কেন এল না কবিতার প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা | সুভাষ মখোপাধ্যায় | Class 12 keno elo na kobitar long question answer | WBCHSE

Table of Contents

কেন এল না কবিতার প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা | সুভাষ মখোপাধ্যায় | Class 12 keno elo na kobitar long question answer | WBCHSE

কেন এল না কবিতার প্রশ্ন উত্তর
কেন এল না কবিতার প্রশ্ন উত্তর

১। “সেই মানুষ এখনও এল না।” -কার, কখন এ কথা মনে হয়েছিল? তার মনের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল? ২+৩

পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কেন এল না’ কবিতায় উল্লিখিত ছেলেটির মা প্রশ্নোদ্ভূত মন্তব্যটি করেছে।

সারাটা দিন আপন মনে আনন্দে কাটানো ছেলেটি রাস্তায় আলো জ্বলে ওঠার পরে বাবা বাড়ি না ফেরায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। মা-র কাছে ছেলেটি জানতে চায়-“রাস্তায় আলো জ্বলেছে অনেকক্ষণ; এখনও/বাবা কেন এল না, মা?” উল্লিখিত অংশে এই উদ্বেগই ছেলেটির মা-র মধ্যেও সঞ্চারিত হতে দেখা যায়।

ছেলেটির বাবা অফিসে যাওয়ার সময়ে বলে গিয়েছিলেন যে, মাইনে নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন; কারণ পুজোর কেনাকাটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হবে। সেই মানুষটা সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পরেও না ফেরায়, মা মানসিকভাবে অস্থির হয়ে ওঠেন। কড়ার গায়ে খুন্তির অনাবশ্যক নড়াচড়ায় কিংবা ফ্যান গালতে গিয়ে পা পুড়ে যাওয়ায় এই অস্থিরতারই প্রকাশ ঘটে।

২। “সামনে ইতিহাসের পাতা খোলা”-কোন্ প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছে? ইতিহাসের খোলা পাতা কী নির্দেশ করে? ২+৩

‘জ্ঞানপীঠ’ পুরস্কারে সম্মানিত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কেন এল না’ কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র কিশোরটি সন্ধ্যার আলো জ্বলে ওঠার পরেও বাবা বাড়িতে না ফেরায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। সেই অস্থিরতা সঞ্চারিত হয় ছেলেটির মা-র মধ্যেও। তিনি অন্যমনস্কভাবে কড়ায় খুন্তি নাড়তে থাকেন, এই কারণেই ফ্যান গালতে গিয়ে তার পা পুড়ে যায়। এই আবহেই জানলার দিকে মুখ করে ছেলেটি বই নিয়ে বসে মাদুরে। সামনে খোলা থাকে ইতিহাসের বইয়ের পাতা। ইতিহাসের খোলা পাতা কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। ইতিহাস শুধু অতীতের ধারাবিবরণী নয়; তার সংযুক্তি জীবনের চলমানতার সঙ্গে। আজকের দিন তাই আগামীর ইতিহাস। এই অবিরাম নির্মাণের ধারাবাহিকতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে ‘কেন এল না’ কবিতার প্রেক্ষাপট। মানুষের ভয়াবহ খাদ্যসংকট, প্রতিবাদ-আন্দোলন, নিপীড়ন এবং ক্রমশ অশান্ত হয়ে ওঠা সামাজিক প্রেক্ষাপটে কবিতায় ছেলেটির বাবার না ফিরে আসা যেন সময়ের অস্থিরতার সূচক হয়ে থাকে। ইতিহাসের খোলা পাতা হয়তো অপেক্ষা করে থাকে তাকে আগামীর ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গীভূত করার জন্য।

৩। “হিজিবিজি অক্ষরগুলো একগুঁয়ে/অবাধ্য”-‘হিজি অক্ষরগুলো’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? তাদের অবাধ্যতার কারণ আলোচনা করো। ২+৩

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কেন এল না’ কবিতায় যে কিশোরের কথা আছে সন্ধ্যা হলে সে ইতিহাস বই খুলে বসে, কিন্তু মানসিক অস্থিরতার জন্য কোনো কিছুই সে আত্মস্থ করতে পারে না। সে কারণেই বইয়ের অক্ষরগুলো তার সামনে নিছকই হিজিবিজি হয়ে থেকে যায়, ‘বাপের-আদরে-মাথা-খাওয়া ছেলের মত’।

কিশোর চরিত্রটির বাবা সকালবেলায় বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলেন যে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসবেন। সমস্ত দিন কৈশোরের উদ্দামতা অতিবাহনের পরে রাস্তায় যখন আলো জ্বলে ওঠে, ছেলেটি তখন বাবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। কারণ বাবা বলে গিয়েছিলেন যে, পুজোর কেনাকাটা তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে। কিশোর মন অপেক্ষায় অধীর হয়ে থাকে। সময় এগিয়ে চলে, স্তব্ধতা গ্রাস করে চারপাশকে, কিন্তু ছেলেটির অস্থিরতার অবসান ঘটে না।

“যতক্ষণ পুজোয় জামা কেনা না হচ্ছে/নড়বে না।” তাই পাঠে মনোযোগ থাকে না, ইতিহাসের বইয়ের অধ্যায়গুলো ‘হিজিবিজি অক্ষর’-এর সমষ্টি হয়েই থেকে যায়।

৪। “মা এখন বুনতে বসে/কেবলি ঘর ভুল করছে।” -মা-এর এই অবস্থার কারণ কী ছিল? তাকে যে অস্থির রূপে এই কবিতায় দেখা যায় নিজের ভাষায় লেখো। ২+৩

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কেন এল না’ কবিতায় উল্লিখিত কিশোর ছেলেটির মা রাত্রি হয়ে গেলেও তার স্বামী বাড়িতে না ফিরে আসার কারণে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন।

কবিতায় উল্লিখিত কিশোরের বাবা বলে গিয়েছিলেন যে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসবেন, কিন্তু রাত্রি নেমে এলেও তিনি না ফেরায় ছেলে অস্থির হয়ে ওঠে এবং সেই অস্থিরতা সঞ্চারিত হয় ছেলেটির মা-র মধ্যেও। যে মানুষ বলে গিয়েছিল মাইনে নিয়ে সকাল সকাল ফিরবে, আর পুজোর কেনাকাটা তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে-সন্ধ্যা নেমে এলেও তার বাড়িতে না ফেরা উদ্বিগ্ন করে তোলে মা-কে। সেই অস্থিরতার কারণে কড়ায় খুন্তি নাড়তে থাকে। অন্যমনস্ক থাকায় ফ্যান গালতে গিয়ে পা পুড়ে যায়। ছেলের সামনে যখন ইতিহাস বইয়ের পাতা খোলা থাকে কিন্তু পড়ায় মন থাকে না, সেই সময়ে সম-অস্থিরতা মা-র মধ্যেও দেখা যায়। রান্না শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে, স্নানও হয়ে গেছে, কিন্তু স্বামী বাড়ি ফেরেননি, অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। মা-র আচরণে তাই বারেবারে উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। উল বুনতে বসে কেবলই ঘর ভুল হয়ে গিয়েছে।

৫। “খুট করে একটা শব্দ-/ছিটকিনি খোলার।”-এই শব্দ কে শুনেছিলেন? এর পরবর্তী ঘটনাক্রম কী ছিল? ২+৩

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কেন এল না’ কবিতায় উল্লিখিত ছিটকিনি খোলার শব্দটি শুনেছিলেন কবিতার অন্যতম চরিত্র কিশোর ছেলেটির মা।

ছেলেটির বাবা বলে গিয়েছিলেন মাইনে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসবেন। পুজোর কেনাকাটা শীঘ্র সেরে ফেলতে হবে। কিন্তু সন্ধ্যা নামলেও, রাস্তায় আলো জ্বলে উঠলেও বাবা বাড়ি না ফেরায় ছেলে অস্থির হয়ে পড়ে। তার সামনে খোলা থাকে ইতিহাস বই, কিন্তু তা তখন ছেলেটির কাছে নিছকই কিছু হিজিবিজি অক্ষরমাত্র। সেই অস্থিরতা থেকেই সে বাইরে আসতে চায়। তখনই মা-র কানে আসে ছিটকিনি খোলার আওয়াজ। গলির মুখে গিয়ে দাঁড়ায় ছেলেটি। রেডিয়োতে তখন খবর পড়া চলছে। ‘একটু এগিয়ে দেখবে বলে’ ছেলেটি রাস্তায় গিয়ে নামল। রাস্তার মোড়ে তখন ভিড়। খুব বাজি ফোটার শব্দ শুনল ছেলেটি। কীসের পুজো দেখার জন্য ছেলেটি রাস্তায় এগিয়ে গেল। বন্দুকে গুলির শব্দ তারা চেনা নয়, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কালো গাড়ির ইঙ্গিত তার অজানা। কিন্তু অস্থির এবং অরাজক সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছে তার পরিণতি। মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে অনেক রাত্রে বাবা ফিরে আসেন, কিন্তু ছেলে ফেরে না। ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের আগ্রাসনে বলিপ্রদত্ত হতে হয় তাকে।

৬। “একটা কালো গাড়ি; আর খুব বাজি ফুটছে” -এই চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে কবি কোন্ বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের ভাষায় লেখো।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কেন এল না’ কবিতাটি এক অস্থির সাম্প্রতিকের মর্মস্পর্শী উপস্থাপন। সেখানে একটা কালো গাড়ি আর বাজি ফোটার যে চিত্রকল্প, তা সেই সমকালীন সময়েরই নির্মম রূপায়ণ। রাস্তার মোড়ে থাকা কালো গাড়ি আসলে পুলিশ-ভ্যান। কবিতার কেন্দ্রে থাকা ছেলেটির বাবা বলে গিয়েছিলেন মাইনে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসবেন, ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন পুজোর বাজার আগে আগেই করে নেবেন। কিন্তু রাস্তার আলো জ্বলে ওঠার পরেও বাবা ফিরে না আসায় ছেলেটি এবং তার মা অস্থির হয়ে পড়ে। একসময় ছেলেটি বাবা ফিরছে কি না দেখতে কিংবা তার দেরি হওয়ার কারণ বুঝতে দরজা খুলে বাইরে যায়। গিয়ে দাঁড়ায় গলির মুখে। তারপরে ‘একটু এগিয়ে দেখবে বলে’ রাস্তায় পা দেয়। ছেলেটা দেখল রাস্তার মোড়ে ভিড়, একটা কালো গাড়ি, আর শুনতে পেল খুব বাজি ফুটছে। যাকে সে বাজি ফোটার শব্দ ভেবেছিল তা আসলে গুলির শব্দ। কিন্তু ছেলেটির অভিজ্ঞতায় তা ছিল না, যেমন সে জানত না কালো ভ্যানের স্বরূপ। ‘কিসের পুজো আজ?’-এই ভাবনা ছেলেটিকে কৌতূহলী করে তুলেছিল। সেই কৌতূহল নিবৃত্ত করতে সহজ মনে পুজো দেখতে যাওয়া ছেলেটি তাই সময়ের কাছে বলিপ্রদত্ত হয়ে চিরকালের মতো নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। গভীর রাত্রে অলিগলি ঘুরে ‘মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে’ বাবা ফিরে আসে, কিন্তু ছেলে ফেরে না। শতচ্ছিন্ন সময়ের কাছে বলিপ্রদত্ত হয় সবুজ কৈশোর।

৭। “ছেলেটা দেখে আসতে গেল।”-ছেলেটা কী দেখে আসতে গিয়েছিল? তার পরিণাম কী হয়েছিল? ৩+২

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কেন এল না’ কবিতায় উল্লিখিত কিশোর ছেলেটির বাবা বলে গিয়েছিলেন, মাইনে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসবেন। ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন পুজোর বাজার আগে আগেই করে নেবেন বলে। কিন্তু রাস্তার আলো জ্বলে ওঠার পরেও বাবা ফিরে না আসায় ছেলেটি এবং তার মা অস্থির হয়ে পড়ে। একসময় ছেলেটি বাবা ফিরছে কি না দেখতে কিংবা তার দেরি হওয়ার কারণ বুঝতে দরজা খুলে বাইরে যায়। গিয়ে দাঁড়ায় গলির মুখে। তারপরে ‘একটু এগিয়ে দেখবে বলে’ রাস্তায় পা দেয়। ছেলেটা দেখল রাস্তার মোড়ে ভিড়, একটা কালো গাড়ি, আর শুনতে পেল খুব বাজি ফুটছে। ‘কিসের পুজো আজ?’ -ছেলেটি কৌতূহলী হয়ে উঠল, সেই কৌতূহলই সে নিবৃত্ত করতে চেয়েছিল।

ছেলেটি জানত না, যাকে সে বাজি ফোটার শব্দ ভেবেছিল তা আসলে গুলির শব্দ। তার অভিজ্ঞতায় ছিল না রাস্তার মোড়ে থাকা কালো গাড়ি আসলে পুলিশ-ভ্যান। অর্থাৎ সময়ের উত্তেজনা, তার ক্ষত-বিক্ষত চেহারা ছিল ছেলেটির ধারণার অতীত। সহজ মনে পুজো দেখতে যাওয়া ছেলেটি তাই সময়ের কাছে বলিপ্রদত্ত হয়ে চিরকালের মতো নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। গভীর রাত্রে অলিগলি ঘুরে ‘মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে’ বাবা ফিরে আসে, কিন্তু ছেলে ফেরে না।

৮। “বাবা এল।/ ছেলে এল না।”-এই ফিরে আসা এবং না-আসার তাৎপর্য কবিতা অবলম্বনে আলোচনা করো।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কেন এল না’ কবিতায় ছেলেটি বেরিয়েছিল তার বাবার সন্ধানে। ছেলেটির বাবা প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন যে, মাইনে নিয়ে সকাল সকাল বাড়ি ফিরে আসবেন এবং পুজোর বাজার আগে আগেই সেরে আসবেন। কিন্তু সন্ধ্যা নেমে আসলেও এবং রাস্তার আলো জ্বলে উঠলেও বাবা ফিরে আসেন না। অস্থিরতায় ছেলেটি পড়ায় মন বসাতে পারে না। একসময় দরজার ছিটকিনি খুলে সে গলির মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। হয়তো বাবার দেরি হওয়ার কারণ বুঝতে চায়। একটু এগিয়ে দেখবে বলে ছেলেটা রাস্তায় পা দেয়। সেখানে রাস্তার মোড়ে ভিড়, অপেক্ষমান পুলিশের গাড়ি। আর প্রচুর বাজির শব্দ। ছেলেটা দেখে আসতে চায় কী পুজো হচ্ছে। ছেলেটার জানা ছিল না, যাকে সে বাজির শব্দ ভেবেছিল তা আসলে বন্দুকের গুলির শব্দ, কালো গাড়ি আসলে পুলিশি তৎপরতার ইঙ্গিত। স্বাভাবিক কৌতূহলে পুজো দেখতে যাওয়া ছেলেটি শুধু সময়ের বিরুদ্ধতাকে বুঝতে পারেনি বলে চিরকালের মতো নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের খাদ্যসংকট, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে মানুষের সংঘবদ্ধ আন্দোলন, পুলিশি অত্যাচার ইত্যাদির আবহ থেকে জন্ম নেওয়া ‘কেন এল না’ কবিতায় সময়ের ছায়া অত্যন্ত স্পষ্ট। সংঘাতের আবহে কোনো নিরপরাধও আর নিরাপদ নন, ছেলেটির মৃত্যু হয়তো সেদিকেই ইঙ্গিত করে।

৯। ‘কেন এল না’ কবিতায় সমসময়ের যে প্রতিফলন পাওয়া গিয়েছে তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো।

সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘কেন এল না’ কবিতায় অস্থির সাম্প্রতিকের এক মর্মস্পর্শী রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। যে কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতাটি সংকলিত সেই ‘যত দূরেই যাই’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি রচিত হয়েছিল ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে। সময়টা ছিল নানা কারণে উত্তাল। দেশভাগ পরবর্তী উদ্‌দ্বাস্তু আন্দোলনের তরঙ্গ তখনও যথেষ্ট অনুভূত হচ্ছে। এই অবস্থায় ভয়াবহ দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধি, গণবণ্টন ব্যবস্থার বিপর্যয় ইত্যাদি কারণে প্রবল খাদ্যসংকট সৃষ্টি হয়। তৈরি হয় ‘দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধি এবং দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি’। তাদের নেতৃত্বে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের ৩১ আগস্ট কলকাতায় লক্ষাধিক মানুষের মিছিল হয়। পুলিশের প্রত্যাঘাতে ৩৯ জন (মতান্তর ৮০-র কাছাকাছি) মানুষ মারা যান। (তথ্যসূত্র: Anwesha Sengupta-Calcutta in the 1950s and 1970s: What Made it the Hotbed of Rebellions?)। ‘কেন এল না’ কবিতাটি এই পটভূমিকেই আশ্রয় করেছে। বাবার বাড়িতে সঠিক সময়ে না ফিরে আসা একটি পরিবারে যে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছিল তা আসলে তৎকালীন সামাজিক অস্থিরতার প্রতীক। রেডিয়োর খবর অলক্ষে তৈরি করে দেয়, সেই সময়ের অস্থিরতার ভাষ্য। তারপর ছেলেটি যাকে ভেবেছিল বাজির শব্দ, তা আসলে বন্দুকের গুলির শব্দ এবং কালো গাড়ি, যা পুলিশের উপস্থিতির নিশ্চিত নির্দেশক-সেই অশান্ত সময়কে চিহ্নিত করে দেয়। সে সময় যে-কোনো সাধারণ মানুষের জন্যও নিরাপদ থাকে না, ছেলেটির রাস্তায় বেরিয়ে চিরকালের মতো নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া তার উদাহরণ।

১০। ‘কেন এল না’ কবিতায় কবির রচনাশৈলীর বিশিষ্টতা আলোচনা করো।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কেন এল না’ কবিতাটি কবির অনবদ্য নির্মাণ দক্ষতার এক অসামান্য উদাহরণ। ‘সুকান্ত সমগ্র’-র ভূমিকায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন-” ‘কী নিয়ে লিখব’ এটা কখনোই আমাদের আলোচনার বিষয় হত না। ‘কেমন করে লিখব’ এই নিয়েই আমাদের যত মাথাব্যথা।” সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর কবিতার বিষয়কে পূর্বচিহ্নিত করে দিয়েছিল। সুতরাং, তাঁর কবিতার পটভূমিতে যে খাদ্য-আন্দোলন সমকালীন বাংলাদেশ থাকবে, সময়ের অস্থিরতা কবিতার বিষয় হবে তা কোনো বিস্ময়কর বিষয় নয়। কিন্তু বিস্ময়কর কবিতার নির্মাণ। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রিয় গল্প বলার ভঙ্গিতেই কাহিনি নির্মাণ করেছেন এবং লক্ষণীয় সেই গল্প বলার মধ্যেই অসামান্য নাটকীয়তা নিয়ে এসেছেন কবি। বাবার না-ফেরা নিয়ে উৎকণ্ঠা কাহিনির প্রায় পুরোটা জুড়ে থাকলেও শেষপর্যন্ত ‘মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে’ বাবা ফিরে আসে কিন্তু ছেলে ফেরে না। নিশ্চিতভাবেই এই পরিণতির জন্য পাঠক প্রত্যাশা করেনি। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কবির প্রতীক ও সংকেতের ব্যবহার। ইতিহাসের খোলা পাতা আর ঘড়ির টিকটিক শব্দ যেন সময়ের সংকেতে নতুন ইতিহাস লেখার ইঙ্গিত দিয়ে যায়। রেডিয়োর খবর যেন তৈরি করে দেয় সময়ের ধারাভাষ্য। বাজি ফোটার আড়ালে গুলির শব্দ, কালো গাড়ির আড়ালে পুলিশের তৎপরতার ইঙ্গিত থেকে যায়। নাজিম হিকমতের কবিতার অনুবাদ করতে গিয়ে তাঁর উক্তির অনুবাদে সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন- “…এমন এক ভাষায় তিনি লেখেন-যা বানানো নয়, কৃত্রিম নয়, সহজ, প্রাণবন্ত, বিচিত্র, গভীর, একান্ত জটিল-অর্থাৎ অনাড়ম্বর সেই ভাষা। সে ভাষায় উপস্থিত থাকে জীবনের সমস্ত উপাদান।” এই সহজ-অনাড়ম্বর ভাষা প্রয়োগের নিদর্শনই পাওয়া যায় ‘কেন এল না’ কবিতায়।

১১। ‘কেন এল না’ কবিতায় ছেলেটির সমস্ত দিনের অপেক্ষা এবং তার করুণ পরিণতির আলোয় কবিতাটির বিষয়ভাবনা আলোচনা করো।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কেন এল না’ কবিতায় কিশোর চরিত্রটির বাবা সকালবেলায় বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলেন যে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসবেন। সমস্ত দিন উচ্ছল অতিবাহনের পরে রাস্তায় যখন আলো জ্বলে ওঠে, ছেলেটি বাবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। কারণ বাবা বলে গিয়েছিলেন যে, পুজোর কেনাকাটা তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে। কিশোর মন অপেক্ষায় অধীর হয়ে থাকে। সময় এগিয়ে চলে, স্তব্ধতা গ্রাস করে চারপাশকে। ছেলেটির পাঠে মনোযোগ থাকে না, ইতিহাসের বইয়ের অধ্যায়গুলো ‘হিজিবিজি অক্ষর’-এর সমষ্টি হয়েই থেকে যায়।

তীব্র অস্থিরতা থেকেই সে একসময় দরজা খোলে। গলির মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। রেডিয়োতে তখন খবর পড়া চলছে। ‘একটু এগিয়ে দেখবে বলে’ ছেলেটি রাস্তায় গিয়ে নামে। রাস্তার মোড়ে তখন ভিড়। খুব বাজি ফোটার শব্দ শুনল ছেলেটি। কীসের পুজো দেখার জন্য ছেলেটি রাস্তায় এগিয়ে গেল। বন্দুকের গুলির শব্দ তার চেনা নয়, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কালো গাড়ির ইঙ্গিতও তার অজানা। সেই অস্থির এবং অরাজক সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছে তার করুণ পরিণতি। মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে অনেক রাত্রে বাবা ফিরে আসেন, কিন্তু ছেলে ফেরে না। নিষ্ঠুর অরাজক ইতিহাসের কাছে বলিপ্রদত্ত হতে হয় এক সবুজ কৈশোরকে। কবিতার বিষয়বিন্যাসে অপেক্ষা গিয়ে শেষ হয় বিনষ্টিতে।

আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment