নৈতিক তত্ত্বসমূহ প্রশ্ন উত্তর
১। পরসুখবাদ সম্বন্ধে বেথামের মতবাদ ব্যাখ্যা ও বিচার করো। অথবা, বেথামের স্থূল উপযোগবাদ বা অর্মাজিত পরসুখবাদ ব্যাখ্যা ও বিচার করো।
ব্যোমের পরসুখবাদ
নীতিবিজ্ঞানসম্মত সুখবাদের দুটি রূপ- আত্মসুখবাদ ও পরসুখবাদ। পরসুখবাদকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায়- অর্মাজিত পরসুখবাাদ ও মার্জিত পরসুখবাদ। যারা সুখের মূল্য বিচার গুণের দ্বারা করেন তারা মার্জিত পরসুখবাদী এবং যারা পরিমাণের দ্বারা করেন তারা অমার্জিত পরসুখবাদী। ব্যোম অমার্জিত পরসুখবাদের প্রবর্তক। পরসুখবাদ অনুসারে যে কাজ সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তির সর্বাধিক পরিমাণ সুখলাভের উপযোগী সেই কাজ যথোচিত বা ভালো কাজ এবং সুখলাভের অনুপযোগী কাজ মন্দ।
(1) গুণগত পার্থক্যের পরিমাণগত পার্থক্য স্বীকার্য: সর্বাপেক্ষা অধিক মানুষের জন্য সর্বাধিক পরিমাণ সুখ কামনা আমাদের জীবনের নৈতিক আদর্শ। পরসুখবাদের আদর্শকে উপযোগবাদ বলা হয়। কারণ এই মতবাদ অনুসারে উপযোগিতা বা কার্যকারিতা নৈতিক বিচারের মাপকাঠি। যে কাজ সর্বাধিক পরিমাণ লোকের সুখ উৎপাদনের উপযোগী সেই কাজ ভালো। বেথাম অর্মাজিত পরসুখবাদী কারণ তিনি সুখের গুণগত পার্থক্য স্বীকার করেন না। তাঁর কাছে সব সুখই এক রকমের। পান ভোজনের সুখ ও কবিতা পাঠের সুখ – এই সুখ দুটির প্রকৃতি এবং উভয়ের পরিমাণ যদি একরকম হয় তবে সুখও সমমানের। বেথামের মতে, এই দুটি সুখের মধ্যে কেবল পরিমাণগত পার্থক্য আছে। যে কাজের ফলে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সুখ ও সবচেয়ে কম পরিমাণ দুঃখ পাওয়া যায়, সেই কাজ যথোচিত।
(2) ব্যোমের সপ্তসুখ গণনা প্রণালী: সুখের পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য তিনি সুখ প্রণালী নির্ণয় করেন। তিনি বলেন ‘সুখ এবং দুঃখ ওজন কর। কোন্ দিকে পাল্লা ভারী তা দেখে বিচার করতে হবে কাজটি যথোচিত নাকি অনুচিত।’
সুখ সম্পর্কিত গণনার প্রণালীর মাধ্যমে সুখের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য সুখের সাতটি মানের কথা স্মরণে রাখতে হবে। এইগুলি হল- তীব্রতা, স্থিতিকাল, নিশ্চয়তা, নিকটবর্তী, উর্বরতা, বিশুদ্ধি ও বিস্তৃতি।
এই সাতটি মানের সাহায্যে সুখ গণনাকে সুখবাদের গণনা প্রণালী বলা হয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বেনথাম বিশ্বাস করেন যে জড়বস্তুকে যেমন দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা যায়, তেমনি সুখকেও ওজন করা যায়। কিন্তু সুখ জড়বস্তু নয়, একপ্রকার মানসিক অবস্থা, যা দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা সম্ভব নয়।
(3) পরসুখবাদের সপক্ষে নিয়ন্ত্রণভত্ত্ব: বেথাম পরসুখবাদের কথা প্রসঙ্গে চার প্রকার বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। সেগুলি হল- প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ।
(4) সমালোচনা: বেথামের পরসুখবাদ সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। কারণ-
- বেনথাম মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদ থেকে যে নৈতিক পরসুখবাদে অগ্রসর হয়েছেন তা যুক্তিসংগত নয়।
- তিনি যে কেবল পরিমাণগত সুখের কথা বলেছেন তাতে মানসিকসুখের পরিবর্তে শুধুমাত্র দৈহিকসুখই গুরুত্ব পেয়েছে।
- বেথাম কিছু বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্বার্থপরতা থেকে যে পরার্থপরতাতে উপনীত হয়েছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ কিছু বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণের দ্বারা কখনোই কোনো নৈতিক কর্ম করা হয় না।বাই
২। ব্যোমের সপ্ত সুখ গণনা প্রণালী আলোচনা করো।
ব্যোমের সপ্ত সুখ গণনা প্রণালী: অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক জেরেমি ব্যোম মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদ থেকে সর্ববাদী সুখবাদ বা উপযোগবাদের কথা প্রচার করেছেন। তিনি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, সুখের অন্বেষণ ও দুঃখকে পরিহার করাই মানব প্রকৃতির একমাত্র উদ্দেশ্য। তিনি কতগুলি নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন যেসব নিয়ন্ত্রণই মানুষকে তার নিজের সুখ বা স্বার্থ বর্জন করে সমাজের সর্বসাধারণের সুখ বা মঙ্গল চিন্তা করতে বাধ্য করে, যার ফলে মানুষ আত্মসুখের পরিবর্তে পরসুখের কথা চিন্তা করে। সেই নিয়ন্ত্রণগুলি হল- প্রাকৃতিক বা জাগতিক নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, নৈতিক বা লৌকিক নিয়ন্ত্রণ যা সামাজিক বলে বর্ণিত হয়ে থাকে এবং ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ।
ব্যোম সুখের কোনো গুণগত পার্থক্যের কথা স্বীকার না করে কেবল পরিমাণগত পার্থক্যের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি সুখের পরিমাপ করার জন্য সাতটি মান বা সুখের গণনা পদ্ধতির কথা বলেন। বেথাম নির্ধারিত সুখ পরিমাপের সাতটি মান বা গণনা পদ্ধতি হল – তীব্রতা স্থায়িত্ব, নৈকট্য, নিশ্চয়তা, বিশুদ্ধি,উর্বরতা এবং বিস্তৃতি।
(1) তীব্রতা : যে সুখ তুলনামূলকভাবে বেশি তীব্র, তা অধিকতর কাম্য। যেমন দৈহিক সুখ মানসিক সুখের চেয়ে বেশি তীব্র।
(2) স্থায়িত্ব: ক্ষণস্থায়ী সুখের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী সুখ কামনা করা উচিত।
(3) নৈকট্য: ভবিষ্যতের প্রত্যাশিত সুখের তুলনায়, একই পরিমাণ বর্তমানের সুখই কাম্য।
(4) নিশ্চয়তা: অনিশ্চিত সুখের তুলনায় নিশ্চিত সুখ অধিক কাম্য।
(5) বিশুদ্ধতা: যে সুখের সঙ্গে দুঃখ কম পরিমাণে থাকে সেই সুখ অধিক দুঃখমিশ্রিত সুখের তুলনায় বিশুদ্ধ বলে কাম্য।
(6) উর্বরতা : কাম্যবস্তুৰূপে যে সুখ অন্যান্য অনেক সুখ সৃষ্টি করে-সেই সুখকে উর্বরতার জন্য কামনা করা উচিত।
(7) বিস্তৃতি : যে সুখ অনেক বেশি লোক ভোগ করতে পারে-তা বেশি বিস্তৃত বলে অধিকতর কাম্য।
৩। মিলের মার্জিত পরসুখবাদ বা মার্জিত উপযোগবাদ ব্যাখ্যা ও বিচার করো।
অথবা, “একটি সুখী শূকর অপেক্ষা একজন অতৃপ্ত সক্রেটিসের জীবন শ্রেয়”-এই বাক্যে কোন্ নৈতিক আদর্শ নিহিত আছে? নৈতিক আদর্শটি সবিচার আলোচনা করো।
মিলের মার্জিত পরসুখবাদ
মিল সুখবাদের আদর্শে বিশ্বাসী। সর্বাপেক্ষা অধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক পরিমাণ সুখ আমাদের কাম্যবস্তু। মিল পরসুখবাদের এই আদর্শ প্রচার করেন। মিল একজন মার্জিত পরসুখবাদী। তাই ব্যোমের স্থূল বা অমার্জিত পরসুখবাদকে মার্জিত করে অর্থাৎ সুখের গুণগত পার্থক্য স্বীকার করে মার্জিত পরসুখবাদ প্রবর্তন করেন।
(1) মিলের বক্তব্য: মিলের মতে সুখের মূল্য বিচার করার সময় গুণের উপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পরিমাণের উপর বেশি গুরুত্ব দিলে দৈহিক সুখ অধিক কাম্য বলে বিবেচিত হবে এবং মানুষ ও পশুতে পার্থক্য করা যাবে না। তাই মিলের মতে- “একটি সুখী শূকর হওয়ার চাইতে একজন অসুখী সক্রেটিস হওয়া অনেক শ্রেয়’ (It is better to be a human being dissatisfied than a pig satisfied; better to be Socrates dissatisfied than a fool satisfied”)।
(2) ভিত্তি: ব্যোমের মতো মিলের পরসুখবাদের ভিত্তি হল মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদ। তিনি তিনটি যুক্তির সাহায্যে তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করেছেন।
- প্রথম যুক্তি: প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের সুখ তার পক্ষে ভালো। সুতরাং সর্বসাধারণের সুখ সমষ্টিগতভাবে সকলের পক্ষে ভালো।
- দ্বিতীয় যুক্তি: মানুষ যদি স্বভাবত আত্মসুখী হয় তবে সে অপরের সুখ কামনা করবে। আসলে মানুষের নিজের সুখ কাম্য হলেও অপরের সুখের প্রতি সে উদাসীন থাকতে পারে না।
- তৃতীয় যুক্তি: মিল মনে করেন, যে নিয়ন্ত্রণের জন্য মানুষ পরার্থপর হয়, তা বাহ্যিক শাসন থেকে আসতে পারে না, তা আসে আন্তর নিয়ন্ত্রণ থেকে। অন্তরের নিয়ন্ত্রণের জন্য মানুষ পরার্থপর হয়। প্রতিটি মানুষের অন্তরে আছে মমত্ববোধ, আত্মসংযম, কর্তব্যবোধ, অপরের সঙ্গে একাত্মবোধের বাসনা। একেই তিনি আস্তর নিয়ন্ত্রণ বলেন। তিনি তিন প্রকার আন্তর নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন- আত্মনিয়ন্ত্রয়ণ, ন্যায়গত ও মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি।
(3) সমালোচনা: মিলের পরসুখবাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু আপত্তি দেখা যায়। যেমন-
- মিল যে নৈতিক সুখের কথা বলেছেন তার দ্বারা সর্বক্ষেত্রে কাজের ভালো-মন্দ বিচার করা
- যায় না। মিল যে মর্যাদাবোধের কথা বলেছেন যার দ্বারা মানুষ নিম্নতর সুখের থেকে উচ্চতর সুখে অগ্রসর হয় তা আসলে বিচারশক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন। এখানেই মিলের মতবাদ সুখবাদ থেকে সরে যায়।
- মিল যে আন্তর নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন, তার দ্বারা মিলের সুখবাদ বিচারবাদে পরিণত হয়।
৪। কর্তব্যমূলক নীতিতত্ত্ব বলতে কী বোঝো? এই মতের মূল বিষয়বস্তু সংক্ষেপে উল্লেখ করো।
অথবা, নৈতিক মতবাদরূপে কর্তব্যবাদ-এর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।
কর্তব্যমূলক নীতিতত্ত্ব
ফলমুখী তথা উদ্দেশ্যমুখী নৈতিক মতবাদের একটি বিপরীত মতবাদরূপে উঠে এসেছে কর্তব্যমুখী নৈতিক মতবাদ তথা কর্তব্যবাদ (Deontology) -এর আলোচনা। কর্তব্যবাদ অনুযায়ী দাবি করা হয় যে, কর্ম বা কর্মনীতির মূল্য হয় সর্বদাই স্বকীয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে কাজটি যথোচিত কিনা তা বিচার করতে কাজটির ফলাফলের উপর নির্ভর করতে হয় না।
(1) কর্তব্যবাদের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ: কর্তব্যবাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ‘Deontology’। এই শব্দটি গ্রিক ‘Deon’ শব্দটি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ‘Deon’ শব্দটির অর্থ হল কর্তব্য। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় যে ‘Deontology’ শব্দটির অর্থ হল কর্তব্যমুখী বা কর্তব্যনির্ভর মতবাদ।
কর্তব্যবাদের মূল বিষয়বস্তু
কর্তব্যবাদ অনুসারে দাবি করা হয় যে কোনো কর্ম বা কর্মনীতিকে যথোচিত বা ঠিক বলা যায় যদি এবং কেবল যদি ওই কর্ম বা কর্মনীতিটি স্বতঃমূল্যবান হয়। এইরূপ মতবাদে কর্ম বা কর্মনীতিকে তার নিজস্ব মূল্যের জন্যই যথার্থরূপে গণ্য করা হয়। কর্তব্যবাদীদের মতে ব্যক্তি বা সমাজের জন্য অকল্যাণের তুলনায় বেশি কল্যাণসাধন কখনোই নৈতিক আদর্শরূপে গণ্য হতে পারে না।
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে রক্ষা করার বিষয়। প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেই প্রতিশ্রুতিকে রক্ষা করতে গিয়ে যদি সমাজের বেশি কল্যাণ সাধণ নাও হয় তথাপি এরূপ কর্ম তার নিজ বৈশিষ্ট্যের জন্যই যথোচিতরূপে গণ্য।
(1) কর্তব্যবাদের বৈশিষ্ট্য: কর্তব্যবাদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
- নিয়মকেন্দ্রিকতা: কর্তব্যকেন্দ্রিক তত্ত্বে নির্দিষ্ট নিয়ম বা নীতির উপর ভিত্তি করে নৈতিকতার মূল্যায়ন করা হয়।
- কর্তব্য: এই মতবাদ অনুসারে কোনো কাজের মূলভিত্তি হল নৈতিক কর্তব্য। কাজটির ফলাফল কাজটি হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পালন করে না।
- অভিপ্রায় ও উদ্দেশ্য: কোনো কাজের অভিপ্রায় ও উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে যে সেই কাজটি নৈতিক নাকি অনৈতিক।
- লক্ষ্য: এই মতবাদ অনুসারে মানুষই হল নৈতিক কর্মের লক্ষ্য।
(2) কর্তব্যের জন্য কর্তব্য সাধন: কর্ম বা কর্মনীতির সততা যদি তার উদ্দেশ্য বা ফলাফলের উপর নির্ভরশীল হয় তাহলে অনেক সময় অনুচিত কর্ম বা কর্মনীতিকেও উচিত বলতে হয়। সেক্ষেত্রে লুণ্ঠন করা অর্থের সাহায্যে দরিদ্র মানুষের সেবা করাকেও ন্যায়সংগত বা যথোচিত বলতে হয়। কিন্তু তা কখনোই সম্ভব নয়। তাই সৎ কর্ম বা কর্মনীতিকে নিজ গুণেই সৎ হতে হয়।
(3) কর্তব্যবাদের দ্বিবিধরূপ: ফ্র্যাঙ্কেনা তাঁর Ethics নামক গ্রন্থে কর্তব্যবাদের দুটি রূপের উল্লেখ করেছেন। যথা-
- কর্ম কর্তব্যবাদ (Act-Deontological Theory)- কর্ম কর্তব্যবাদ অনুসারে দাবি করা হয় যে সার্বিক নৈতিক নিয়ম বলে কিছু নেই। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতি অনুসারে আমাদের কর্মের নৈতিক বিচার করতে হয়।
- নিয়ম বা নীতি কর্তব্যবাদ (Rule Deontological Theory)- নিয়ম বা নীতি কর্তব্যবাদ অনুসারে দাবি করা যায় যে নৈতিক নিয়মগুলি হল সর্বজনীন এবং তা সমস্ত ক্ষেত্রেই একই সার্বিক নৈতিক নিয়মকে অনুসরণ করে।
৫। কর্ম কর্তব্যবাদ কী? এর বিভিন্ন রূপ উল্লেখ করো। অথবা, কর্ম বা ক্রিয়া কর্তব্যবাদ তত্ত্বটি আলোচনা করো।
কর্ম কর্তব্যবাদ
অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্কেনা তাঁর Ethics গ্রন্থে দুই প্রকার কর্তব্যবাদের উল্লেখ করেছেন কর্ম বা ক্রিয়া কর্তব্যবাদ এবং নীতি কর্তব্যবাদ।
কর্ম বা ক্রিয়া কর্তব্যবাদ অনুসারে কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ কর্ম সম্পাদন করাকেই কর্তব্য বলা হয়। এক্ষেত্রে নৈতিক কর্তব্যবোধের অবধারণগুলি বিশেষ পর্যায়ে যুক্ত। যেমন- ‘এই অবস্থায় আমার এতটাই করা উচিত’, ‘আমাদের সর্বদাই প্রতিজ্ঞা পালন করা উচিত’ এই আকারের সামান্য নিয়মবিশিষ্ট অবধারণ অপ্রয়োজনীয়। এগুলি বিশেষ অবধারণ থেকেই পাওয়া যায় বলে মনে করা হয়।
কর্ম কর্তব্যবাদের বিভিন্ন রূপ
কর্ম কর্তব্যবাদীরা চরমপন্থী ও নরমপন্থী এই দুইভাগে বিভক্ত। উভয়েই পরিস্থিতি অনুসারে বিশেষ কর্মকে প্রাধান্য দিলেও নরমপন্থীরা কর্মনীতিরও উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু চরমপন্থীরা কর্মনীতিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেন।
(1) চরমপন্থী কর্ম কর্তব্যবাদ: চরমপন্থী ক্রিয়া কর্তব্যবাদীরা বলেন, প্রতিটি পৃথক পৃথক অবস্থার জন্য আমাদের নৈতিক কর্তব্য বিষয়ে কী করা উচিত সেটি নির্ণয় করতে হবে। আর এই বিষয়ে কোনো সাধারণ নিয়মের উপর নির্ভর করলে চলবে না। এই মতের প্রধান সমর্থক হলেন ক্যারিট, প্রিচার্ড, বাটলার প্রমুখ। চরমপন্থী কর্ম কর্তব্যবাদীরা বলেন, ‘কথা দিয়ে কথা রাখা উচিত’, ‘গচ্ছিত সম্পদ সর্বদা ফেরৎ দেওয়া উচিত’ এই জাতীয় কোনো সার্বিক নৈতিক নিয়ম নেই, থাকলেও তার কোনো প্রয়োগ নেই।
(2) নরমপন্থী কর্মকর্তব্যবাদ: নরমপন্থী কর্ম কর্তব্যবাদীরা বলেন যে, কোনো কাজ উচিত বা অনুচিত তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো নৈতিক আদর্শের প্রয়োজন হয় না, পরিস্থিতি বিচার করেই তা নির্ধারণ করতে হবে। তবে নরমপন্থীরা নৈতিক নিয়মের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করেন না।
এখন প্রশ্ন হল, বিশেষ পরিস্থিতিতে কোন্টা উচিত কাজ বা অনুচিত কাজ তা কীভাবে নির্ধারণ করা যেতে পারে? কর্ম কর্তব্যবাদীরা এই প্রসঙ্গে একটি পদ্ধতির উল্লেখ করেছেন। এই পদ্ধতি স্বজ্ঞাবাদীদের ‘স্বজ্ঞা’ হতে পারে অথবা অস্তিত্ববাদীদের ‘সিদ্ধান্ত’ হতে পারে। বিশেষ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে ব্যক্তি তার সাক্ষাৎ অনুভবের মাধ্যমে কোন্টা উচিত কর্ম তা নির্ধারণ করতে পারে অথবা বিশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে অস্তিত্ববাদীদের মত উচিত কাজটির সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
৬। কর্ম কর্তব্যবাদের গ্রহণযোগ্যতা আলোচনা করো।
অথবা, কর্ম কর্তব্যবাদের সমালোচনাগুলি উল্লেখ করো।
কর্ম কর্তব্যবাদের সমালোচনা
অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্কেনা তাঁর Ethics গ্রন্থে কর্ম কর্তব্যবাদের বিরুদ্ধে যে সমালোচনাগুলি উল্লেখ করেছেন, সেগুলি হল-
(1) পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও সম্পূর্ণ নতুন নয়: কর্ম কর্তব্যবাদীদের মতে, প্রত্যেকটি পরিস্থিতিই নতুন নতুন এবং ভিন্ন ভিন্ন। সুতরাং, নিত্য নতুন পরিস্থিতিই স্থির করে দেয় আমাদের ঠিক কী করণীয়। কর্ম কর্তব্যবাদীদের এরূপ যুক্তিটি কখনোই যথার্থ নয়। কারণ, প্রত্যেকটি পরিস্থিতি ভিন্ন ভিন্ন হলেও পরিস্থিতিগুলির নৈতিক বিচারের ক্ষেত্রে কিছু কিছু সাদৃশ্য থাকে। তাই বলা যায়, কোনো পরিস্থিতিই সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র ও সম্পূর্ণ নতুন হতে পারে না। সুতরাং কর্ম কর্তব্যবাদীদের দাবি সমর্থনযোগ্য নয়।
(2) নৈতিক অবধারণগুলি সার্বিক: কর্ম কর্তব্যবাদীরা যে পরিস্থিতির বিচারের কথা বলেছেন, সেগুলিকে তারা বিশেষ বিশেষ অবধারণের সাহায্যে ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। কিন্তু নৈতিক অবধারণগুলি কখনো বিশেষরূপে গণ্য হতে পারে না। তার মধ্যে একপ্রকার সার্বিকতা প্রচ্ছন্নভাবে থাকে।
(3) উদ্দেশ্যের বিভ্রান্তি: কর্ম কর্তব্যবাদীরা কর্ম কর্তব্যের ক্ষেত্রে কোনো নৈতিক মানদণ্ডের উল্লেখ করেননি, তারা শুধু পরিস্থিতির ঔচিত্যমূলক বিচার-বিশ্লেষণের কথা বলেছেন। কিন্তু আমাদের কর্ম কর্তব্যের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হল কেবল কর্ম কর্তব্যেরই নৈতিক বিচার করা। সেই কারণে বলা যায় যে, কর্ম কর্তব্যবাদীদের উদ্দেশ্যটি কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
(4) নিয়ম ব্যতীত কর্তব্যের বিচার অসম্ভব: কর্ম কর্তব্যবাদীরা নিয়ম ছাড়াই কেবল পরিস্থিতিকে বিচার করেই আমাদের করণীয় কর্তব্য স্থির করতে চেয়েছেন। আর তাই যদি হয়, তাহলে নিত্য-নতুন পরিস্থিতিগুলির বিচার কীভাবে সম্ভব? এর কোনো সদুত্তর কর্ম কর্তব্যবাদীরা দিতে পারেনি।
(5) স্বজ্ঞাবৃত্তির অস্বীকৃতি: কর্ম কর্তব্যবাদীরা স্বজ্ঞা (Intuition) -এর সাহায্যে পরিস্থিতির বিচার করতে চেয়েছেন এবং আমাদের করণীয় কর্তব্য স্থির করতে চেয়েছেন। কিন্তু মনোবৈজ্ঞানিকরা এইরূপ কোনো বৃত্তির কথা স্বীকার করেননি। তাছাড়াও উল্লেখ করা যায় যে, স্বজ্ঞা বা সাক্ষাৎ প্রতীতি বলে যদি কিছু থেকেই থাকে, তাহলে তার দ্বারা করণীয় কর্তব্যের বিষয়টি সকলের ক্ষেত্রেই একই হত, কিন্তু এমনটা হয় না। উপরোক্ত কারণেই কর্ম কর্তব্যবাদকে সর্বাঙ্গীণভাবে গ্রহণ করা যায় না। তবে নৈতিকতার ক্ষেত্রে এই মতবাদ অবশ্যই একটি উল্লেখযোগ্য মতবাদ এ কথা স্বীকার করতেই হয়।
৭। নীতি বা নিয়ম কর্তব্যবাদের মূল বক্তব্য বিষয়টিকে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
নিয়ম কর্তব্যবাদ
নৈতিকতার যে মানদণ্ড অনুসারে বলা হয়, মানুষের কোনো স্বেচ্ছাকৃত কর্মের ন্যায়-অন্যায় বিচার, সেই কর্মের নীতির উপর নির্ভর করে তাকে নীতি কর্তব্যবাদ বলা হয়।
(1) নীতি কর্তব্যবাদের সমর্থক: স্যামুয়েল ক্লার্ক, রিচার্ড প্রাইস, থমাস রিড, ডব্লিউ ডি রস, ইমানুয়েল কান্ট প্রমুখকে এইরূপ মতবাদের সমর্থক বলা হয়।
(2) নিয়ম কর্তব্যবাদের মূল বক্তব্য: নীতি বা নিয়ম কর্তব্যবাদের মূল বক্তব্যগুলি হল-
- কর্মের থেকে নিয়মকে প্রাধান্য দান: কর্মের থেকে নিয়মকে প্রাধান্য দান। নিয়ম বা নীতি কর্তব্যবাদ অনুসারে দাবি করা হয় যে, আমাদের কর্তব্যের নৈতিকতার আদর্শগুলি এক বা একাধিক নিয়ম বা নীতি দ্বারা গঠিত। এই সমস্ত কর্ম-নিয়ম উদ্দেশ্যমুখী নাও হতে পারে, আবার সেগুলি প্রচলিত নিয়ম-নীতি থেকেও ভিন্ন হতে পারে। এগুলি প্রকাশিতরূপে থাকতে পারে, আবার অপ্রকাশিত তথা প্রচ্ছন্নভাবেও অবস্থান করতে পারে। বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে আমাদের ঠিক কী করা উচিত, তা এই সমস্ত নিয়মের দ্বারাই নির্ধারিত হয়।
- মৌলিক নিয়মনীতি দ্বারা কর্তব্য নির্ধারণ: নীতি কর্তব্যবাদীদের মতে, নৈতিক নিয়মগুলি বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ বিশেষ কর্মের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে, আরোহ পদ্ধতির মাধ্যমে পাওয়া কোনো নৈতিক নিয়ম নয়। এগুলি হল- মৌলিক নৈতিক নিয়ম, যা আমাদের বিবেক থেকে নিঃসৃত।
নিয়ম বা নীতি কর্তব্যবাদীদের মূল কথা হল আমাদের একটি নির্দিষ্ট বিশেষ পরিস্থিতিতে ঠিক কী করা উচিত তা নির্ধারিত হয় কতগুলি মৌলিক নিয়মনীতি দ্বারা। এই ধরনের মৌলিক নিয়মনীতিগুলি হল সত্য বলার নিয়ম, প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার নিয়ম, চুক্তি বজায় রাখার নিয়ম ইত্যাদি।
(3) নিয়ম মাত্রই তার ব্যতিক্রম থাকে: নিয়ম বা নীতি কর্তব্যবাদে যে- সমস্ত নিয়ম বা নীতির উল্লেখ করা হয় সেগুলি কখনোই নির্বিরোধ নয়, আবার অব্যতিক্রমও নয়। এই নিয়মগুলির মধ্যে তাই বিরোধ ও ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। তা সত্ত্বেও বলা যায় যে, এই রূপ নীতিগুলিকে অনুসরণ করেই আমাদের কর্তব্য নির্ধারিত হয়।
৮। নীতি কর্তব্যবাদ বলতে কী বোঝো? এই মতবাদের সমালোচনাগুলি আলোচনা করো।
নীতি কর্তব্যবাদ
নৈতিকতার যে মানদণ্ড অনুসারে বলা হয় যে মানুষের কোনো স্বেচ্ছাকৃত কর্মের ন্যায়-অন্যায় বিচার, সেই কর্মের নীতিটির উপর নির্ভর করে অর্থাৎ কর্মনীতিকে কল্যাণ-অকল্যাণ এবং মৌলিক কর্মের দ্বারা বিচার করা হয়, তাকেই নীতি কর্তব্যবাদ বলা হয়।
নীতি কর্তব্যবাদের সমালোচনা
নীতি কর্তব্যবাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলি নিম্নরূপ-
(1) নৈতিক নিয়ম বিরোধহীন নয়: নৈতিক নিয়মের ক্ষেত্রে নীতিবিজ্ঞানী রস (Ross) – আপাত কর্তব্যগুলিকে ব্যতিক্রমহীনরূপে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু নীতিবিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্কেনা এই মত গ্রহণ করেননি। তাঁর মতে এই কর্তব্যগুলি প্রকৃতপক্ষে বিরোধহীন হয়, কারণ অনেক সময় আপত কর্তব্যের সঙ্গে বাস্তব কর্তব্যের বিরোধ দেখা যেতে পারে। এইরূপ বিরোধই প্রমাণ করে যে নৈতিক নিয়মগুলি বিরোধহীন নয়।
(2) নৈতিক নিয়ম ব্যতিক্রমহীন নয়: নীতি কর্তব্যবাদীদের মতে নৈতিক নিয়মগুলি ব্যতিক্রমহীন। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কেনা উল্লেখ করেছেন যে, নৈতিক নিয়মগুলিকে ব্যতিক্রমহীনরূপে একমাত্র তখনই উল্লেখ করা যায়, যখন নিয়মগুলির মধ্যে একপ্রকার ক্রমিক স্তরভেদ থাকবে। কিন্তু রস এমন কোনো স্তরভেদের নির্দেশ দেননি। সুতরাং বলা যায় যে, নৈতিক নিয়মগুলির ব্যতিক্রমতার বিষয়টিই প্রমাণিত হয়।
(3) কর্তব্য নিয়মগুলি অ-স্বতঃসিদ্ধ: নীতিবিজ্ঞানী রস আপাত কর্তব্যের কথা বললেও, তার প্রকৃত কোনো মানদণ্ড উল্লেখ করেননি। তিনি কর্তব্য বলতে বুঝিয়েছেন- ন্যায়পরায়ণতা, কৃতজ্ঞতা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি বিষয়গুলিকে। এগুলি স্বতঃসিদ্ধ এবং এগুলির বিচারের জন্য অন্য কোনো মানদণ্ডের প্রয়োজন নেই। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কেনা এরূপ অভিমতকে গ্রহণ করেননি। কারণ, ন্যায়পরায়ণতা, বিশ্বস্ততা-প্রভৃতি বিষয়গুলি কর্তব্যরূপে স্বতঃসিদ্ধ কিনা সে বিষয়ে সংশয় থাকে।
(4) মৌল নীতির অভাবে নিয়মগুলির পারস্পরিক বিরোধিতা: নীতিবিজ্ঞানী রস যে আপাত কর্তব্যের উল্লেখ করেছেন, তা কোনো একটি বিশেষ নিয়ম নয়, সেগুলি হল বহু নিয়মের সমষ্টি। ফ্র্যাঙ্কেনার মতে, এখানে একাধিক নিয়ম থাকায়, সেগুলির মধ্যে বিরোধের সম্ভাবনা থাকে। তাই আমাদের উচিত এমন একটি মতবাদ অনুসন্ধান করা, যেখানে একটিমাত্র মৌল নীতিকেই স্বীকার করা যায় এবং সমস্ত রকম বিরোধের অবসান হতে পারে।
৯। রসের মতে বাস্তব বা প্রকৃত কর্তব্য এবং আপাত বা দৃষ্টত কর্তব্য কী আলোচনা করো।
নীতিবিদ ডব্লিউ ডি রস কর্তব্যবাদের আলোচনায় দুই প্রকার কর্তব্যের কথা বলেছেন। যথা-
(a) বাস্তব বা প্রকৃত কর্তব্য (Actual Duty) এবং (b) আপাত বা দৃষ্টত কর্তব্য (Prima Facie Duty)।
বাস্তব বা প্রকৃত কর্তব্য
রস তাকেই প্রকৃত কর্তব্য বলেছেন যা নির্দিষ্ট কোনো পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয়। বাস্তব জীবনে আমরা এমন অনেক কাজকে আমাদের করা উচিত বলে মনে করি, যার সঙ্গে একই পরিস্থিতিতে অন্য কোনো কর্তব্যের বিরোধ দেখা দিতে পারে। বাস্তব পরিস্থিতিতে এমন কোনো কর্তব্যের বিধি থাকতে পারে না যা ব্যতিক্রমহীনভাবে কর্তব্য বলে গণ্য হতে পারে। প্রকৃত বা বাস্তব কর্তব্যের ক্ষেত্রে বিরোধ ও ব্যতিক্রমের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না। ‘প্রত্যেক নিয়মের ব্যতিক্রম আছে।’ যখন বলা হয় তখন তার অর্থ হল বাস্তব বা প্রকৃত কর্তব্যের প্রতিটি নিয়মের ব্যতিক্রম আছে।
আপাত বা দৃষ্টত কর্তব্য
আপাত কর্তব্য বলতে বোঝায় যেগুলি আপাতদৃষ্টিতে কর্তব্য বলে মনে হয়। আপাত কর্তব্যের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমহীন নিয়ম আছে। কোনো কর্তব্যকে আপাত কর্তব্য বলা যাবে যদি এবং কেবলমাত্র যদি সেই কর্মটি বিশেষ কোনো এক ধরনের কর্ম হয় (যেমন, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, পরের উপকার করা ইত্যাদি) এবং অন্য কোনো নৈতিক বিবেচনা যদি কর্মপালনের ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি না করে তাহলে কর্মটিকে বাস্তব কর্তব্য বলা যাবে।
রস মনে করেন যে, আমরা যাকে কর্তব্য বলে মনে করি সেগুলি সম্পর্কে এমন কতগুলি নিয়ম আমরা গঠন করতে পারি যেগুলি ব্যতিক্রমহীন; কিন্তু সেগুলি বাস্তব বা প্রকৃত কর্তব্য নাও হতে পারে। যেমন- ‘প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রক্ষা করা উচিত’-এই নিয়মটিকে আপাত কর্তব্যের নিয়ম বলা যায়, কারণ এক্ষেত্রে অন্য আর কিছু বিবেচনা না করে আমরা সবাই মনে করি যে, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা উচিত। কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা বাস্তবে রক্ষা করা সম্ভব নাও হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, আপাত কর্তব্য বলে যেগুলিকে বিবেচনা করা হয় সেখানে পরিস্থিতির কোনো উল্লেখ থাকে না।
উদাহরণ
আমার অফিসের কোনো কর্মচারীকে যদি আমি একদিনের ছুটি দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকি তাহলে তাকে একদিনের ছুটি দেওয়া আমার আপাতদৃষ্টিতে কর্তব্য বা আপাত কর্তব্য। আর যদি অন্য কোনো বিবেচনা এর বিরুদ্ধে না যায় তাহলে একদিনের ছুটি দেওয়া আমার প্রকৃত বা বাস্তব কর্তব্য।
১০। নিঃশর্ত আদেশ বিষয়ে কান্টের অভিমত ব্যাখ্যা করো।
মানুষের বিচারবুদ্ধিকে কান্ট দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে ভাগ করেছেন। একটি বিশুদ্ধ বুদ্ধি, অপরটি ব্যাবহারিক বুদ্ধি। বিশুদ্ধ গণিত ও যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে আমরা বিশুদ্ধ বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হই। নীতির ক্ষেত্রে আমরা ব্যাবহারিক বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হই। ব্যাবহারিক বুদ্ধির কাজ নৈতিক নিয়ম ব্যক্ত করা।
ব্যাবহারিক বুদ্ধি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের কাছে যে সর্বোচ্চ নৈতিক নিয়ম ব্যক্ত করে কান্ট তাকে শর্তহীন আদেশ বলেছেন। শর্তহীন আদেশ হল এমন এক ব্যক্তি-নিরপেক্ষ নীতি, যে নীতি অনুসারে প্রত্যেকটি সংযমী বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষের কাজের ফলাফল উপেক্ষা করে কাজ করা উচিত।
নৈতিক বিধি আমাদের কাছে শর্তহীন বা নিঃশর্ত আদেশ। এই বিধি আমাদের কাছে শর্তহীন আনুগত্য দাবি করে। এই বিধির নিজস্ব মূল্য আছে। বিধি সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না তুলে আমাদের কর্তব্য হবে এই বিধি অনুসরণ করা।
কান্ট তাঁর ‘Groundwork of the Metaphysics of Morals’ গ্রন্থে বলেছেন- “শর্তনিরপেক্ষ আদেশ একটি শর্তনিরপেক্ষ এবং ব্যক্তিনিরপেক্ষ নীতি”। এই নীতি অনুসারে প্রত্যেকটি বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাজ করা উচিত। কান্ট মনে করেন, যে ব্যক্তির কামনা বুদ্ধি বিচার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেই ব্যক্তি অবশ্যই এই আদেশ বিনা শর্তে অনুসরণ করবে।
কান্ট আদেশকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন, একটি শর্তহীন আদেশ, অপরটি শর্তসাপেক্ষ আদেশ। যে আদেশে শর্তের উল্লেখ থাকে তাকে শর্তসাপেক্ষ আদেশ বলে। যেমন- “যদি তুমি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চাও তবে কঠোর পরিশ্রম করো।” শর্তসাপেক্ষ আদেশের নিজস্ব কোনো মূল্য নেই। এই আদেশ কোনো লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উপায়স্বরূপ। অপরদিকে শর্তনিরপেক্ষ আদেশের মধ্যে কোনো শর্তের উল্লেখ থাকে না। বিনাশর্তে এই আদেশ পালন করা কর্তব্য। এইরূপ আদেশ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের উপায়স্বরূপ নয়।
১১। ফ্র্যাঙ্কেনার দৃষ্টিতে কান্টের নীতি কর্তব্যবাদ ব্যাখ্যা করো।
ফ্র্যাঙ্কেনার দৃষ্টিভঙ্গিতে কান্টের নীতি কর্তব্যবাদ ব্যাখ্যা করতে গেলে আগে আমাদের জানতে হবে যে নীতি কর্তব্যবাদ সম্পর্কে কান্ট স্বয়ং কী বলেছেন।
কান্টের নীতি কর্তব্যবাদ
জার্মান দার্শনিক কান্ট তাঁর নৈতিক মতবাদে অদ্বৈতবাদী নীতি কর্তব্যবাদ (Monistic Kind of Rule-Deontology) প্রতিষ্ঠা করেন। কান্টের মতে, চরম নৈতিক নিয়ম এক সার্বভৌম ‘নিঃশর্ত অনুজ্ঞা’ (Categorical Imperative), যা সব মানুষকে ওই অনুজ্ঞা বা আদেশ পালনে দায়বদ্ধ করে। সমাজের সকল স্তরের মানুষ ওই নিঃশর্ত অনুজ্ঞা পালনে বাধ্য থাকে এবং তা কোনো ফলাকাঙ্ক্ষার জন্য নয়, তা কেবল স্বতঃমূল্যবান ওই নিয়মটির জন্যই। কান্টের মতে, কোনো কর্মকে ‘উচিত কর্ম’ বলা যাবে যদি তা স্বতঃমূল্যবান এক সার্বত্রিক ও সার্বভৌম নৈতিক নিয়মকে অনুসরণ করে। সমাজে প্রচলিত নৈতিক নিয়মগুলি ওই এক ও অনন্য সার্বভৌম নৈতিক নিয়ম থেকেই অনুসৃত হয়।
কান্ট তাঁর নিঃশর্ত অনুজ্ঞার নিয়মটিকে এভাবে ব্যক্ত করেন যে, এমন কর্মনীতি অনুসারেই কর্ম করা উচিত যাকে একটি সর্বজনীন নিয়মরূপে গণ্য করা যায় বা যাকে সর্বজনীন নিয়মে পর্যবসিত করা যায়। সমাজে প্রচলিত যে নিয়মের ক্ষেত্রে এই সার্বত্রিক নিয়মটি প্রয়োগ করা যায় তা নৈতিক আর যে নিয়মের ক্ষেত্রে সার্বত্রিক নিয়মটি প্রয়োগ করতে গেলে অসংগতি দেখা দেয় তা অনৈতিক। কাজেই দাবি করা হয় যে, স্বেচ্ছাকৃত কর্মের নৈতিক গুণাগুণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিঃশর্ত অনুজ্ঞার নিয়মটি একাধারে যেমন একটি আবশ্যিক শর্ত (নিঃশর্ত অনুজ্ঞার নিয়মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হলে কোনো কর্ম-নিয়ম নৈতিক হবে না) তেমনি একটি পর্যাপ্ত শর্ত (নিঃশর্ত অনুজ্ঞার নিয়মটির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হলে তবেই কোনো কর্ম নিয়ম নৈতিক হবে)।
ফ্র্যাঙ্কেনার দৃষ্টিতে কান্টের নীতি কর্তব্যবাদ
কিন্তু অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্কেনার মতে, নিঃশর্ত অনুজ্ঞার নিয়মটিকে আবশ্যিক শর্তরূপে গ্রহণ করা গেলেও পর্যাপ্ত শর্তরূপে গ্রহণ করা যায় না। ফ্র্যাঙ্কেনা কান্টের নীতি কর্তব্যবাদকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন-
- প্রথমত: স্বেচ্ছাকৃত কর্মের ক্ষেত্রে কর্তা সর্বদা সূত্রাকারে কোনো নিয়ম অনুসরণ করে।
- দ্বিতীয়ত: নৈতিক হতে গেলে কোনো নিয়মকে সার্বত্রিক হতে হয় একইরকম পরিস্থিতিতে সবাই একই নিয়ম অনুসরণ করে কাজ করবে এমন হতে হয়।
- তৃতীয়ত: নৈতিকভাবে কোনো কাজকে যথোচিত বা বাধ্যতামূলক বলা যাবে যদি এবং কেবল যদি কাজটিকে সার্বিক নিয়মের অন্তর্ভুক্ত করতে গেলে কোনো অসংগতি দেখা না দেয়। কান্ট প্রদত্ত একটি দৃষ্টান্ত নিয়ে ফ্র্যাঙ্কেনা বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দৃষ্টান্তের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দিয়ে কেউ যদি নিজের সুবিধামতো প্রতিশ্রুতি না রাখতে চায় তাহলে তার কর্মনীতিটিকে এভাবে প্রকাশ করতে হবে যে- “আমার সুবিধামতো আমি প্রতিশ্রুতি দেব এবং আবার আমার সুবিধামতো আমি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করব।” কিন্তু এই নিয়মটিকে ওই ব্যক্তি সার্বত্রিক হোক (অর্থাৎ সবাই তাদের ইচ্ছামত প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করুক) এমন কামনা করতে পারে না, কেন-না তাতে অসংগতি দেখা দেয়।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর