বৌদ্ধদের অষ্টাঙ্গিক মার্গের ধারণা প্রশ্ন উত্তর

1. বৌদ্ধ নীতিতত্ত্বে ‘সম্যক আজীব’-এর গুরুত্ব লেখো।
বৌদ্ধ নীতিতত্ত্বে সম্যক আজীব -এর অর্থ সুস্থ জীবনযাপনের জন্য প্রবঞ্চনা ও কপটতা পরিত্যাগ করে সৎভাবে সৎ পথে জীবিকা অর্জন করা। কারও ক্ষতিসাধন না করে সৎভাবে জীবিকা অর্জনের মধ্যে দিয়ে সুস্থভাবে জীবন নির্বাহ করাই হল সম্যক আজীব। অর্থাৎ সম্যক আজীব আমাদের সৎপথে সৎভাবে জীবনযাপনের কথা বলে। নৈতিক শিক্ষায় যার গুরুত্ব অপরিসীম। অষ্টাঙ্গিক মার্গের এই মার্গটিতে মাদক দ্রব্য ও খাদ্যরূপে পশুপাখি বিক্রয়কে জীবিকারূপে গ্রহণ না করার কথা বলা হয়েছে। যে-কোনো ধরনের সেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা বলা হয়েছে। ব্যক্তিকে সঠিক পেশা গ্রহণ করতে হবে যার ফলে আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটে। নৈতিক কর্মে নিযুক্ত থেকে ব্যক্তিকে সামাজিক সাম্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।
2. সম্যক আজীব মার্গে কোন্ কোন্ জীবিকাকে বর্জন করার কথা বলা হয়েছে?
সৎ উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করাই হল সম্যক আজীব। বুদ্ধদেব অসৎ উপায়ে জীবিকা অর্জন করা থেকে বিরত থাকার কথা বলেন। বৌদ্ধ মতে পাঁচ প্রকার জীবিকাকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল যেগুলি থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে। সেগুলি হল- অস্ত্র ক্রয়-বিক্রয়, নেশাজাতীয় যে-কোনো বস্তু ক্রয়-বিক্রয়, পশুপাখির মাংস ক্রয়-বিক্রয়, বিষ বিক্রয়, মানুষকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে যে-কোনো পেশা। অর্থাৎ বুদ্ধদেব সম্যক আজীবে অযথার্থ কর্ম থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন।
3. বৌদ্ধ নীতিতত্ত্বে সম্যক ব্যায়ামের গুরুত্ব লেখো।
বৌদ্ধ নীতিতত্ত্বে সম্যক ব্যায়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। সম্যক ব্যায়ামের অর্থ সৎ চেষ্টা বা অনুশীলন, শারীরিক ও মানসিক ব্যায়াম। কুচিন্তা আমাদের নৈতিক জীবনকে অপবিত্র করে তোলে। তাই কুচিন্তা থেকে বিরত হওয়া দরকার। ইন্দ্রিয় সংযম ও সমস্ত অশুভ কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে চিত্তে শুভ কামনার নিরন্তর অনুশীলনে স্থিত হওয়া সম্যক ব্যায়ামের অঙ্গ। যা মানব মন থেকে সমস্ত অশুভ চিন্তা দূর করে এবং সুস্থ ও শুভ চিন্তার উদয় ঘটায়। বৌদ্ধ নীতিতত্ত্বে সম্যক ব্যায়ামের অঙ্গগুলি হল
- নির্বাণকামী ব্যক্তির মনে উপস্থিত অশুভ বা অকল্যাণকর চিন্তা দূর করা।
- নির্বাণকামী ব্যক্তির মনে পুনরায় যাতে অশুভ বা অকল্যাণকর চিন্তা উদ্ভব না হতে পারে তার জন্য সচেতন হওয়া।
- ব্যক্তির মনে যাতে শুভ বা কল্যাণকর চিন্তা উদ্ভব হয় তার জন্য সচেষ্ট হওয়া।
- ব্যক্তির মনে শুভ বা কল্যাণকর চিন্তাগুলি সংরক্ষণ করা।
4. বৌদ্ধ নীতিতত্ত্বে সম্যক স্মৃতি-এর গুরুত্ব লেখো।
বৌদ্ধ নীতিতত্ত্বে সর্ববিষয়ের যথার্থ স্বরূপকে স্মরণে রাখা হল সম্যক স্মৃতি। মুমুক্ষু ব্যক্তিকে স্মরণ রাখতে হবে যে, এই জগৎ-জীবন, দেহ-মন সবই অনিত্য। দীর্ঘনিকায় সূত্রে বুদ্ধদেব বলেছেন মৃত্যুর পর আমাদের শরীর পচে যায় এবং তা পশুপাখির খাদ্যে পরিণত হয়। কাজেই এই সমস্ত বিষয়ের প্রতি মোহ ও আসক্তি অর্থহীন। এ কথা স্মরণে রেখে সমস্তরকম পার্থিব বস্তু থেকে আসক্তিমুক্ত হতে হবে। চারটি আর্যসত্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের নিরন্তর স্মরণ করাই হল সম্যক স্মৃতি। সম্যক স্মৃতির অনুশীলনের ফলে সাধক যে-কোনো কর্মের প্রতি পূর্ণ মনোযোগী ও সচেতনশীল হবেন। সাধক তথা মুক্তিকামী ব্যক্তি জাগতিক যে-কোনো বিষয়ের প্রতি অনাসক্ত থাকবেন। অনাসক্তভাবে কর্ম করলে তবেই ব্যক্তির পক্ষে মুক্তিলাভ সম্ভব হবে।
5. অষ্টাঙ্গিক মার্গের অষ্টম মার্গ সম্যক সমাধির গুরুত্ব লেখো।
‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’-এর শেষ মার্গ হল সম্যক সমাধি, যার মধ্যে দিয়ে মানুষ নির্বাণ প্রাপ্ত হয়। চিত্তের একাগ্রতার নাম সমাধি। এক্ষেত্রে ব্যক্তি আর্যসত্য চতুষ্টয়ের সম্যক জ্ঞানের দ্বারা শুদ্ধ চিন্তা, ভাষা ও কর্মের অনুশীলনের মাধ্যমে সমস্ত অসৎ চিন্তা ও আসক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে এবং পরে সমাধির স্তরে উন্নীত হয়। সম্যক সমাধির অপর নাম ধ্যান। এক্ষেত্রে ধ্যানের মধ্যে দিয়ে মানুষের মনে এক শান্ত ও আনন্দময় অবস্থা উপস্থিত হয়। এক্ষেত্রে যে পূর্ণতাপ্রাপ্তি হয় বৌদ্ধ পরিভাষায় তাকে নির্বাণ বলে।
এই অবস্থায় ব্যক্তির মনে কোনো কিছুরই অনুভূতি থাকে না। ব্যক্তি পূর্ণ প্রজ্ঞার অধিকারী হয়। নিষ্কাম কর্ম সাধনার জন্য নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তির আর পুনর্জন্মের সম্ভাবনা থাকে না। নির্বাণের জন্য সমাধি বা ধ্যান একান্ত প্রয়োজন। সমাধির চারটি স্তরের মাধ্যমে ব্যক্তি নির্বাণ লাভ করে। তখন সেই নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অর্হৎ বলা হয়। নির্বাণ প্রাপ্ত ব্যক্তির আত্মপরিশুদ্ধি হয়। তখন সাধক জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সত্য জ্ঞান বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করতে পারে। এই সমাধি স্তরে সাধক গভীর ধ্যানের মাধ্যমে প্রকৃত সত্তাকে অনুধাবন করতে পারে এবং সকল প্রকার মোহ, মায়া, লোভ, রাগ, দ্বেষ থেকে নিজেকে মুক্ত করে মুক্তিকামী ব্যক্তিতে পরিণত হয়।
6. বৌদ্ধ দর্শনে আলোচিত সমাধির স্তর সম্বন্ধে আলোচনা করো।
সমাধির স্তর
বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উপায়ের কথা বলতে গিয়ে আটটি মার্গ বা পথের কথা বলা হয়েছে। এদের মধ্যে সাতটি মার্গ বা পথ যথাযথ অনুসরণ করা হলে সাধকের চিত্ত শান্ত ও সংহত হয়। ফলে সাধক গভীরভাবে বিষয়ে মনোসংযোগের অর্থাৎ সমাধির সামর্থ্য লাভ করে। এই সমাধিতেই সাধক দুঃখমুক্তি বা নির্বাণ লাভ করে। সমাধির চারটি স্তর আছে। সেগুলি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল-
(1) প্রথম স্তর: এই স্তরে সাধক নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের প্রতি বা চারটি মহান সত্যের প্রতি মনকে সমাহিত করে। এই স্তরে ধ্যানের বিষয় সম্পর্কে সাধক বা মুমুক্ষুর (মোক্ষকামী ব্যক্তি) সংশয় থাকে, বিচার-বিতর্ক থাকে। তবুও সমাধির এই অবস্থায় মনে মনে আনন্দ, অনুভূতি জাগ্রত হয়।
(2) দ্বিতীয় স্তর: এই স্তরে ধ্যানের বিষয় সম্পর্কে সাধকের মনে কোনো সংশয় না থাকায় সমস্ত বিচার-বিতর্কের অবসান ঘটে। বিষয়ের প্রতি অকল্পিত মনোসংযোগের জন্য সাধক এক দিব্য আনন্দের বা অনাবিল আনন্দের অধিকারী হয়।
(3) তৃতীয় স্তর: এই স্তরে ধ্যানের বিষয় এবং বিষয়জনিত আনন্দ, অনুভূতির প্রতি সাধকের ঔদাসীন্য দেখা দেয়। সাধকের মন আত্মমুখী হয়ে আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করে। ধ্যানের এই তৃতীয় স্তরে দৈহিক সুখের অনুভূতি বা মানসিক আনন্দ-অনুভূতি তিরোহিত হলেও আত্মচেতনার সম্পূর্ণ বিলোপ হয় না।
(4) চতুর্থ স্তর: এই স্তরে সাধক বা মুমুক্ষু সম্পূর্ণভাবে আত্মসমাহিত হয়। তার কোনোরকম দৈহিক অনুভূতি এমনকি মানসিক চেতনাও থাকে না। এই স্তরকে তুরীয় অবস্থা, প্রজ্ঞার অবস্থা বা নির্বাণের অবস্থা বলা হয়। এই অবস্থাই হল মানব জীবনের পরমপুরুষার্থ। এই অবস্থায় সাধক অর্হৎ বা পূজনীয় ব্যক্তিতে উন্নীত হয়। ফলে জরা-মরণ বা দুঃখ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়।
7. ‘সপ্তসমাধি পরিষ্কার’ কী?
বুদ্ধদেব নির্দেশিত অষ্টাঙ্গিক মার্গের অন্তর্গত সর্বশেষ মার্গ হল সম্যক সমাধি। নির্বাণের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্রটিকে প্রস্তুত করে প্রথম সাতটি মার্গ। প্রথম সাতটি মার্গ অতিক্রম করে মুক্তিকামী ব্যক্তি সকল কামনা-বাসনা ও অশুভ ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে সম্যক সমাধি লাভের যোগ্য হয়ে ওঠে। সম্যক সমাধি লাভের সহায়করূপে প্রথম সাতটি মার্গকে বলা হয় ‘সপ্তসমাধি পরিষ্কার’। এই সাতটি মার্গ হল- সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্, সম্যক কর্মান্ত, সম্যক আজীব, সম্যক ব্যায়াম ও সম্যক স্মৃতি।
8. অষ্টাঙ্গিক মার্গক-টি স্কন্ধে বিভক্ত ও কী কী?
অষ্টাঙ্গিক মার্গ তিনটি স্কন্ধে বিভক্ত। এগুলি হল প্রজ্ঞা (জ্ঞান), শীল (সৎ আচরণ) এবং সমাধি (ধ্যান)। সম্যক দৃষ্টি ও সম্যক সংকল্প হল প্রজ্ঞা বা যথার্থ জ্ঞানের অন্তর্গত। প্রজ্ঞা অবিদ্যাকে বিনষ্ট করে। সম্যক বাক্, সম্যক কর্মান্ত ও সম্যক আজীব শীল বা সৎ আচরণের অন্তর্গত। আর সর্বশেষ তিনটি মার্গ অর্থাৎ সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি হল সমাধির অন্তর্গত অষ্টাঙ্গিক মার্গকে বৌদ্ধ দর্শনে প্রজ্ঞা-শীল-সমাধিরূপে অভিহিত করা হয়।
9. অষ্টাঙ্গিক মার্গের অন্তর্গত কোন্ কোন্ মার্গ প্রজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত? প্রজ্ঞাস্কন্ধ কী?
অষ্টাঙ্গিক মার্গের অন্তর্গত সম্যক দৃষ্টি ও সম্যক সংকল্প প্রজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। বুদ্ধদেব সম্যক দৃষ্টি ও সম্যক সংকল্পকে প্রজ্ঞাস্ক বলেছেন। সকল দুঃখের মূল কারণ হল অবিদ্যা। অবিদ্যার কারণেই জগৎ ও আত্মার প্রকৃত স্বরূপ আমাদের কাছে উদঘাটিত হয় না। সম্যক দৃষ্টির সাহায্যে অবিদ্যা দূরীভূত হলে পার্থিব বিষয়ের প্রতি অনাসক্তি, কামনা-বাসনা বর্জন, হিংসা বর্জন করার দৃঢ় মানসিক প্রস্তুতি অর্থাৎ দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করতে হবে আর সম্যক দৃষ্টি ও সম্যক সংকল্পের মিলিত চেষ্টায় নির্বাণ লাভের ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে।
10. অষ্টাঙ্গিক মার্গের অন্তর্গত কোন্ কোন্ মার্গ শীলের অন্তর্ভুক্ত? শীল স্কন্ধ কী?
অষ্টাঙ্গিক মার্গের অন্তর্গত সম্যক বাক্, সম্যক কর্মান্ত ও সম্যক আজীব শীলের অন্তর্ভুক্ত। অষ্টাঙ্গিক মার্গের অন্তর্গত সম্যক বাক্, সম্যক কর্মান্ত ও সম্যক আজীবকে একত্রে শীলস্কন্ধ বলা হয়েছে। অর্থাৎ বাক্সংযম, নিষ্কাম কর্মের সম্পাদন এবং সৎপথে জীবিকা নির্বাহ করাকেই একত্রে বলা হয় শীলস্কন্ধ। বাক্সংযমের মাধ্যমে শুরু হয় মানসিক সংযম। সম্যক কর্মান্তের ফলে কামনা-বাসনা দূর হয়। সম্যক আজীবের মাধ্যমে দেহ নির্মল ও চিত্তশুদ্ধি হয়।
11. প্রজ্ঞা-শীল-সমাধি সমুচ্চয় কী?
বুদ্ধদেবের উপলব্ধ চতুর্থ আর্যসত্যে দুঃখ নিরোধের উপায় হিসেবে যে আটটি পথ বা অষ্টাঙ্গিক মার্গের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেই অষ্টাঙ্গিক মার্গকে একত্রে প্রজ্ঞা-শীল-সমাধি বলা হয়। প্রজ্ঞা বলতে বৌদ্ধিক ব্যাপারসমূহের সংযমকে বোঝানো হয়। শীল হল সদাচার বা নৈতিক আচরণ এবং চিত্ত সংযম বা অন্তরিন্দ্রিয় সংযমের জন্য যেসকল আচরণের উল্লেখ করা হয়েছে তাকে বলা হয় সমাধি। অষ্টাঙ্গিক মার্গের অন্তর্গত সম্যক দৃষ্টি ও সম্যক সংকল্পকে প্রজ্ঞার অন্তর্গত। সম্যক বাক্, সম্যক কর্মান্ত ও সম্যক আজীব শীলের অন্তর্ভুক্ত। আর সম্যক ব্যায়াম, • সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি হল সমাধির অন্তর্গত। এই অষ্টাঙ্গিক মার্গের – প্রতিটি অঙ্গ একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত, যা সাধককে নির্বাণ বা মুক্তির পথে চালিত করে।
12. শীল কত প্রকার ও কী কী? বারিত্রশীল ও চারিত্রশীল কী?
শীলের প্রকার
বৌদ্ধ দর্শনে শীল বলতে সদাচার বা নৈতিক আচরণকে বোঝায়। সদর্থক অর্থে শীল হল সেই সকল কর্ম বা আচরণ যা মানুষের পালনীয় বলে বিবেচিত হয়। যেমন- সদাচার মেনে চলা, সত্য কথা বলা ইত্যাদি। আবার শীল হল সেইসব বিশেষ ইচ্ছা ও মানসিক অবস্থাসমূহ যার দ্বারা কোনো মানুষ পাপ কর্ম থেকে নিজেকে বিরত রাখে। এটি হল শীলের নঞর্থক অর্থ। এই সদর্থক ও নঞর্থক অর্থকে কেন্দ্র করে শীলকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা- বারিত্রশীল ও চারিত্রশীল।
(1) বারিতশীল: বুদ্ধদেব যেসকল কর্মকে আচরণ বা পালন করতে নিষেধ করেছেন অর্থাৎ যেসকল কর্ম করা উচিত নয় সেগুলিকে বলা হয় বারিত্রশীল।
(2) চারিতশীল: বুদ্ধদেব যেসকল কর্মকে আচরণ বা পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন অর্থাৎ যা উচিত কর্ম বলে বিবেচিত হয় সেগুলিকে বলা হয় চারিত্রশীল।
13. বুদ্ধদেবকে ‘জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়বাদী’ বলা হয় কেন?
বুদ্ধদেব নির্দেশিত অষ্টাঙ্গিক মার্গকে প্রজ্ঞা-শীল-সমাধিরূপেও বর্ণনা করা হয়। প্রজ্ঞা অর্থে যথার্থ জ্ঞান, শীল অর্থে সদাচরণ ও সমাধি অর্থে ধ্যানকে বোঝানো হয়েছে। দুঃখ মুক্তি বা নির্বাণ লাভের জন্য বুদ্ধদেব জ্ঞানমার্গ ও কর্মমার্গের মধ্যে সমন্বয়সাধন করেছেন। বৌদ্ধ মতে সম্যক জ্ঞান ও সম্যক কর্ম পরস্পরের পরিপূরক। এদের একটি ছাড়া অন্যটি সম্ভব নয়। সম্যক জ্ঞান ও সম্যক কর্মের মাধ্যমে চিত্তশুদ্ধ হলে তবেই সম্যক সমাধির মাধ্যমে দুঃখমুক্তি সম্ভবপর হবে। বুদ্ধদেব জ্ঞানমার্গ ও কর্মমার্গের মধ্যে সমন্বয়সাধন করায় তাঁকে বলা হয় ‘জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়বাদী’।
14. বৌদ্ধ দর্শনে অহিংসা বলতে কী বোঝানো হয়েছে? বৌদ্ধ মতে দশশীল কী?
অহিংসা
বৌদ্ধ দর্শনে যে শীলের উল্লেখ পাওয়া যায় তার মধ্যে একটি শীল হল অহিংসা। শুধুমাত্র বৌদ্ধ ভিক্ষু বা সন্ন্যাসী নয় প্রত্যেক গৃহস্থের কর্তব্য অহিংসা অনুসরণ করে চলা। কোনো প্রাণীর হত্যা না করাকে অহিংসা বলা হয়। এটি অহিংসার সংকীর্ণ অর্থ। ব্যাপক অর্থে অহিংসা হল সকল জীবের প্রতি মৈত্রীভাবাপন্ন হওয়া ও সকলের কল্যাণ কামনা করা। অহিংসার মূলকথা হল সবল ও দুর্বল কোনো প্রাণীকেই আঘাত বা হত্যা না করা। এই কারণে বৌদ্ধগণ অহিংসভাবে জীবনযাপনের উপদেশ দিয়েছেন, যা মানুষকে নির্বাণ লাভে অগ্রসর হতে সাহায্য করে। তাই বলা যায় বৌদ্ধ নীতিদর্শনে অহিংসার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
দশশীল
বিনয়পিটক-এ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুদের জন্য দশটি শীল পালনের কথা বলা হয়েছে যাকে দশশীল বলা হয়। সেগুলি হল- অহিংসা, অস্তেয়, সত্যকথন, ব্রহ্মচর্য পালন, মাদকদ্রব্য
বর্জন, অসময়ে আহার গ্রহণ না করা, নৃত্যগীতাদি উৎসব বর্জন করা, দেহসজ্জার জন্য গন্ধাদি দ্রব্য বর্জন করা, উচ্চ আসনে বসা বা শয়ন বর্জন করা এবং অর্থ গ্রহণ না করা।
15. বৌদ্ধ নীতিদর্শনে ব্রাবিহার ধারণা ব্যাখ্যা করো। অথবা, সম্যক সমাধির মধ্যে যে চারটি ভাব নিহিত আছে, সেগুলি কী কী?
ব্রহ্মবিহার
বৌদ্ধ মতে নির্বাণ পরমপুরুষার্থ। বুদ্ধদেব স্বয়ং যে পথ অনুসরণ করে নির্বাণ লাভ করেছিলেন সেই পথের আটটি স্তর আছে। এই জন্য বুদ্ধদেব প্রদর্শিত নির্বাণ লাভের পথকে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়।
(1) সমাধির চারটি ভাব: অষ্টাঙ্গিক মার্গের শেষ স্তর অর্থাৎ সম্যক সমাধির মধ্যে চারটি ভাবের উল্লেখ আছে। যথা- মৈত্রী, করুণা, মুদিতা এবং উপেক্ষা।
- মৈত্রী: নিয়ত জীবের কল্যাণ চিন্তায় নিয়োজিত থাকাই হল মৈত্রীভাবনা।
- করুণা: মৈত্রীভাবের মধ্যে করুণাভাব নিহিত। জীবের দুঃখ মোচনের নিয়ত বাসনাই হল করুণাভাব।
- মুদিতা: নিজের স্বার্থচিন্তা ত্যাগ করে পরের সুখে তৃপ্তিলাভ হল মুদিতাভাব।
- উপেক্ষা: নিজের সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভ ইত্যাদিকে সমভাবে গ্রহণ করে অর্থাৎ তাদের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন থেকে বিশ্বমানবের কল্যাণ চিন্তাই হল উপেক্ষা।
উল্লিখিত এই চারটি ভাব অর্থাৎ মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষাকে একত্রে বলা হয় ব্রহ্মবিহার। ব্রহাবিহারের অর্থ হল ব্রষ্মের বিচরণ বা বিচার। বুদ্ধ মতে, ব্রহ্মই হল চরম সত্য, চিৎ ও আনন্দস্বরূপ। এই আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মে বিচরণ বা বিহারই হল ব্রহ্মবিহার।
16. বৌদ্ধ নীতিতত্বে অষ্টাঙ্গিক মার্গের গুরুত্ব লেখো।
বৌদ্ধ নীতিতত্ত্বে অষ্টাঙ্গিক মার্গের গুরুত্ব অপরিসীম। বৌদ্ধ মতে অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলন আসলে নৈতিক বিধি অনুসারে জীবনযাপন। বুদ্ধদেব উপলব্ধি করেছিলেন, মানুষ যেমন বাস্তব, মানুষের দুঃখও তেমনি বাস্তব। আর মানুষের এই দুঃখ-কষ্টের মূল কারণ হল অবিদ্যা (তত্ত্ব জ্ঞানের অভাব) বা অজ্ঞানতা। এই অবিদ্যার বিলোপসাধন করতে পারলেই মানুষ দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। চারটি আর্যসত্যের সঠিক জ্ঞান এবং অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলনের দ্বারা নৈতিক চরিত্র গঠন করতে পারলেই সমস্তরকম দুঃখমুক্তি সম্ভব। যাকে বৌদ্ধ পরিভাষায় নির্বাণ বলা হয়।
চতুর্থ আর্যসত্যে দুঃখ নিবৃত্তির উপায় হিসেবে আটটি মার্গ বা পথের সন্ধান দেওয়া হয়েছে। এই আটটি মার্গ বা পথকে একত্রে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়। বৌদ্ধ নীতিতত্ত্বে অষ্টাঙ্গিক মার্গে আটটি পথের দ্বারা শুদ্ধ জীবনযাপনের মাধ্যমে নির্বাণলাভের কথা বলা হয়েছে। অষ্টাঙ্গিক মার্গের এই আটটি মার্গ বা পথগুলি হল- সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্, সম্যক কর্মান্ত, সম্যক আজীব, সম্যক ব্যায়াম সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। এই অষ্টাঙ্গিক মার্গই বৌদ্ধ নীতিতত্ত্বের বা নৈতিক জীবনের মূলভিত্তি। বুদ্ধদেব বলেছেন, নিজ জ্ঞান ও কর্মের দ্বারা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মতো সাধারণ মানুষও নিজের চেষ্টাতেই অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলনের মাধ্যমে চারটি আর্যসত্যের সম্যক জ্ঞান লাভ করলেই প্রকৃত দুঃখমুক্তি বা নির্বাণ লাভ করতে পারবে।
17. বৌদ্ধ নীতিদর্শনের গুরুত্ব লেখো। অথবা, বৌদ্ধ নীতিদর্শনের উদ্দেশ্য কী?
বৌদ্ধ দর্শন মূলত নীতিমূলক ধর্মদর্শন। বোধিলাভের পর বুদ্ধদেব উপলব্ধি করেছিলেন অবিদ্যা হল মানুষের সকল প্রকার দুঃখের কারণ। বৌদ্ধ নীতিদর্শনের মূল উদ্দেশ্য হল মানবজাতির দুঃখের চিরনিবৃত্তি ঘটানো। অবিদ্যা দূরীভূত হলেই দুঃখের চিরনিবৃত্তি ঘটবে। অবিদ্যা বিনাশের জন্যে নিরাসক্তির সাধনা প্রয়োজন। নিরাসক্তির সাধনার দ্বারাই ব্যক্তি অহং মুক্ত হতে পারেন এবং ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেন। এর ফলে ব্যক্তি আদর্শবান হয়ে ওঠেন এবং আদর্শ নীতিনিষ্ঠ সমাজ গড়ে তুলতে সহায়তা করেন।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর