইউরোপে ষোড়শ শতকে মুদ্রাস্ফীতি অনিবার্য হয়ে পড়ে।
- ঋণব্যবস্থার উদ্ভব: সম্প্রতি মনিটারিস্ট শাখার কয়েকজন ঐতিহাসিক ঋণব্যবস্থার উদ্ভবকেও মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী করেছেন। অর্থনৈতিক রূপান্তর: পাশাপাশি রেনেসাঁ যুগে যে-সমস্ত অর্থনৈতিক রূপান্তর এসেছিল (ভৌগোলিক অভিযান, সাগরপাড়ের বাণিজ্যবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, নগরায়ণ ইত্যাদি), সেগুলির অভিঘাতও মূল্যবিপ্লবের পশ্চাৎপটে যথেষ্ট কার্যকরী ছিল।
(3) মূল্যবিপ্লবের বৈশিষ্ট্য: আলোচ্য পর্বে মূল্যবিপ্লবের কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়, যথা- খাদ্যশস্যের বিশেষত গমের মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে খাজনার হার বৃদ্ধি এবং খাজনার বাণিজ্যিকীকরণ (Commercialisation of Rent), বিক্রয়যোগ্য পণ্য হিসেবে জমির চরিত্রের রূপান্তর এবং নবোত্থিত গ্রামীণ ভদ্রশ্রেণি কর্তৃক জমির সিংহভাগ মালিকানা দখল।
(4) মূল্যবিপ্লবের প্রভাব: মূল্যবিপ্লবের প্রভাবগুলি হল-
- শিল্পপণ্যের চাহিদা হ্রাস: খাদ্যদ্রব্য নয় এমন উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির হার খাদ্যদ্রব্যের তুলনায় কম হলেও তার উপরে মূল্যবিপ্লবের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। কারণ, এই সময় ক্রেতার চাহিদা মূলত খাদ্যদ্রব্যের উপরেই নিবদ্ধ থাকায় অন্যান্য পণ্যের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
- কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ: মূল্যবিপ্লবের প্রতিক্রিয়ায় কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ এবং পুঁজিনির্ভর কৃষি উৎপাদনের সূচনা হয়েছিল। ইংল্যান্ডে এই প্রক্রিয়া বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল।
- সামাজিক বিন্যাসের পরিবর্তন: মূল্যবিপ্লবের অভিঘাতে ক্ষুদ্র কৃষকেরা আরও দরিদ্র হয়ে খেতমজুরে পরিণত হলেও অনেকে আবার এই পরিস্থিতিতে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের মাধ্যমে ধনসম্পত্তি বৃদ্ধিও করেছিলেন। এসবের ফলে আয় ও সম্পত্তির মালিকানায় তারতম্যের সৃষ্টি হয় এবং সামাজিক সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
- শ্রমিক শ্রেণির অবণতি: মূল্যবিপ্লবের ফলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও শ্রমিকদের মজুরি সেই তুলনায় বাড়েনি। ফলে শ্রমিকদের আয় হ্রাস পায় ও জীবনযাত্রার মানে অবনতি ঘটে।
আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ: মূল্যবিপ্লবের পরোক্ষ প্রভাবে ইউরোপে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছিল। এই সময় মালিক শ্রেণির হাতে প্রভূত ধনসম্পত্তির পুঞ্জীভবন এই বিকাশে সহায়ক হয়ে উঠেছিল।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর