![]() |
সুন্দরবনের ওপর বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব সম্পর্কে লেখো |
জলবায়ু পরিবর্তন (Climate Change)
গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা বদ্বীপ
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি: IPCC (Intergovernmental Panel on Climate Change) এবং UNESCO-এর মতে, একবিংশ শতকের শেষ ভাগের মধ্যে সমুদ্রতলের উচ্চতা বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে প্রায় 18 ইঞ্চি বেড়ে যাবে, যা সুন্দরবনের 75% ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। এই মতামতের প্রমাণ হিসেবে এর মধ্যেই লোহাচড়া, নিউমুর এই দুটি দ্বীপ প্রায় সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে গেছে এবং ঘোড়ামারা দ্বীপ-এর অর্ধেক অংশ সমুদ্রের তলদেশে চলে গেছে।
সমুদ্রজলের উষ্ণতা বৃদ্ধি: School of Oceanographic Studies, Jadavpur University-এর মতে, সুন্দরবন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের জলতলের উষ্ণতা 1980 – 2007 সালের মধ্যে 1.5°C বেড়েছে, যা সমুদ্রজলের লবণতাকে বাড়িয়ে দিয়ে সুন্দরী গাছকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
উষ্ণতা পরিবর্তনের ফলে স্থানীয় নদীগুলির জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ, pH মাত্রা, স্বচ্ছতা এবং জলের গুণমান ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে, যা এখানকার বাস্তুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
জোয়ারের সীমাবদল: সুন্দরবন সংলগ্ন জোয়ারের সীমাও যথেষ্ট বদলেছে। আজ থেকে 300 বছর আগে জোয়ারের জল নদীয়ার নবদ্বীপের 16 কিমি নিম্নপ্রবাহ পর্যন্ত প্রবেশ করত, বর্তমানে তা 25 কিমি আরো উত্তরে সরে এসেছে।
অসময়ে বন্যা: সুন্দরবনাঞ্চলে বেশ কয়েক বছর অসময়ে বন্যার প্রকোপও যথেষ্ট বেড়েছে। বন্যার ফলে সুন্দরবনের বহু দ্বীপ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
অতি চরম ঘূর্ণিঝড় : গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনার সক্রিয় বদ্বীপ সুন্দরবনাঞ্চলে গত 1582 সাল থেকে 2001 সাল পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়সহ জলোচ্ছ্বাস হয়েছে প্রায় 107 বার। 1932 – 37 সাল পর্যন্ত এখানে টানা 6 বছর বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ঘটে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপজনিত ঘূর্ণিঝড় ‘আয়লা’ (2009) সুন্দরবনের সবচেয়ে ভয়ানক বিপর্যয়।
বদ্বীপের নিমজ্জন : সমীক্ষায় প্রকাশিত যে, বর্তমান নিমজ্জনের হার বজায় থাকলে 2050 সালের মধ্যে সুন্দরবনের 17 শতাংশ সমুদ্রে নিমজ্জিত হবে। নমুনারূপে, ঘোড়ামারা দ্বীপটির উল্লেখ করা যেতে পারে। 1975 সালে দ্বীপটির আয়তন ছিল 8.51 বর্গকিমি যা ক্রমশ হ্রাস পেতে পেতে 2012 সালে 4.43 বর্গকিমিতে পরিণত হয়েছে।
নদীপাড়ের ক্ষয়জনিত ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি : সাইক্লোনের শক্তি বৃদ্ধির ফলে ভূমিধস তথা ভূমিক্ষয়ের (Land erosion) পরিমাণ বেড়েছে।
জলস্তরে লবণতা বৃদ্ধি ও কৃষিতে প্রভাব : সুন্দরবন অঞ্চলের নদীতে লবণতা বৃদ্ধি ও সামুদ্রিক জলের সালফেটের উপস্থিতির জন্য স্বাদু জলের প্রবাহ কমে গেছে, যা ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে বাধার সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া মাটিতে লবণতা বৃদ্ধি, জোয়ারের জল কৃষিজমিতে প্রবেশ ও ঘূর্ণবাতের কারণে সুন্দরবন অঞ্চলে কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে।
বনভূমি হ্রাস: সুন্দরবন অঞ্চলে অনবরত বৃক্ষচ্ছেদন ও ভূমি পুনরুদ্ধার চলছে। এর ফলে সমীক্ষায় দেখা গেছে, 20 বছরের মধ্যে 5% বনভূমি হ্রাস পেয়েছে ও কিছু প্রজাতি অবলুপ্ত হয়ে গেছে।
সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে, সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ প্রধানত কৃষিনির্ভর হওয়ায় জলবায়ুর পরিবর্তন এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক তথা অর্থনৈতিক পরিবেশের ব্যাপক অবনমন ঘটাচ্ছে এবং এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য এখন সংকটের মুখে। সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুন্দরবনাঞ্চলকে (1987 সালে UNESCO দ্বারা এটি ‘World Heritage’ বলে আখ্যায়িত হয়) রক্ষা করতে হবে।