প্যাভলভের প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্ব | Pavlov’s Classical Conditioning (Class 11 Exclusive )

যদি কোনো স্বাভাবিক উদ্দীপকের সঙ্গে বা ঠিক পূর্বে একটি কৃত্রিম বা বিকল্প উদ্দীপক বারবার উপস্থাপন করা হয়, তবে ওই স্বাভাবিক উদ্দীপকটি কৃত্রিম উদ্দীপকের সঙ্গে যুক্ত হবে এবং স্বাভাবিক উদ্দীপক যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, কৃত্রিম উদ্দীপকও সেই প্রতিক্রিয়া ঘটাবে। একেই প্যাভলভীয় অনুবর্তন বা সাপেক্ষীকরণ বলে।

প্যাভলভের প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্ব
প্যাভলভের প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্ব

প্যাভলভের প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্ব [Pavlov’s Classical Conditioning]

রাশিয়ান শারীরতত্ত্ববিদ আইভান প্যাভলভ (Ivan Pavlov) এই তত্ত্বের প্রবক্তা। এটি শারীরবৃত্তীয় ব্যাখ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ, প্যাভলভের মতে প্রাণী পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বাহ্যিক উদ্দীপনা সংগ্রহ করে এবং বহির্জগৎ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। তাঁর মতে, যে-কোনো প্রাণীর মধ্যে কোনো একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির জন্য নির্দিষ্ট কিছু উদ্দীপক থাকে এবং যে- কোনো অবস্থাতেই এই উদ্দীপকগুলি একই ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। প্যাভলভ এই উদ্দীপকগুলিকেই স্বাভাবিক উদ্দীপক এবং প্রতিক্রিয়াগুলিকে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বলেছেন। তাঁর মতে, স্বাভাবিক উদ্দীপক এবং স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার সংযোগ পূর্বনির্ধারিত। এই প্রতিক্রিয়া অর্জিত বা শিক্ষাপ্রসূত নয়।

প্যাভলভের মতে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বেশিরভাগ শিখন এইভাবেই ঘটে।

(1) প্যাভলভের পরীক্ষা: 

প্যাভলভের অনুবর্তন-সংক্রান্ত বিভিন্নপরীক্ষার মধ্যে কুকুরের লালাক্ষরণ সম্পর্কিত পরীক্ষাটি উল্লেখযোগ্য। একটি ক্ষুধার্ত কুকুরের সামনে কিছু খাবার দেওয়া হল, দেখা গেল লালাক্ষরণ হচ্ছে। লালাক্ষরণ হল চোখের সামনে খাদ্যবস্তুকে দেখার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তিনি লালাক্ষরণের পরিমাণ পরিমাপেরও ব্যবস্থা করেছিলেন। এরপর প্রতিদিন এই পরীক্ষামূলক পরিস্থিতিতে কুকুরের সামনে খাবার দেওয়ার আগে কুকুরটিকে খাবার সম্পর্কে সচেতন করার জন্য ঘণ্টার শব্দ শোনানো হয়। ঘণ্টার শব্দ শেষ হওয়ার আগেই খাদ্যবস্তু দেওয়া হয়।

কিছুদিন এইভাবে পুনরাবৃত্তি করার পর দেখা গেল, ঘণ্টাধ্বনি শোনামাত্র কুকুরটির লালাক্ষরণ শুরু হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ঘণ্টার শব্দের সঙ্গে লালাক্ষরণের কোনো সম্পর্ক নেই। ঘণ্টার শব্দের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হল সজাগভাব। তাই প্রথম প্রথম ঘণ্টাধ্বনি শোনামাত্র কুকুরটির মধ্যে সজাগভাব দেখা গিয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষাটির পুনরাবৃত্তি করার ফলে ঘণ্টাধ্বনি উদ্দীপকের সঙ্গে লালাক্ষরণ যুক্ত হল। ঘণ্টাধ্বনি উদ্দীপক হিসেবে খাদ্যকে প্রতিস্থাপন করে লালাক্ষরণের প্রতিক্রিয়া ঘটাল। একেই প্যাভলভ বলেন অনুবর্তিত আবর্তক্রিয়া (Conditional Reflex Action)। বর্তমানে একে অনুবর্তিত প্রতিক্রিয়া বলে (Conditioned Response)। পরীক্ষাটির মূল কাঠামোটি নিম্নরূপ-

খাদ্যবস্তু যখন লালাক্ষরণ ঘটায় তখন লালাক্ষরণ স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এই পরীক্ষায় যখন ঘণ্টাধ্বনি লালাক্ষরণ ঘটায় তখন লালাক্ষরণ হল অনুবর্তিত প্রতিক্রিয়া এবং ঘণ্টাধ্বনি হল অনুবর্তিত উদ্দীপক।

(2) প্রাচীন অনুবর্তনের বৈশিষ্ট্য: 

প্রাচীন অনুবর্তনের ক্ষেত্রে প্রধানত যে বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করা যায়, সেগুলি সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল-

  1. অনুবর্তিত উদ্দীপকের উপস্থাপন: যে উদ্দীপকটিকে অনুবর্তিত করতে হবে সেই উদ্দীপকটিকে স্বাভাবিক উদ্দীপকের আগে উপস্থিত করতে হবে। এই কারণে প্যাভলভের পরীক্ষায় ক্ষুধার্ত কুকুরকে খাবার দেওয়ার আগে ঘণ্টাধ্বনি শোনানো হয়েছিল।
  2. স্বাভাবিক উদ্দীপকের কার্যকারিতা: স্বাভাবিক উদ্দীপকের শক্তি অনুবর্তিত উদ্দীপকের চেয়ে বেশি। কুকুরের লালাক্ষরণের ক্ষেত্রে খাদ্যবস্তু ঘণ্টাধ্বনির থেকে বেশি শক্তিশালী উদ্দীপক।
  3. উদ্দীপক দুটির পর্যায়ক্রমিক উপস্থাপন: বিকল্প বা নিরপেক্ষ উদ্দীপকের (এখানে ঘণ্টাধ্বনি) রেশ থাকতে থাকতেই স্বাভাবিক উদ্দীপককে (খাদ্য) উপস্থাপন করতে হবে। প্যাভলভের পরীক্ষায় সেজন্য ঘণ্টাধ্বনির রেশ থাকতে থাকতেই খাবার দেওয়া হত।
  4. উদ্দীপক দুটির পুনরাবৃত্তি: স্বাভাবিক উদ্দীপক (খাদ্য) এবং বিকল্প বা নিরপেক্ষ উদ্দীপককে (ঘণ্টাধ্বনি) একই ক্রমে বারবার উপস্থাপিত করতে হবে, যতক্ষণ না অনুবর্তন প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়।
  5. অপানুবর্তন: অনুবর্তনকে স্থায়ী করতে হলে ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে মাঝে মাঝে স্বাভাবিক উদ্দীপক অর্থাৎ খাদ্যবস্তু দিতে হবে। অনুবর্তনের পর দীর্ঘ সময়ব্যাপী যদি খাদ্য না দেওয়া হয়, তাহলে ক্রমশ লালাক্ষরণের (অনুবর্তিত প্রতিক্রিয়া) পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকবে এবং অবশেষে তা বন্ধ হয়ে যাবে। একে অপানুবর্তন বলে।
  6. অনুবর্তনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রত্যাবর্তন: অপানুবর্তনের পরে যদি ঘটনাটিকে পুনরায় কয়েকবার পরীক্ষামূলক পরিস্থিতিতে আনা হয় (অর্থাৎ ঘণ্টাধ্বনি খাদ্য) তাহলে অনুবর্তন প্রতিক্রিয়াটি কিছু সময় পর পুনরায় ফিরে আসে। একেই অনুবর্তনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রত্যাবর্তন বলে।
  7. উদ্দীপক নির্দিষ্টকরণ: স্বাভাবিক উদ্দীপকের সঙ্গে যদি একাধিক গৌণ উদ্দীপক থাকে, তাহলে কোন্ উদ্দীপকটি অনুবর্তিত হবে তা নির্ভর করবে প্রাণীর ওপর। খাদ্যবস্তু দেওয়ার আগে যদি ঘণ্টাধ্বনি ছাড়াও আলো জ্বালানো হয় বা কুকুরটিকে স্পর্শ করা হয় সেক্ষেত্রে কোন্ উদ্দীপকটির অনুবর্তন ঘটবে তা নির্ভর করবে কুকুরটির ওপর।
  8. আচরণ পৃথকীকরণ ও সামান্যীকরণ: অনুবর্তনের সাহায্যে প্রাণীর মধ্যে আচরণ পৃথকীকরণ ও সামান্যীকরণ করা যায়। সার্কাসের লোকেরা এর সাহায্যে জীবজন্ধুদের দিয়ে অনেক জটিল খেলা দেখান।
  9. বয়স ও প্রাণীভেদে পার্থক্য: বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের এবং ইতর প্রাণীদের ক্ষেত্রে অনুবর্তন সৃষ্টি করা অপেক্ষাকৃত সহজ।

(3) শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাচীন অনুবর্তন প্রতিক্রিয়ার ব্যবহার: 

নিম্নশ্রেণির প্রাণী থেকে শুরু করে মানবশিশুর শিখনে প্যাভলভীয় প্রাচীন অনুবর্তন প্রক্রিয়ার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এই তত্ত্বের শিক্ষাগত তাৎপর্যগুলি হল-

  1. শিশুর ভাষাশিক্ষা: শিশুর ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাচীন অনুবর্তন প্রতিক্রিয়ার বিশেষ ভূমিকা দেখা যায়। শিশুকে ভাষা শেখানোর সময় কোনো একটি বিশেষ বস্তু বা ব্যক্তিকে দেখিয়ে বিশেষ একটি শব্দ বারবার উচ্চারণ করলে শিশুর কাছে ওই শব্দটি বস্তুর সঙ্গে অনুবর্তিত হয় এবং শব্দটি অর্থযুক্ত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, শব্দটি শিশুর শব্দভান্ডারে যুক্ত হয়। যেমন, একজন মহিলাকে দেখিয়ে বারবার ‘ঠাকুরমা’ শব্দটি উচ্চারণ করলে ওই মহিলাই শিশুর কাছে ‘ঠাকুরমা’ হয়ে ওঠেন। অনুবর্তিত হওয়ার আগে ‘ঠাকুরমা’ শব্দটি শিশুর কাছে অর্থহীন ছিল। বারবার মহিলার সঙ্গে ‘ঠাকুরমা’ শব্দটি যুক্ত হওয়ার ফলে শিশুর অনুবর্তন ঘটে এবং ‘ঠাকুরমা’ শব্দটি অর্থযুক্ত হয়ে ওঠে।
  2. শিশুর শিখন: শিশুর শিখন বিশেষ ক’রে বর্ণ, শব্দ, নামতা ইত্যাদি শিখনে অনুবর্তনের প্রভাব দেখা যায়।
  3. অভ্যাস গঠন: অভ্যাস গঠনে প্রাচীন অনুবর্তনের বিশেষ অবদান আছে। এই কারণে শিশুর মধ্যে কোনো অভ্যাস গড়ে তুলতে হলে অনুবর্তন কৌশল ব্যবহার করা যায়। প্রাপ্তবয়স্কদের অভ্যাস গঠনের ক্ষেত্রেও অনুবর্তনের প্রভাব দেখা যায়।
  4. কু-অভ্যাস দূরীকরণ: বানান ভুল, অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ, মুদ্রাদোষ ইত্যাদি অবাঞ্ছিত অভ্যাস দূরীকরণে অনুবর্তন কৌশল ব্যবহৃত হয়।
  5. প্রাক্ষোভিক বিকাশ: প্রাক্ষোভিক বিকাশে অনুবর্তন সাহায্য করে। মানুষের জীবনে জটিল প্রক্ষোভ (ভাবাবেগ) অনুবর্তনের ফল। প্রক্ষোভে উদ্দীপকের ব্যাপকতা অনুবর্তনের কারণেই ঘটে।
  6. শিশুর আগ্রহ বা অনাগ্রহ সৃষ্টি: শ্রেণি-শিখনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পাঠ্যবিষয়ে শিক্ষার্থীর আগ্রহ বা অনাগ্রহ অনুবর্তনের ফল। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকশিক্ষিকার প্রতি পছন্দ-অপছন্দ তিনি যে বিষয় পড়ান তাতে অনুবর্তিত হয়। এই বিষয়ে শিক্ষকশিক্ষিকাদের বিশেষ সতর্ক থাকতে হয়।
  7. শিক্ষকের আচরণ ও অনুবর্তন: শিক্ষকশিক্ষিকার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, ভয়, ঘৃণা ইত্যাদি তাদের আচার- আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, অভ্যাস প্রভৃতির সঙ্গে শিক্ষার্থী অনুবর্তিত হয়ে যায়। শ্রেণিকক্ষের মধ্যে বা বাইরে শিক্ষকের আচার-আচরণ, অভ্যাস, শিক্ষার্থীদের প্রতি ব্যবহার প্রভৃতি এমন হওয়া উচিত যাতে অনুবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপযুক্ত অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে।

(4) প্রাচীন অনুবর্তন তত্বের সমালোচনা: 

প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্ব শিখনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। যেমন- সমস্ত ধরনের শিখনকে এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নয়। বিশেষ করে ধারণা শিখন, সমস্যা সমাধানের মতো উচ্চস্তরের শিখনকে এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারে না। নিম্নতর প্রাণী এবং শিশুদের শিখনে এই তত্ত্ব যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও বয়স্কদের শিখনে এই তত্ত্ব বিশেষ কার্যকরী নয়।

আরও পড়ুনLink
ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তরClick Here
তেলেনাপোতা আবিষ্কার বড় প্রশ্ন উত্তরClick Here
আগুন নাটকের প্রশ্ন উত্তরClick Here

Leave a Comment