বৈদিক ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থাই ভারতের একমাত্র শিক্ষাব্যবস্থা ছিল না। বৌদ্ধ জীবনাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বৌদ্ধ শিক্ষা ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি চলেছে। পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং পরিপুরকরূপে উভয় শিক্ষা বহুদিন একই সঙ্গে এগিয়েছে। বৈদিক ধর্মের কড়াকড়ি, যাগযজ্ঞের বাহুল্য, পশুবলি, নিম্নবর্ণের লোকেদের প্রতি তাচ্ছিল্য ইত্যাদি নানা কারণে জনগণের একটা বড়ো অংশের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এই অবস্থায় বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব হয়। বুদ্ধদেব ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ করেন, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরোধী হিসেবে বৌদ্ধধর্মের সূচনা ও প্রসার ঘটে। ধর্মের ক্ষেত্রে সকলের সমান অধিকার-এই কথা বুদ্ধদেবই প্রথম শুনিয়েছিলেন। বেদ, ব্রাহ্মণ-এরা কেউ চুড়ান্ত সত্য নয়। চূড়ান্ত বাণী হল-বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্মং শরণং গচ্ছামি, সংঘং শরণং গচ্ছামি। একেই ত্রিশরণ মন্ত্র বলে।
এখানে একটা বড়ো প্রশ্ন হল, বৌদ্ধ ধর্ম কি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত কোনো ধর্ম? এককথায় এর উত্তর হল ‘না’। বুদ্ধদেব নিজে ছিলেন ব্রাহ্মণ। বেদে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ছিল। ম্যাক্সমুলারের মতে, ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে বাদ দিয়ে বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই একথা বলা যায় যে, বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তি হল ব্রাহ্মণ্য ধর্ম।
বৌদ্ধ শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

বৌদ্ধ শিক্ষার বৈশিষ্ট্য
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার মুখ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
(1) শিক্ষার লক্ষ্য:
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার মতো বৌদ্ধ শিক্ষার লক্ষ্য হল জীবন ও জগৎ থেকে মুক্তি। তবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল। হিন্দুধর্মের মতে, মুক্তি আসবে জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথ পালন করে। অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস ধর্ম পালন করে। আর বৌদ্ধ শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য ও আদর্শ পরিনির্বাণ। গার্হস্থ্যের এখানে কোনো গুরুত্বই নেই। সাধনা, নীতিজ্ঞান, নৈতিক জীবনযাপন, বন্ধনহীন সংঘ জীবনে নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা ও সেবা ধর্মই শিক্ষার লক্ষ্য। বৌদ্ধধর্মে হিন্দুদের ন্যায় পরমাত্মার সঙ্গে পুনর্মিলন নয়, বাসনার অবলুপ্তিই হল শিক্ষার লক্ষ্য।
(2) আনুষ্ঠানিক শিক্ষারম্ভ:
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা যেমন উপনয়নের মধ্য দিয়ে শুরু হত, বৌদ্ধ শিক্ষা শুরু হত ‘প্রব্রজ্যা’ নামে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। বৌদ্ধ ধর্মে জাতবিচার না থাকায় যে-কোনো বর্ণের ব্যক্তিই প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে পারত। তবে আট বছরের চেয়ে কম বয়সে এবং পিতা-মাতার অনুমতি ছাড়া প্রব্রজ্যা গ্রহণ ও ভিক্ষু সংঘে প্রবেশ করা নিষেধ ছিল। হিন্দুদের উপনয়নের মতো বৌদ্ধ শিক্ষার্থী শিক্ষক বা উপাধ্যায়ের কাছে এসে শ্রদ্ধার সঙ্গে আধ্যাত্মিক জীবনের পথ দেখাতে অনুরোধ করতেন এবং ত্রিশরণ মন্ত্র উচ্চারণ করতেন। প্রথম প্রবেশকারী তরুণ ভিক্ষুকে বলা হত ‘শ্রমণ’। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সংঘে শ্রমণ হিসেবে বারো বছর কাটানোর পর উপযুক্ত বিবেচিত হলে শ্রমণকে ‘উপসম্পদা’ দেওয়া হত।
(3) পাঠক্রম-ধর্মশিক্ষা ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার সমন্বয়:
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম ও তত্ত্ব সম্পর্কে শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দেওয়া। প্রথম যুগের পাঠ্যসূচি সেভাবেই রচিত হয়েছিল। প্রথম অবস্থার বৌদ্ধ শিক্ষার পাঠক্রমে লৌকিক শিক্ষার কোনো স্থান ছিল না। ভিক্ষুদের জন্য সূত্র, ধর্ম ও বিনয় ছিল অবশ্য পাঠ্য। তা ছাড়া ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পাশাপাশি অবস্থানের জন্য ব্রাহ্মণ্য পাঠক্রমের কিছু কিছু অংশও বৌদ্ধ পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ‘মিলিন্দপপ্তহ’ গ্রন্থে উনিশ রকম বিদ্যার পরিচয় পাওয়া যায়, যার মধ্যে অন্যতম হল বেদ, ইতিহাস, পুরাণ, ছন্দ, ধ্বনি, কাব্য। ব্যাকরণ, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতিও ক্রমে ক্রমে বৌদ্ধ পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা শুধু ভিক্ষুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। গৃহ শিক্ষার্থীরা ধর্মতত্ত্ব শিক্ষার জন্য নির্ভর করতেন বিহারের ওপর, আর ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণ শিক্ষার জন্য নির্ভর করতেন মঠের বাইরে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। ধর্মনিরপেক্ষ উচ্চশিক্ষায় চিকিৎসা, আইন, শিল্পকলায় বৌদ্ধ যুগ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। বিহারবাসী ভিক্ষুরাও বয়ন, প্রভৃতি হস্তশিল্প শিখতেন। চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে তত্ত্ব ও ব্যাবহারিক শিক্ষার সমন্বয়ে সাত বছরের পাঠক্রম তৈরি হয়েছিল। চিকিৎসাবিদ্যার প্রথাগত কেন্দ্র ছিল তক্ষশিলা, রাজগৃহ, বারাণসী।
বিহারগুলিতে উচ্চশিক্ষার জন্য দরকার হত উপযুক্ত প্রস্তুতির। সেজন্য স্তরভিত্তিক পাঠক্রম তৈরি হয়েছিল। বস্তুত বৌদ্ধ পাঠ্যসূচিতে ধর্মশিক্ষা ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার সমন্বয় ঘটেছিল।
(4) স্তরভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতি:
পূর্ণ ভিক্ষুত্বের জন্য শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন স্তর পার হতে হত। শিক্ষাপদ্ধতি ছিল স্তরানুযায়ী। প্রথম পর্যায়ের পদ্ধতি ছিল আবৃত্তিমূলক, যদিও বৌদ্ধ যুগে লিপির ব্যবহার চালু হয়েছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ের পদ্ধতি ছিল প্রধানত আলোচনামূলক। তৃতীয় পর্যায়ে ছিল শিক্ষক-শিক্ষণ। বৌদ্ধ শিক্ষার প্রসার ও শিখনপদ্ধতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল-এই শিক্ষা যতই জনগণের কাছে পৌঁছোল ততই শিক্ষায় ভাষা সমস্যার সৃষ্টি হল। সকলে যাতে বৌদ্ধ ধর্মের বাণীর অর্থ উপলব্ধি করতে পারে সেজন্য বুদ্ধদেব মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দান করতে বলেছিলেন। এই সময় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পালি ভাষা গুরুত্ব পায়। পরে পালি ও সংস্কৃত-উভয় ভাষাই বৌদ্ধ শিক্ষায় গুরুত্ব লাভ করে।
(5) গুরু-শিষ্যের সুসম্পর্ক:
বৌদ্ধ বিহারে শিক্ষক ছিলেন দুই শ্রেণির। ধর্মতত্ত্বের শিক্ষক ছিলেন উপাধ্যায়। নৈতিক জীবনের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন আচার্য বা কর্মাচার্য। উপাধ্যায় ও আচার্য উভয়ের সঙ্গে শ্রমণের ছিল পিতা-পুত্রের সম্পর্ক। শ্রমণ নানাভাবে গুরুসেবা করত। ব্রাহ্মমূহূর্তে শ্রমণ শয্যাত্যাগ করে নিজের প্রাতঃকৃত্য সমাধা করে গুরুর সেবার প্রস্তুতি শুরু করত। গুরু ভিক্ষায় বেরোবার আগে তাঁকে পরিধেয় ও ভিক্ষাপাত্র এনে দিত। ভিক্ষা থেকে ফিরে এলে স্নানের ব্যবস্থা, আহার এনে দেওয়া, বিশ্রামের ব্যবস্থা সবই শিষ্য করত। গুরুর অনুমতি ছাড়া শিষ্য কোনো উপহার গ্রহণ করতে পারত না।
গুরু অসুস্থ হলে তাঁর সেবা করা শিষ্যের দায়িত্ব ছিল। কিন্তু এত আনুগত্য সত্ত্বেও কোনো কোনো কারণে গুরুকে ত্যাগ করাও শিষ্যের পক্ষে অবৈধ ছিল না। বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রমণকে গুরুর স্বভাব, চরিত্র ও আচরণের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হত। গুরু সংঘের আদর্শবিরোধী কাজ করলে গুরুর সেই পতনের কথা সংঘের গোচরে এনে প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করতে হত। প্রায়শ্চিত্তের পর গুরুকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার ভার শিষ্যকে নিতে হত। শ্রমণ যেমন গুরুর সেবা করত গুরুও শ্রমণকে সেইভাবে দেখতেন।
শ্রমণের আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং তার সঠিক আচরণের প্রতি গুরু সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। শ্রমণের ভিক্ষাপাত্র, পরিধেয় বস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে দেওয়া ছিল তাঁর কর্তব্য। শ্রমণ অসুস্থ হলে গুরুকে তার সেবার ভার নিতে হত। গুরু যদি মনে করতেন শ্রমণ সংঘের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, ধর্মে বিশ্বাসী নয় বা সংঘের নিয়মকানুন মেনে চলছে না, সেক্ষেত্রে তিনি শ্রমণকে সংঘ থেকে বিতাড়িত করতে পারতেন।
(6) শিক্ষায় সর্বজনীনতা:
সংঘ বিদ্যালয়ে সব বর্ণের মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল। বিধিনিষেধ যে মোটেই ছিল না তা নয়, বৌদ্ধ শিক্ষায় নৈতিক ও চারিত্রিক শুদ্ধতার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হত। এজন্য শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে কয়েকটি নিয়ম ছিল। নির্দিষ্ট বয়সসীমা পেরিয়ে গেলে সংঘে প্রবেশ করা যেত না। দুশ্চরিত্র, ব্যাধিগ্রস্তদের শিক্ষালাভের অধিকার ছিল না। রাজকার্যে নিযুক্ত ব্যক্তি, দেশরক্ষার সৈনিক বা অপরাধীর প্রব্রজ্যালাভের অধিকার ছিল না।
(7) বিহারজীবন ও শৃঙ্খলা:
বৌদ্ধ বিদ্যালয়গুলিকেই বিহার বলে। বিহারকে কেন্দ্র করেই বৌদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। বিহারের প্রশাসন ছিল গণতান্ত্রিক। নিয়মানুবর্তিতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ছিল বিহারের সফলতার অন্যতম কারণ। জ্ঞানার্জনের শিক্ষার পাশাপাশি বিহারজীবনে শিল্পকলা ও ব্যাবহারিক শিক্ষার সুবন্দোবস্ত ছিল। বিহারের মধ্যে বিতর্কসভা আয়োজিত হত। বিহার প্রধানদের নিয়ে বসত বৌদ্ধধর্মতত্ত্ব ও জীবনদর্শন সম্পর্কে পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনাসভা। সেই সভায় উপস্থিত থেকে ‘ভিক্ষু’রাও উপকৃত হত। বিহারের সব সম্পত্তি ছিল যৌথ সম্পত্তি। ভিক্ষুর পোশাক, ভিক্ষাপাত্র প্রভৃতি আটটি নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য ছিল ভিক্ষুর নিজস্ব।
নিয়মানুবর্তিতা ও কঠোর শাসন ছিল বিহারজীবনের অঙ্গ। ত্রিশরণ মন্ত্র জপ, অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ এবং দশটি শীল পালন ছিল বিহারবাসীদের জীবনদর্শন। এই অষ্টাঙ্গিক মার্গ হল-সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক জীবিকা, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক সংগ্রহ ও সম্যক সমাধি। ভিক্ষুদের আচরণে নিষেধগুলিকেই শীল বলে। এইরকম দশটি শীলের উল্লেখ বৌদ্ধ দর্শনে আছে। সেগুলি হল-প্রাণী হত্যা করা; চুরি করা; ব্রহ্মচর্য ভঙ্গ করা; উগ্র পানীয় গ্রহণ করা; মিথ্যা কথা বলা; নাচ, গান, বাজনা ও কৌতুকে যোগদান করা; মালা, গন্ধ ব্যবহার করা; স্বর্ণ-রৌপ্য গ্রহণ করা ইত্যাদি। কঠোর নিয়মকানুনে বাঁধা বিহারজীবনে বিশৃঙ্খলার প্রশ্নই ছিল না।
(8) স্ত্রীশিক্ষা:
বৌদ্ধধর্মে জন্মগ্রহণকে দুঃখের কারণ বলা হয়েছে। যেহেতু নারীজাতি জন্মলাভের মূল কারণ বলে বিবেচিত হত তাই নারীদের প্রতি যথেষ্ট অবিচার করা হত। এ ছাড়া অন্যান্য কারণে বুদ্ধদেব স্ত্রীশিক্ষার বিরোধী ছিলেন। তবুও তাঁর প্রিয় শিষ্য আনন্দ ও পালকমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমীর অনুরোধে নারীদের শিষ্যা করতে সম্মত হয়েছিলেন। সংঘে ভিক্ষুণীদের গ্রহণ করা হলেও ভিক্ষুদের প্রাধান্য মেনে চলতে হত। বহু বিধিনিষেধের মধ্যে থেকে তাদের পড়াশোনা করতে হত। ভিক্ষুণীদের জন্য বারোটি নিষেধ ছিল-একা ভ্রমণ করা; নদী পার হওয়া; পুরুষ অঙ্গ স্পর্শ করা; পুরুষের সঙ্গে এক গৃহে বাস করা; বিবাহে ঘটকালি করা; ইত্যাদি।
এত বাধানিষেধ সত্ত্বেও বহু ধনী কন্যা ভিক্ষুণী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করত। বৌদ্ধ গ্রন্থে বিশাখা, শুভা, অনুপমা, সুমেধা প্রভৃতি উচ্চশ্রেণির ভিক্ষুণীর উল্লেখ আছে। উচ্চ দার্শনিক জ্ঞানসম্পন্ন বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের ‘মেরা’ বলা হয়। পালকমাতা মহাপ্রজাপতি ও তাঁর সঙ্গে পাঁচশো রমণী ‘মেরা’ উপাধি লাভ করেছিলেন। এইসব দৃষ্টান্ত থেকে বলা যায়, বৌদ্ধধর্মে স্ত্রীশিক্ষার প্রতি অবহেলা থাকলেও স্ত্রীশিক্ষার অবলুপ্তি এই আমলে হয়নি।
(9) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান:
বৌদ্ধযুগে শিক্ষা ছিল সংঘকেন্দ্রিক বা মঠকেন্দ্রিক। যদিও আবাসিক বিহারগুলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে শিক্ষাদানের কাজও পরিচালনা করত। বৌদ্ধযুগের শিক্ষা ভারতবর্ষের বাইরের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করত। বৌদ্ধযুগের উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হল-নালন্দা, বিক্রমশীলা, বল্লভী, জগদ্দল, ওদন্তপুরী প্রভৃতি। এগুলি প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হত।
(10) মূল্যায়ন পদ্ধতি:
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় বিহার বা সংঘ জীবনের বারো বছর ব্যাপী আবাসিক শিক্ষা শেষ হত উপসম্পদা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। উপসম্পদা প্রদানের সময় শ্রমণকে ভিক্ষুদের সভায় উপস্থিত হয়ে নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর দান করতে হত। ভিক্ষুদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করতে পারলেই শ্রমণ উপসম্পদা উপাধি লাভকরতে পারত। উপসম্পদা ছিল চূড়ান্ত সন্ন্যাসের সূচনাপর্ব।
বৌদ্ধ শিক্ষার সমালোচনা
বর্ণাশ্রম বিরোধী, গণতান্ত্রিক চেতনাসমৃদ্ধ, প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রভৃতি বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা বৌদ্ধ শিক্ষার ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য হলেও এর কিছু ত্রুটির দিকও আছে। যেমন-
(1) সংকীর্ণ মানসিকতা:
বেদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে, ব্রাহ্মণ্য কর্মকে অবহেলা করে, বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অন্ধ আনুগত্যকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বৌদ্ধ শিক্ষা সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে। ফলে, জনসাধারণ সর্বতোভাবে এই শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।
(2) জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন:
বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের ব্যক্তিগত বিষয়সম্পত্তি না থাকলেও অভিজাত সম্প্রদায়ের দানে প্রত্যেকটি সংঘ প্রচুর ধনসম্পত্তির অধিকারী ছিল। এর ফলে ভিক্ষুরা ভোগবিলাসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। জনগণ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং জনসাধারণের শিক্ষার দিকটা অবহেলিত হতে থাকে।
(3) সামরিক শিক্ষার অভাব:
অহিংসা বৌদ্ধধর্মের অন্যতম প্রধান নীতি হওয়ায় সমরাস্ত্র শিক্ষা, সমরবিজ্ঞান ইত্যাদির উপস্থিতি বৌদ্ধ পাঠক্রমে দেখা যায় না। এর ফলে দেশের সুরক্ষার দিকটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বৈদেশিক শক্তির আক্রমণ প্রতিহত করা ক্রমশ কঠিন হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন | Link |
ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
তেলেনাপোতা আবিষ্কার বড় প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
আগুন নাটকের প্রশ্ন উত্তর | Click Here |