মৌলানা আবুল কালাম আজাদের শিক্ষা সম্পর্কিত ধারণা
শিক্ষা সমাজগঠনের ক্ষেত্রে এক অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিজীবী হিসেবে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের শিক্ষাগত ভাবনা আমাদের অধ্যয়ন করা আবশ্যক। রাজনৈতিক সক্রিয়তার বাইরেও ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাতেও তিনি দীর্ঘস্থায়ী অবদান রেখেছিলেন। তিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং তিনি শিক্ষাকে ব্যক্তির ক্ষমতায়ন, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যবোধ জাগ্রত করার হাতিয়াররূপে দেখেছিলেন। এ জন্যই তিনি শিক্ষাকে সর্বজনীন করে তুলতে চেয়েছিলেন। একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে আজাদ মনে করতেন, খাদ্য ও বস্ত্রের পরেই শিক্ষার স্থান। স্বাধীনতার অনতিপর (১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ) থেকে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২ ফ্রেব্রুয়ারি দীর্ঘ প্রায় ১১ বছর তিনি নেহরু-র মন্ত্রীসভায় শিক্ষামন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা ভারতবর্ষকে যে জায়গায় নিয়ে গেছিল, সেখানে শিক্ষার অঙ্গনে সাধারণ মানুষের কোনো স্থান ছিল না। শিক্ষা কেবল উচ্চবিত্ত এবং উচ্চমধ্যবিত্তের মধ্যে সীমিত ছিল। নারীশিক্ষার বিশেষ সুযোগ প্রসারিত ছিল না। অর্থাৎ, শিক্ষার আলো থেকে নারীরা ছিল অনেক দূরে।
এককথায় বলা যায় নিরক্ষরতা, অজ্ঞানতা, কুসংস্কারের অন্ধকারে ভারতবাসী জর্জরিত ছিল। ভারত যেহেতু অশিক্ষায় জর্জরিত একটি দেশ ছিল, পরাধীন ভারতে শিক্ষার হার যেহেতু খুবই সামান্য ছিল সেহেতু স্বাধীন ভারতবর্ষের শিক্ষার উন্নতি এবং সংস্কারের জন্য তিনি বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নবরূপ দান করেছিলেন। একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, শিক্ষা শুধুমাত্র নিরক্ষরতা আর অজ্ঞানতার অন্ধকারকে দূরে করে রাখতে পারে তাই নয়, শিক্ষা ভারতের মতো সদ্যস্বাধীন দেশের সামাজিক পরিবর্তন, প্রগতি এবং দেশের আর্থিক উন্নয়নের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
মৌলানা আজাদের শিক্ষামন্ত্রক স্বাধীন ভারতের আধুনিক শিক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি একদিকে যেমন নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বয়স্কদের জন্য শিক্ষা, মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, নারীশিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন, তেমনই অন্যদিকে কারিগরি ও আধুনিক শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষনাকে উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার অর্থ নিছক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের মধ্যেই সীমিত নয়, বরং শিক্ষা ব্যক্তির সামগ্রিক বিষয় তথা ব্যক্তির বৌদ্ধিক, নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক বিকাশের পথকে ত্বরান্বিত করেন। তিনি শিক্ষাকে শুধুমাত্র ব্যক্তির বিষয় ভিত্তিক পঠন-পাঠনের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে শিক্ষার দ্বারা ব্যক্তির মধ্যে শক্তিশালী নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে বিকশিত করতে চেয়েছিলেন।
তাঁর শিক্ষার ধারণার ক্ষেত্রে সহনশীলতা, সহিষুতা, সামাজিক দায়িত্ব, সহানুভূতির মতো মূল্যবোধগুলি গভীরভাবে গৃহীত হয়েছিল। তিনি শিক্ষাকে একটি বৈষম্যময় সমাজের ঐক্য হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে দেখেছিলেন। একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীরূপে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের সঙ্গে মিশে তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির যে পরিচয় পেয়েছিলেন, সেই বহুভাষা সংস্কৃতির সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। শিক্ষায় আজাদের অবদান ছিল বহুমুখী। তাই বিস্তারিতভাবে তাঁর শিক্ষার উদ্দেশ্য, পাঠক্রম, শিক্ষার পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন।
আজাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য
তাঁর মন্ত্রীত্বের সময়কালে আজাদ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনয়নের চেষ্টা করেন। তিনি শিক্ষা দপ্তরকে এমন এক বৃহৎ মন্ত্রণালয়ে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন, যা একই সঙ্গে শিক্ষা এবং সংস্কৃতি উভয়ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব প্রদান করবে। আজাদের শিক্ষাগত সংস্কারের দৃষ্টিভঙ্গি চারটি মৌলিক লক্ষ্যের উপর ভিত্তিশীল ছিল। এগুলি হল-
