বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়ো গল্পের বিষয়বস্তু ও নামকরণ
![]() |
বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়ো গল্পের বিষয়বস্তু ও নামকরণ |
বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়ো গল্পের বিষয়বস্তু
লেখক বলেছেন, যাকে নিয়ে এত উৎকণ্ঠা, তার মধ্যে কোনো বিকার নেই, তাপোত্তাপ নেই। বরং রয়েছে অদ্ভুত এক প্রসন্নতা, ধৈর্য, শান্তভাব। লেখক বলেছেন, যদি কোনো অপ্রাকৃত বা অতিপ্রাকৃত শক্তি তার মধ্যে থেকে থাকে, তাহলে সেই গুণটি হল তার ধৈর্য। শত অত্যাচারে, তার গায়ে তপ্ত লোহার ছ্যাঁকা দেওয়ার পরেও সে যতটা সম্ভব সহ্যশক্তি নিয়ে চুপ করে থাকত।
তাকে পরীক্ষা করার জন্য ধর্মভীরু মানুষদেরও আগ্রহ কম ছিল না। তারা জানতে চেয়েছিল এই বৃদ্ধ নরওয়ের বাসিন্দা কি না। অনেক চিঠিপত্র দিয়ে সেই বুড়োকে চিহ্নিত করার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। অবশ্য বাড়ির গৃহকর্তা এবং গৃহকর্ত্রী দুজনেই ভেবেছিল একে দিয়ে অর্থ আয় করা সম্ভব। তাকে দেবদূতরূপে প্রতিপন্ন করেছিল প্রতিবেশীরা। তাই রাতারাতি পেলাইও, এলিসেন্দা প্রমাণ করতে চেয়েছিল বুড়োর অসাধ্য কিছুই নেই, এমনকি নানা ‘অলৌকিক অঘটনের’ দায়ও চাপানো হয়েছিল তার উপর। যেমন- অন্ধ আতুরের তিনটি নতুন দাঁত গজিয়েছিল। এক পঙ্গু বেচারি একটা লটারি প্রায় জিতেই যাচ্ছিল। এক কুষ্ঠরোগীর ঘাগুলি থেকে সূর্যমুখী ফুল ফুটেছিল।
লেখক গার্সিয়া মার্কেজ গল্পের আলোচ্য বিষয়টিকে দেখিয়েছিলেন ‘এক ধরনের মানসিক বিশৃঙ্খলা’ রূপে। বাড়ির মালিকেরা বুড়োকে সামনে রেখে যে টাকা উপার্জন করেছিল তার ফলে তাদের শহরে দ্বিতল গৃহ এবং খরগোশ পালনের জায়গা পর্যন্ত বানানো সম্ভব হয়েছিল। অতি সহজে বিত্তশালী হওয়ার পর পেলাইও, এলিসেন্দার কাছে অপ্রয়োজনীয় ছিল বুড়ো। সভ্য সমাজ দ্বারা অতিপ্রাকৃত জীবরূপে প্রতিপন্ন এই বুড়ো শীতকাল পেরোলেই নতুন পালক পেল ডানায়। অপেক্ষাকৃত সুস্থ হয়ে ওড়ার চেষ্টা করতে লাগল। এরপর একদিন এলিসেন্দা দেখতে পেয়েছিল কোনো জরাগ্রস্ত শকুনের মতো বুড়োও উড়ে চলেছে আকাশের দিকে। শেষমেশ তাদের অপ্রয়োজনীয় উৎপাত ক্রমশ দিচক্রবালে নিছক কাল্পনিক ফুটকির মতো মিলিয়ে যাচ্ছে, এই ভেবে সে সন্তুষ্ট হয়েছিল।
বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়ো গল্পের নামকরণ
সাহিত্যের শিরোনামে লেখক সর্বদাই কোনো বিশেষ ব্যঞ্জনার প্রকাশ ঘটান। গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়ো’ গল্পের নামকরণেও তেমনভাবে আমরা বিশেষ ব্যঞ্জনার প্রতিফলন দেখতে পাই। সম্পূর্ণ জাদুবাস্তবতায় মোড়া এই গল্পের নামকরণও বিষয় থেকে বিষয়ান্তরের প্রতি নির্দেশ করেছে।
মূল বিষয়
‘বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়ো’ গল্পের প্রধান চরিত্র এমন এক বুড়ো যাকে প্রথম দর্শনে অপার্থিব মনে হয়। একটানা তিন দিন বর্ষণের পর বাড়ির উঠোনের পেছনের দিকটায় ডানাওয়ালা অদ্ভুতদর্শন বুড়োকে দেখে দরিদ্র গৃহস্থ পেলাইও। অভিজ্ঞ পড়োশিনির পরামর্শে পেলাইও এবং তার স্ত্রী বুড়োকে দেবদূত মনে করে। ঘটনাক্রমে এই কথা ছড়িয়ে পড়লে নানা লোক দেবদূতের কাছে চাহিদাপূরণের আশায় তাদের বাড়ির পাশে ভিড় করে। এই সুযোগ ব্যবহার করে ধূর্ত পেলাইও এবং এলিসেন্দা বুড়োকে দেখানোর জন্য দর্শকদের কাছ থেকে দর্শনি আদায় করতে থাকে। অন্যদিকে দেবদূতকে ঘিরে ধর্মভীরু পাদ্রে গোনসাগার অন্তর্দ্বন্দু শুরু হয় এবং বুড়ো যে দেবদূত নয় তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন তিনি। এদিকে কৌতূহলী জনতার অত্যাচার সহ্য করার ক্ষেত্রে বুড়োর অতিপ্রাকৃত শক্তির পরিচয় পাওয়া গেলেও তা সভ্যসমাজের মানুষের কাছে প্রাধান্য পায় না।
দেবদূতকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ও কৌতূহলের অন্ত হয় ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনীর মাকড়সা মেয়েটির আগমনে। ততদিনে পেলাইও এবং এলিসেন্দা ধনী হয়ে যাওয়ায়, তাদের নানা কষ্টও লাঘব হয়।
শেষমেশ বহুদিন ধরে নারকীয় জীবনযাপনের পর বহু প্রচেষ্টায় বুড়ো ডানা মেলে উড়ে যেতে পারে।
ব্যাখ্যা
উপসংহার
বিষয়বস্তুর আক্ষরিক অর্থ ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ‘বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়ো’ গল্পটি প্রকৃতপক্ষে এক হতভাগ্য বুড়োর গল্প। অদ্ভুতদর্শন চেহারার কারণে তাকে বারবার বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে কিন্তু কোনো অলৌকিকত্ব প্রমাণ করার সামর্থ্য তার ছিল না। মানসিক সুস্থতা ও উদারতার অভাব যে সমাজে প্রকট, সেই সহানুভূতিহীন সমাজ ছেড়ে ‘বুড়ো’ ডানা মেলে উড়ে গিয়েছে অন্য আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে, অস্বাভাবিক দর্শন বুড়োকে কেন্দ্র করে রচিত ‘বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়ো’ গল্পের নামকরণ সার্থকতা লাভ করেছে।
তাৎপর্যমূলক বিশ্লেষণ
গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়ো’ গল্পের সর্বত্র ছড়িয়েছিটিয়ে আছে জাদু-বাস্তবতা বা Magic realism I
‘জাদু’ অর্থাৎ অতিলৌকিক বা অলৌকিক অনুভূতি অর্জনের অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে ‘বাস্তবতা’ হল কঠিন সত্যের আলোকে প্রতিফলিত জীবনদর্শন। আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী হলেও গল্পকার আলোচ্য গল্পে তার সার্থক মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন।
‘ডানাওয়ালা’ বুড়ো, মাকড়সা মেয়ে, অধ আতুরের তিনটি নতুন দাঁত গজানো কিংবা কুষ্ঠরোগীর গা থেকে গজিয়ে ওঠা সূর্যমুখী ফুলের বর্ণনায় গল্পের শিকড় জাদুবিদ্যার অলীক মাটিতে প্রবেশ করেছে। অভিনব আঙ্গিকে গল্পকার এই ‘জাদু’কে ব্যবহার করেছেন সাধারণ সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে। কারণ গল্পের মধ্যেই তিনি ‘অন্ধ আতুর’ বা ‘কুষ্ঠরোগীর’ ঘটনাকে ‘জনশ্রুতি’ হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন।
সমাজের প্রতি একনিষ্ঠ দায়বদ্ধতাকে স্বীকার করা নিয়ে গল্পকার চরম বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যায় পেলাইও- এলিসেন্দার বাড়িতে উপস্থিত হওয়া, লোভী-নির্দয় মানুষদের অলৌকিকতা প্রত্যক্ষ করা, অন্যান্য চাহিদা পূরণ করার জন্য নীরবে বুড়োর অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা-প্রতিটি ক্ষেত্রে জীবনসংগ্রামী মানুষের কঠিন বাস্তবতা চিত্রায়িত হয়েছে গল্পকারের লেখনীতে।
‘জাদু’ কেবল একটা অস্পষ্ট ছায়া হিসেবে রুক্ষ বাস্তবের কাঠিন্যকে ২ সরল করার জন্য সচেতনভাবে ব্যবহৃত। অভিজ্ঞ গল্পকার জানেন, ও সাধারণ মানুষ কঠিন বাস্তবের মাঝে থেকেও ‘জাদু’ বা অলীক বিষয়বস্তুর মোহে আচ্ছন্ন থাকে। তাই আলোচ্য গল্পের স্তরে স্তরে পাঠকের আগ্রহ ও আকর্ষণকে টেনে রাখার জন্য নির্দয়, কঠোর এবং সহানুভূতিহীন বাস্তবকে ‘জাদু’-র মোড়কে পরিবেশন করেছেন। ‘জাদু- বাস্তবতা’ সমগ্র গল্পকে একটি বিশেষ মাত্রা দান করেছে তখনই, যখন স্বয়ং গল্পকার ‘বুড়ো’-র অলৌকিকতা বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন- “তবে একমাত্র অতিপ্রাকৃত শক্তি মনে হল তার ধৈর্য”।
কঠোর বাস্তববাদী গল্পকার প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষকে এই পরম সত্যে উপনীত করতে চেয়েছেন যে, ভয়ংকর প্রতিকূল জীবনসংগ্রামে মানুষের সবথেকে মূল্যবান হাতিয়ার হল তারই অন্তরে নিহিত চরম ধৈর্যশক্তি। অনুকূল স্রোতে পৌঁছোনোর জন্য জীবনের কঠিনতম দিনগুলিতে নিঃশব্দে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। যে ধৈর্যশক্তি জীবনসংগ্রামে বিধ্বস্ত মানুষকে মুক্ত জীবনের আনন্দ এনে দেয়। মনের ডানা এমন সাবলীল হয়ে ওঠে যে, কুশ্রী-পঙ্কিল জীবনের অন্ধকার গর্ত থেকে মানবতার সীমাহীন সুনীল আকাশে উড়ে যাওয়ার সাহস তৈরি হয়।
দুর্যোগপূর্ণ কঠিন বাস্তবজীবনের আকাশ থেকে বিষন্ন কালো মেঘ, মন খারাপের অশ্রুর মতো বৃষ্টিধারা সরে গিয়ে ‘ডিসেম্বরের গোড়ায়’ অর্থাৎ জীবনসূর্যের প্রখর দীপ্তিতে উজ্জ্বল দিনে মুক্তি আসে।
‘বুড়োর ডানায় নতুন পালক গজানো’র জাদুর মায়াময় আবরণে প্রতিনিয়ত কঠিন বাস্তবের সঙ্গে লড়াই-এ ধৈর্যশক্তির অপরিসীম অলৌকিকতা আসলে ‘বাস্তবতা’-তা প্রমাণিত হয়েছে।