প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য | প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম | প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যা | প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যা সমাধানের উপায় | প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব ( Exclusive Answer)

ভারতে এখনও পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাই হল নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার প্রথম স্তর। স্বাধীনতার আগে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর একাধিক রিপোর্ট পেশ হলেও (হান্টার কমিশন, কার্জনের সুপারিশ, বুনিয়াদি শিক্ষা, সার্জেন্ট রির্পোট ইত্যাদি) প্রাথমিক শিক্ষার ওপর তেমন গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। স্বাধীনতার পরে সাংবিধানিক নির্দেশ অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও সর্বজনীন করার কথা বলা হয়েছে। এখানে নিম্ন ও উচ্চ-উভয় স্তরের প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়ে সামগ্রিকভাবে আলোচনা করা হল।

প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ও পাঠক্রম

প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ও পাঠক্রম
প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ও পাঠক্রম

প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য

প্রাথমিক শিক্ষা হল ব্যক্তির পক্ষে ন্যূনতম আবশ্যিক শিক্ষা, যা তাকে গণতন্ত্রের উপযুক্ত নাগরিক হয়ে উঠতে সাহায্য করে। সামগ্রিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হল-

(1) শারীরিক বিকাশ: 

শরীরচর্চা, ব্যায়াম, খেলাধুলো প্রভৃতি নানান ধরনের সঞ্চালনমূলক কাজের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের শারীরিক বিকাশে সহযোগিতা করা।

(2) মানসিক বিকাশ: 

এই বয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে চিন্তাশক্তি, বিচারক্ষমতা, সৃজনশীলতা, কল্পনাশক্তি প্রভৃতির যথাযথ বিকাশে সাহায্য করা।

(3) সামাজিক বিকাশ: 

সমাজতত্ত্বসম্মত সামাজিক আচার-আচরণে ও সমাজকল্যাণকর দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সাহায্য করা।

(4) প্রাক্ষোভিক বিকাশ: 

ছেলেমেয়েদের মধ্যে সমাজের পক্ষে কাম্য প্রক্ষোভগুলির ব্যবহার গড়ে তোলা, সেগুলিকে আরও পরিণত করে তোলা এবং প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখানো।

(5) জ্ঞানের বিকাশ: 

এই স্তরের ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান, গণিত, ভাষা, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানার্জনে সাহায্য করা।

(6)  নাগরিকতার শিক্ষা: 

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভাবী সুনাগরিকরূপে শিক্ষার্থীর উপযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি গঠন।

(7) শ্রমের মর্যাদা উপলব্ধি: 

‘কোনো কাজই ছোটো নয়’-এই বোধ শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাগিয়ে তোলা।

(8) সৌন্দর্যবোধের বিকাশ: 

বিদ্যালয়ে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৌন্দর্যবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করা।

(9) নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ: 

বিভিন্ন রকম পাঠক্রমিক ও সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির সাহায্যে ভালোমন্দের বিচার, ন্যায়-অন্যায় বোধ, কোন্টা করণীয় কোন্টা করণীয় নয় ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন করা এবং আচরণের মধ্যে দিয়ে তা প্রকাশ করতে উৎসাহিত করা।

(10) দেশ ও জাতির উন্নয়ন: 

দেশ ও জাতির উন্নয়নকল্পে বিভিন্ন কর্মসূচি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা।

প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম

প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রমকে কোঠারি কমিশন দুটি স্তরে ভাগ করেছে নিম্নপ্রাথমিক (প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি) এবং  উচ্চপ্রাথমিক (পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি)। এই দুটি স্তরের জন্য দু-রকমের পাঠক্রমের উল্লেখ করা হয়েছে।

(1) নিম্নপ্রাথমিক স্তরের পাঠক্রম: 

এই স্তরে শিশু শিখনের মৌলিক কৌশলগুলি, যেমন-পঠন, লিখন ও প্রাথমিক গণিত শিখবে। এর পাশাপাশি প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের উপায়গুলি আয়ত্ত করবে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অভ্যাসগুলি আয়ত্ত করবে। পঠন-ক্ষমতার ওপর দক্ষতা অর্জনে বিভিন্ন কার্যসূচি পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হবে। এই স্তরের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হবে- [i] একটি ভাষা (মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা), [ii] গণিত, [iii] পরিবেশ পরিচিতি, [iv] সৃজনশীল কার্যাবলি, [v] প্রত্যক্ষ কর্ম-অভিজ্ঞতা ও সমাজসেবা এবং [vi] শারীরশিক্ষা।

(2) উচ্চপ্রাথমিক স্তরের পাঠক্রম: 

এই স্তরের পাঠক্রম বিস্তৃত এবং গভীর হবে। শিক্ষার্থীকে মাতৃভাষার পাশাপাশি দ্বিতীয় একটি ভাষা শিখতে হবে। গণিত, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, পৌরবিদ্যা, শারীরশিক্ষা পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হবে। এই স্তরের পাঠক্রমে থাকবে-[i] দুটি ভাষা [মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা এবং হিন্দি (সরকারি ভাষা) বা ইংরেজি], [ii] গণিত, [iii] সমাজবিদ্যা (ইতিহাস, ভূগোল এবং পৌরবিদ্যা), [iv] সাধারণ বিজ্ঞান, [v] শিল্প বা চারুকলা, [vi] প্রত্যক্ষ কর্ম-অভিজ্ঞতা ও সমাজসেবা, [vii] শারীরশিক্ষা এবং [viii] নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের শিক্ষা।

সংক্ষেপে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম সম্পর্কে বলা যায়, এই শিক্ষা প্রাথমিক স্তরে খেলাধুলো ও শরীরচর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর দেহের সুষম বিকাশে সাহায্য করে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন সৃজনশীল এবং উৎপাদনমূলক ক্ষমতার বিকাশ ঘটায় এবং নানা ধরনের অভিজ্ঞতামূলক কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মানসিকতার উন্নতি ঘটায়। এর সঙ্গেই পঠনপাঠনের মাধ্যমে ভাষা ও গণিতের চর্চা, পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তুলতে এবং স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের দ্বারা শিক্ষার্থীকে সমাজ ও জাতির এক উপযুক্ত উপাদান হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।

প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠান বা বিদ্যালয়

আমাদের দেশে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান দেখা যায়। এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে সামগ্রিকভাবে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়-

এখানে প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-

(1) সরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: 

এই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্ত দায়দায়িত্ব সরকার বহন করে। শিক্ষকের বেতন, আনুষঙ্গিক খরচ রাজ্য সরকারের তহবিল থেকে দেওয়া হয়। নিয়মকানুন, পাঠক্রম, পুস্তক ইত্যাদি সবই সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের বেতন দিতে হয় না। বইপত্র বিনা পয়সায় সরকার সরবরাহ করে। তবে এই ধরনের অনেক বিদ্যালয় আছে যেগুলির আর্থিক দায়দায়িত্ব সরকার বহন করলেও, বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য আলাদা একটা কমিটি থাকে। যদিও সেই কমিটিতে কারা থাকবেন তা সরকার অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ কর্তৃক নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।

(2) বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: 

এই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকার কোনো আর্থিক সাহায্য করে না। বিদ্যালয় পরিচালনার ওপর সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করে না। বিদ্যালয় পরিচালনার যাবতীয় খরচ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই বহন করতে হয়। শিক্ষার্থীদের বেতন দিয়ে পড়তে হয়। সরকার কর্তৃক নির্দেশিত পাঠক্রম এবং সরকার প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তক চালু করার ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। গ্রামাঞ্চলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি জনপ্রিয়। শহর ও মফস্সলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই ছাত্রাধিক্য দেখা যায়।

(3) এক-শিক্ষক পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: 

এই ধরনের প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন মাত্র শিক্ষক বিশেষ পদ্ধতির সাহায্যে বা বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিয়ে পড়ান। গ্রামাঞ্চলে এই ধরনের বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রচুর।

(4) বুনিয়াদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: 

বুনিয়াদি শিক্ষার জনক মহাত্মা গান্ধি বুনিয়াদি ভাবধারায় প্রাথমিক শিক্ষার কথা উল্লেখ করেন। এখানে বুনিয়াদি পাঠক্রমকে অনুসরণ করা হয়। শিক্ষার্থীকে কোনো বেতন দিতে হয় না। বর্তমানে এই ধরনের বিদ্যালয়ের সংখ্যা খুব কম।

(5) ধর্মীয় সংস্থা পরিচালিত প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: 

বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্থা শিক্ষার মাধ্যমে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে। ধর্মীয় সংস্থা হিসেবে এগুলি সংবিধান স্বীকৃত কিছু সুবিধা পেয়ে থাকে। নিয়মকানুন, পাঠক্রম সবই ধর্মীয় সংস্থাই স্থির করে। সংস্থাই আর্থিক দায়দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই ধরনের বিদ্যালয়ের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম।

(6) প্রথামুক্ত প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: 

এই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে বিভিন্ন সময়ে পাঠদানের ব্যবস্থা থাকে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের সুযোগমতো সময়সূচি ও পাঠক্রম স্থির করার সুযোগ পায়। বিভিন্ন স্বাক্ষরতা কেন্দ্র এবং নৈশবিদ্যালয় এই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদাহরণ।

আমাদের দেশে ওপরে উল্লিখিত প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠান, যেমন-কর্পোরেশন এবং বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে।

প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যা

প্রথাগত শিক্ষা কাঠামোর প্রথম স্তর হল ‘প্রাথমিক শিক্ষা’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রাথমিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সাংবিধানিক নির্দেশে প্রাথমিক শিক্ষার কিছু অগ্রগতি হলেও আজও এই শিক্ষা বহু সমস্যায় জর্জরিত এবং ত্রুটিপূর্ণ। প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন সমস্যাগুলি নীচে উল্লেখ করা হল-

(1) আর্থিক সমস্যা: 

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রগতিশীল দেশের তুলনায় আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি আর্থিক বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এ ছাড়া অভিভাবকদের আর্থিক দুরবস্থা ও দারিদ্র্য প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতিতে বাধা দেয়। অর্থনৈতিক কারণে, শিশুদের বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য মাঠে বা কারখানায় পাঠানো হয়। তাদের রোজগার পরিবারের আয়ের অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। সুতরাং, প্রাথমিক শিক্ষার বিকাশ ঘটবে কীভাবে?

(2) সামাজিক সমস্যা: 

বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার কারণে সাক্ষরতা ও গণশিক্ষার আলো আজও আমাদের দেশের সব মানুষের কাছে পৌঁছোয়নি। আজও নানান সামাজিক কুপ্রথা, রক্ষণশীলতা, অন্ধবিশ্বাস প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতিকে ব্যাহত করছে। বিশেষ করে বলা যায় যে, নারীশিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে এখনও ব্যাপক কুসংস্কার ও ধর্মীয় মতামত রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে এটা একটা বড়ো বাধা।

(3) পরিকাঠামো ও পদ্ধতিগত সমস্যা: 

শিক্ষার পরিকাঠামো ও পদ্ধতিগত কিছু সমস্যার কারণেও প্রাথমিক শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। ত্রুটিপূর্ণ পাঠক্রম, বিদ্যালয়ের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, শ্রেণিকক্ষ ও পরিকাঠামোগত অন্যান্য সুযোগের অভাব, ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাপদ্ধতি ও পরীক্ষাপদ্ধতি, উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকশিক্ষিকার অভাব, বিদ্যালয়ে শিক্ষাসহায়ক উপকরণের অভাব, ত্রুটিপূর্ণ প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রভৃতি প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বা ত্রুটি হয়ে দেখা দিয়েছে।

(4) অপচয় ও অনুত্তীর্ণতা: 

আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে অপচয় এবং অনুত্তীর্ণতা সব থেকে বড়ো বাধা। অপচয় বলতে বোঝায় যেসব ছাত্রছাত্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভরতি হয়, তাদের অনেকেই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই বিদ্যালয় ছেড়ে দেয়। অনুত্তীর্ণতা হল উচ্চশ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে না পারা। বিভিন্ন কারণে এই অপচয় ও অনুত্তীর্ণতার সমস্যা দেখা দেয়। যেমন-বাবা-মায়ের নিরক্ষরতা, অনুপোযোগী পাঠক্রম, মেয়েদের ক্ষেত্রে অল্পবয়সে বিবাহ ইত্যাদি। সাম্প্রতিক শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী অনুত্তীর্ণতাকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য ‘শ্রেণিতে আটকে রাখা যাবে না’ এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।

(5) প্রবল জনসংখ্যার চাপ: 

আমাদের দেশের অত্যধিক জনসংখ্যার অনুপাতে শিক্ষার উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে-যা প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ও উৎকর্ষের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে।

(6) শিশুশ্রমিক আইনের ব্যর্থতা: 

শিশুশ্রমিক রোধে সরকারি প্রচেষ্টা এখনও পর্যন্ত বিশেষ কার্যকরী হয়নি। সমাজে দরিদ্র মানুষের একটি বড়ো অংশ তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর থেকে কোনো কাজে যুক্ত করে দেওয়াটাই বেশি অর্থকরী বলে মনে করে। শিশুশ্রমবিরোধী আইন কাগজে কলমে থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। ফলে বিদ্যালয়গুলি শূন্য। শিশুরা রোজগারে নেমেছে। আর মালিকরাও কম পয়সায় তাদের খাটাচ্ছে।

(7) অন্যান্য সমস্যা: 

বিভিন্ন সময়ে দেশের নানাপ্রান্তে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষদের মধ্যে উপযুক্ত সচেতনতার অভাব, নারী শিক্ষার সমস্যা, অনিয়মিত ও নিম্নমানের মিড্-ডে মিল ইত্যাদি কারণ এদেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ত্রুটিপূর্ণ করে তুলেছে।

প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যা সমাধানের উপায়

প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যাগুলি দূর করার জন্য নিম্নলিখিত উপায় অবলম্বন করা প্রয়োজন-

(1) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি: 

প্রতি এক বর্গকিলোমিটারের মধ্যে কমপক্ষে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করতে হবে। তবে যেখানে জনবসতির ঘনত্ব বেশি বা রাস্তাঘাট দুর্গম, সেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী এক বর্গকিলোমিটারের থেকে কম দূরত্বেও বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।

(2) অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা: 

প্রাথমিক শিক্ষাকে পুরোপুরি অবৈতনিক, সর্বজনীন এবং বাধ্যতামূলক করতে হবে।

(3) বাস্তবোচিত পাঠক্রম: 

বাস্তব জীবনের দিকে লক্ষ রেখে প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং পাঠক্রম নির্ধারণ করতে হবে।

(4) আর্থিক ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি: 

প্রাথমিক শিক্ষাখাতে উপযুক্ত পরিমাণ সরকারি অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হবে।

(5) বিনামূল্যে শিক্ষা-উপকরণ সরবরাহ: 

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেসব ছাত্রছাত্রী ভরতি হবে তাদের প্রত্যেককে বিনামূল্যে বইখাতা ও অন্যান্য শিক্ষাসহায়ক উপকরণ দিতে হবে।

(6) স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও চিকিৎসা: 

বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

(7) জাতীয় নীতি: 

দেশের সর্বত্র একটি সাধারণ নিয়ম মেনে ভাষাশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে প্রাদেশিক সংকীর্ণতা এড়িয়ে শিক্ষার প্রসার সম্ভব হয়।

(8) পরিকাঠামোগত সংস্কার: 

জীর্ণ বিদ্যালয়-গৃহগুলি সংস্কার করে আলো-বাতাসযুক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বিদ্যালয়গৃহের ব্যবস্থা করতে হবে।

(9) আকর্ষণীয় পাঠক্রম: 

প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রমকে ছাত্রছাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে এবং বিভিন্ন প্রকার সহপাঠক্রমিক কাজের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

(10) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক: 

প্রাথমিক শিক্ষায় উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শিক্ষকতার কাজে নিয়োগ করতে হবে।

(11) পরিদর্শনের ব্যবস্থা: 

সরকারের তরফ থেকে নিয়মিত বিদ্যালয় পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে।

(12) বৃত্তিমূলক শিক্ষা: 

মূল তত্ত্বগত বিষয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ব্যাবহারিক বিষয়কেও পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

(13) বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষা-উপকরণের ব্যবস্থা: 

বিদ্যালয়ে সবধরনের প্রয়োজনীয় শিক্ষা-উপকরণের ব্যবস্থা করতে হবে।

(14) শিশুশ্রমিক নিয়োগে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ: 

শ্রম আইনকে কঠোরভাবে চালু করতে হবে যেন শিশুশ্রমিককে কেউ নিয়োগ করতে না পারে। নিয়োগ করলে নিয়োগ কর্তার দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে কেউ আর শিশুশ্রমিক নিয়োগে সাহস না পায়।

(15) মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি: 

মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি করতে হবে। এটা উন্নত হলে তখন আর কোনো অভিভাবক তার শিশুকে শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত করবে না। শিক্ষালাভের জন্য বিদ্যালয়ে পাঠাবে।

(16) কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম: 

কুসংস্কার এবং ধর্মীয় মতান্ধতার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে অব্যাহত রাখতে হবে। শিক্ষার প্রসার বিশেষত স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে এটা জরুরি।

প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশই প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষাসংস্থা ইউনেস্কো (UNESCO) প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার কথা শুরু থেকেই বলে আসছে। ভারতবর্ষেও ব্রিটিশ শাসনকাল থেকেই প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার জন্য জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা দেখা যায়। স্বাধীনতার পরে সংবিধান রচয়িতারা সংবিধানের নির্দেশাত্মক নীতিতে 1960 সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার কথা উল্লেখ করেন। প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্বের কারণেই এই শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সম্প্রতি আমাদের দেশে 2010 সালের 1 এপ্রিল গৃহীত শিক্ষার অধিকার আইনটি প্রারম্ভিক শিক্ষাকে (প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত) বাধ্যতামূলক করার এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।

যেসব কারণের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় সেগুলি হল-

(1) দায়িত্ববান নাগরিক গঠন: 

প্রাথমিক শিক্ষা ব্যক্তিকে সমাজের একজন স্বনির্ভর ও দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ভিত্তি রচনা করে। পরবর্তী এই ভিত্তির উপর গড়ে ওঠে তার বিশাল ব্যক্তিত্বের ইমারত।

(2) অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা গঠন: 

গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তোলে।

(3) সার্বিক বিকাশ:

এই স্তর থেকেই শিশু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রবেশ করে এবং তার শারীরিক, মানসিক, বৌদ্ধিক ও সামাজিক বিকাশের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

(4) মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ভিত্তি: 

শক্তিশালী প্রাথমিক শিক্ষা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে।

(5) জীবিকা অর্জনে সহায়তা: 

ব্যক্তির জীবিকার উৎকর্ষসাধনে এবং জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রাথমিক শিক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(6) গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করা: 

গণতন্ত্রকে সার্থক করতে প্রাথমিক শিক্ষা বিশেষ জরুরি।

(7) সামাজিক ন্যায়বিধান: 

সামাজিক ন্যায়বিধানে প্রাথমিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(8) সাংবিধানিক অধিকার-সংক্রান্ত সচেতনতা: 

সাংবিধানিক অধিকার, সুযোগসুবিধা ইত্যাদি সম্পর্কে নিজে অবহিত হওয়ার জন্য ব্যক্তির প্রাথমিক শিক্ষা প্রয়োজন।

(9) সমসুযোগের অধিকার: 

প্রতিটি নাগরিকের সমান সুযোগকে নিশ্চিত করে তোলার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা হল প্রথম স্তর।

(10) পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা: 

পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা এবং ব্যক্তিজীবনে ন্যূনতম দায়দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা একান্তভাবে জরুরি।

এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, প্রাথমিক শিক্ষা ছাড়া বর্তমানে সার্থকভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।

আরও পড়ুনLink
ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তরClick Here
তেলেনাপোতা আবিষ্কার বড় প্রশ্ন উত্তরClick Here
আগুন নাটকের প্রশ্ন উত্তরClick Here

Leave a Comment