(1) শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণ
মৌলানা আজাদ ভারতীয় সমাজে শ্রেণি ও বর্ণবৈষম্য, জাতপাতভিত্তিক কুসংস্কার ইত্যাদির অস্তিত্ব দেখে উপলব্ধি করেছিলেন যে, সামাজিক বৈষম্যের শিকড় অনেক গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, কেবলমাত্র শিক্ষাই এই বৈষম্যকে সমূলে উৎপাটিত করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম। এজন্যই তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে সকলের প্রবেশাধিকার সুনিশ্চিত করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন এবং শিক্ষার সর্বজনীনতা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে অর্পণ করেছিলেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন যে, মৌলিক শিক্ষা লাভ করা হল প্রত্যেক ব্যক্তির জন্মগত অধিকার।
তবে শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান হল এই যে, তিনি ভারতের পশ্চাত্পদ, অনুন্নত, সুবিধাবঞ্চিত ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তি প্রদানের পরামর্শ দেন। এবং নারীশিক্ষা বিস্তারের জন্য গুরুত্ব আরোপ করেন। যা ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়সংগত করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
(2) শিক্ষাগত মান বজায় রাখা
আজাদ শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণের পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়ন করার জন্যও সমানভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, গণতন্ত্রকে সাফল্যমন্ডিত করতে হলে শিক্ষার প্রসার ঘটানো আবশ্যক। তিনি সর্বদা উচ্চমানের শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন। উৎকর্ষ শিক্ষার সঙ্গে তিনি কখনোই আপোস করতে রাজি ছিলেন না।
তবে তিনি উচ্চশিক্ষাকে সর্বজনীন করে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন না। পরিবর্তে তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কেবল শিক্ষানুরাগী এবং যাদের জ্ঞান অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, তাদের নিয়েই পরিচালিত হবে। এভাবে তিনি সমাজের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাগত সুবিধাগুলির সামঞ্জস্যবিধানের চেষ্টা করেছিলেন।
(3) শিক্ষার দৃষ্টিভঙ্গির সম্প্রসারণ
আজাদ শিক্ষাকে সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি বহুমাত্রিক হাতিয়ার হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। তিনি প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্তরেই শিক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি সম্প্রসারণের উপর জোর দিয়েছিলেন। আজাদ ভারতে প্রাথমিক শিক্ষার কার্যকরী ব্যবস্থা হিসেবে একটি মৌলিক ধরন গ্রহণের উপর গুরুত্ব দেন, যা বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
(4) পারস্পরিক বোঝাপড়া বৃদ্ধি
আজাদ মানবতার ঐক্যসাধনে বিশ্বাসী ছিলেন। এ কারণেই তাঁর বিশ্বদর্শন জাতীয় সীমানা, ধর্ম, সংস্কৃতি ইত্যাদিকে অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক ঐক্য স্থাপনের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, শিক্ষার বিস্তারের মাধ্যমেই পারস্পরিক এই বোঝাপড়া গড়ে তোলা সম্ভব। কারণ প্রকৃত শিক্ষার দ্বারা ব্যক্তির মানবতাবোধের বিকাশ ঘটে যা ধর্মীয় উন্মাদনা রোধ, আর্থিক সমৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক অগ্রগতি এবং রাজনৈতিক মুক্তির পথকে প্রশস্ত করে।
শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর চিন্তাভাবনা ও লক্ষ্যগুলি বর্তমানেও নানাভাবে ভারতের শিক্ষানীতিকে প্রভাবিত করে চলেছে। কারণ তাঁর লক্ষ্যগুলি হল অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়সঙ্গত এবং আলোকিত সমাজগঠনের ভিত্তিস্বরূপ।
(5) জাতীয় উন্নয়ন
আজাদ শিক্ষাকে জাতীয় অগ্রগতির মাধ্যম হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ভারতের স্বাধীনতা এবং আধুনিকীকরণের সংগ্রামের প্রেক্ষাপট একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী একটি জাতির উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
(6) আধুনিকীকরণ
তিনি সমসাময়িক চাহিদা এবং বৈশ্বিক মানদণ্ডের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার জন্য ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ করতে চেয়েছিলেন। এতে ঐতিহ্যগত শিক্ষার পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত – শিক্ষার প্রসার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
(7) ক্ষমতায়ন ও সমতা
আজাদ নারীর ক্ষমতায়নের জন্য গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। তিনি লিঙ্গ সমতা অর্জনের জন্য শিক্ষাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, নারীদের শিক্ষিত করার বিষয়টি সমাজে আরও গুণগত পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে।
পাঠক্রম সম্পর্কে আজাদের মত
আজাদ মনে করতেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং পাঠক্রমের পরিবর্তন প্রয়োজন। তিনি স্বাধীন ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব মুক্ত একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আজাদ একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ যুগোপযোগী পাঠক্রমের কথা বলেন, যা ঐতিহ্যগত ও আধুনিক উভয় বিষয়কে একীভূত করে। তিনি শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে বিস্তৃতি পরিসরে সজ্জিত করার জন্য শাস্ত্রীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যাকে অন্তর্ভুক্ত করার উপর জোর দেন।
(1) প্রাথমিক শিক্ষা
আজাদ প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বজনীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তবে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি ‘Learning by doing’ বা ‘কাজের মাধ্যমে শেখা’ কৌশলটির উপর জোর দিয়েছিলেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হবে বলে তিনি মনে করেছিলেন, যা তাদের সামগ্রিক বিকাশের পক্ষে সহায়ক হবে।
এ ছাড়া তিনি বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা সুনিশ্চিত করার জন্য ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে বি জি খের-এর নেতৃত্বে একটি কমিটি (Kher Committee for Elementary Education) গঠন করেছিলেন, যা ৬-১৪ বছর পর্যন্ত সকল শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করেছিল।
(2) মাধ্যমিক শিক্ষা
তৎকালীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতম অংশ মাধ্যমিক শিক্ষাকে আজাদ ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। মাধ্যমিক স্তরে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে লক্ষণস্বামী মুদলিয়র-এর নেতৃত্বে গঠিত মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন (Secondary Education Commission)-এর পরামর্শ অনুযায়ী পাঠক্রমকে পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পাঠক্রম প্রস্তুতের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা এবং যোগ্যতার প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়।
(3) উচ্চশিক্ষা
আজাদ বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে শিক্ষাগত মানোন্নয়ন করার প্রয়োজনীতার উপর জোর দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি উচ্চশিক্ষার পাঠক্রমকে আরও সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত করার কথা বলেছিলেন, যা শিক্ষার্থীদের আরও জটিল ও পঠন-পাঠনের বিশেষীকরণ (Specialized field of study) -এর ক্ষেত্রগুলি প্রস্তুত করবে।
(4) প্রাযুক্তিক শিক্ষা
মৌলানা আজাদ শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর কল্পিত শিক্ষাব্যবস্থার চরিত্র ছিল বৈজ্ঞানিক প্রকৃতির। তিনি মনে করতেন, দেশের প্রয়োজনে পর্যাপ্ত পরিমাণ কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষার প্রসার সাধন করা। এর দ্বারা তিনি যুবসম্প্রদায়ের জীবনকে সমৃদ্ধ করে তুলতে চেয়েছিলেন। আজাদ ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা বোর্ড (Central Advisory Board)- এর একটি সভায় সকল স্তরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির একত্রীকরণের উপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, “আমার মনে হয় কৃষি, চিকিৎসা, প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদিকে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়ন করা প্রয়োজন।”
আজাদ অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন (AICTE)- কে পুনর্গঠন করার কথা বলেন। প্রাযুক্তিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিনি কর্মসংস্থান বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, তিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (IITs) স্থাপনের উপর জোর দিয়েছিলেন এবং ভারতে খড়গপুরে প্রথম আই আই টি স্থাপন করেছিলেন।
(5) প্রাপ্তবয়স্ক সাক্ষরতা এবং সামাজিক শিক্ষা
প্রাপ্তবয়স্কের স্বাক্ষরতা (Audult Literacy) এবং সামাজিক শিক্ষা কর্মসূচি (Social Education Program) মূলত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সচেতনতা এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে গৃহীত হবে, যার ফলে সামাজিক উন্নয়ন বৃদ্ধি পাবে বলে মৌলানা আজাদ বিশ্বাস করতেন।
(6) গ্রামীন শিক্ষা
গ্রামীন শিক্ষার ক্ষেত্রে আজাদ বৃত্তিমূলক (Vocational) ও ব্যবহাররিক (Practical) দক্ষতার তাৎপর্যকে স্বীকার করে কৃষি ও কারুশিল্পের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সামাজিক সংস্কার ও সাম্যের হাতিয়ার হিসেবে গ্রামীণ শিক্ষার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক।
(7) শারীরবৃত্তীয় শিক্ষা
শারীরিক শিক্ষা তথা (শরীর চর্চা) খেলাধূলা, বিনোদন (recreation) ইত্যাদিকে সকল স্তরের শিক্ষা কার্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছিল, যা শিক্ষার্থীদের শারীরিক স্বাস্থ্য বিকাশে অবদান রাখে। এভাবে জ্ঞানকে তিনি নিছক শিক্ষার পাঠক্রম অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাঁর মধ্যে বৈচিত্রের প্রসার ঘটানো হয়।
আজাদ ও নারীশিক্ষা
আজাদ মনে প্রাণে নারীশিক্ষার গুরুত্বকে উপলব্ধি করেছিলেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয় আইনসভায় ভাষণ প্রদানকালে তিনি নারীদের আধুনিক বিজ্ঞান ও জ্ঞান চর্চার উপর জোর দেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, জাতীয় শিক্ষার কোনো কর্মসূচিই সফল হতে পারে না, যদি সেটা সমাজের নারীদের শিক্ষা ও অগ্রগতির কথা বিবেচনা না করে। নারীশিক্ষা সম্পর্কে তিনি বলেন, স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে শিক্ষা নারীর মৌলিক অধিকার। তিনি আরও বলেন যে, নারীশিক্ষা তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত করার কাজকে আরও সহজ করে দেয়। তাই তিনি শিক্ষাকে সম্প্রসারিত করে নারীদের অন্তর্ভুক্তির কথা বলেন।
প্রথাগত সামাজিক মনোভাব এবং কু-আচারগুলি মহিলাদের অগ্রগতির সুযোগসুবিধাগুলিকে সীমাবদ্ধ করে। নারীদের উপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে আজাদ এই বাধাগুলিকে দূর করার চেষ্টা করেছেন। তিনি শিক্ষাকে সমাজের নারীর মর্যাদায় উন্নত করা মাধ্যম হিসেবে দেখেছেন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর কার্যকরী ভূমিকা আশা করেছিলেন।
আজাদ আরও সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে বলেন, পরিবারে মা শিক্ষিত হলে তার শিশুও শিক্ষিত হবে। তাই বলা যায়, নারীশিক্ষার বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র প্রগতিশীল ছিল না, বরং তিনি মনে করতেন নারীশিক্ষার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন সুনিশ্চিত হবে, যা সমাজ বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা নেবে।
শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে আজাদের অভিমত
ভারতের সদ্য স্বাধীনতা লাভের পরই শিক্ষার মাধ্যম কী হবে এই নিয়ে শিক্ষা দফতর এক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। এ বিষয়ে মৌলানার অবস্থান ছিল স্পষ্ট। তিনি মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের কথা বলেন। তিনি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন যে, প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কারণ, শিশুরা মাতৃভাষায় সহজে শিখতে পারবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেছিলেন। তবে উচ্চশিক্ষায় ধীরে ধীরে আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষাদানের কথা বলা হয়।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি শিক্ষার মাধ্যমে হিসেবে ত্রিভাষা সূত্র (Three Language Formula) প্রস্তাব করেছিলেন। সেটি হল-
- শিক্ষার প্রাথমিক মাধ্যম আঞ্চলিক ভাষা হওয়া উচিত।
- উচ্চশিক্ষায় সকল শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ বা ব্যবহার করতে হলে ৫ বছরের সময়সীমা প্রদান করা উচিত।
- বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য ইংরেজি ভাষার উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
তবে অপর এক বক্তৃতায় আজাদ স্পষ্টভাবে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ভবিষ্যতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষার কোনো স্থান ভারতে নেই। এ ছাড়া তিনি বলেন যে, কোনো পরিবর্তন ধীরগতিতে হওয়া উচিত, বিশেষত উচ্চশিক্ষায়। এই কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ৫ বছরের জন্য ভাষাগত মাধ্যমে স্থিতাবস্থা রক্ষার কথা বলা হয়। তবে, ধীরে ধীরে উচ্চপর্যায়ে ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিস্থাপন (Replacement)-এর কথাও বলা হয়েছিল। যদিও আঞ্চলিক ভাষাকেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সমর্থন করা হয়েছিল।
শিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা
মৌলানা আজাদ শিক্ষা সম্পর্কিত প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের ভূমিকা সম্পর্কে গভীর ও দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষকেরা কেবলমাত্র জ্ঞানের প্রসারক নন বরং, তারা শিক্ষার্থীদের চরিত্র এবং বৌদ্ধিকতা গঠনেরও সহায়ক। শিক্ষকদের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সংক্ষেপে আলোচিত হল-
(1) আদর্শ বা রোল মডেল
আজাদ শিক্ষকের ভূমিকাকে শিক্ষার্থীদের কাছে রোল মডেল বা আদর্শ হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। মৌলানার মতে, শিক্ষকদের উচিত জীবনে নৈতিকতাও মূল্যবোধকে অনুসরণ করা। শিক্ষকদের এই নৈতিক চরিত্রই ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক চরিত্রকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে। অর্থাৎ, ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক চরিত্র গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা পালনকে তিনি চিহ্নিত করেন।
(2) উৎকর্ষবিধান ও সমালোচনামূলক চিন্তায় উৎসাহপ্রদান
একজন শিক্ষকের সব থেকে বড় ভূমিকা হল ছাত্রদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং স্বাধীন বিচারের বিকাশ ঘটানো। শিক্ষকদের উচিত ছাত্রদের প্রশ্ন করা, বিশ্লেষণ এবং তথ্যমূলক মূল্যায়নে উৎসাহিত করা, বৌদ্ধিক বিকাশে ও কৌতুহল বৃদ্ধিতে সহায়তা করা।
(3) জাতীয় ঐক্য লালনকারী
আজাদ বলেন যে, শিক্ষকদের জাতীয় ঐক্য ও সামাজিক সংহতি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত। শিক্ষকরাই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দেশপ্রেমবোধ জাগ্রত করতে পারেন বলে আজাদ মনে করতেন।
(4) ভাষা ও সংস্কৃতির সংরক্ষক
আঞ্চলিক ভাষার প্রসার ও সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা শিক্ষকদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। ভারতের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার দায়িত্ব আজাদ তাদের উপরেই অর্পণ করেছিলেন।
(5) উদ্ভাবনীমূলক শিক্ষায় উৎসাহপ্রদান
শিক্ষকের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনীমূলক পদ্ধতি ব্যবহারের উপর আজাদ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। আজাদের বক্তব্য ছিল, শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য শিক্ষামূলক অনুশীলনের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত বিষয়গুলিকেও শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক।
(6) নারীর ক্ষমতায়ন
মৌলানা আজাদ নারীশিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের উপর জোর দিয়েছিলেন, তিনি আশা রেখেছিলেন যে, নারীশিক্ষা বিস্তারে শিক্ষকরা অগ্রণী ভূমিকা নেবে এবং শ্রেণিকক্ষে লিঙ্গ সমতাকে বজায় রাখবেন।
(7) বৈশ্বিক জ্ঞানের সংযোগরক্ষাকারী
আজাদ বলেন, শিক্ষকদের বৈশ্বিক অগ্রগতি এবং জ্ঞান সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। একজন শিক্ষককে আঞ্চলিক ভাষা এবং বৈশ্বিক জ্ঞানের দূরত্বের মাঝে সেতুবন্ধনকারীর ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে ছাত্ররা তথ্য এবং ধারণার বিস্তৃত জগত সম্পর্কে অবগত হতে পারে।
উক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, মৌলানা আজাদ একজন শিক্ষককে কেবল শিক্ষাবিদ হিসেবে দেখেননি বরং, তাদের নৈতিক পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, যিনি ছাত্রের বিশ্লেষণমূলক চিন্তনকে গড়ে তুলতে, দেশের ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করতে এবং দেশের ঐতিহ্যকে সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
(8) উন্নয়নে সহায়ক
তিনি শিক্ষকদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় বিষয়ের উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে দেখেছেন। সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক গঠনের মাধ্যমে শিক্ষকরা জাতির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
আরও পড়ুন – সরকারের বিভিন্ন রূপ প্রশ্ন উত্তর