তক্ষশিলা, নালন্দা ও বিক্রমশীলার ভূমিকা – বৈদিক ভারতের মৌলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল গুরুকুল। প্রতিটি গুরুকুলের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকলেও সর্বোচ্চ জ্ঞান প্রচারের কেন্দ্র ছিল ব্রাহ্মণ সংঘ। বেদ ও ব্রাহ্মণের পরেই আরণ্যকের উদ্ভব হয়। ঋষিরা এই সময় জনবহুল স্থান থেকে দূরে তপোবনে জ্ঞানের সন্ধানে আসেন এবং আশ্রম গড়ে তোলেন। শিক্ষার্থীরাও ঋষি গুরুর কাছ থেকে জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে তপোবনে সমবেত হয় এবং আশ্রম বালক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই আশ্রমই বৈদিক ভারতে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গণ্য হয়।
নৈমিষারণ্যে কুলপতি সমকের আশ্রম এবং প্রয়াগে ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রম যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল। প্রাচীন ভারতের আর-একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান ছিল পরিষদ। দার্শনিক তত্ত্বের ব্যাখ্যা এবং সে সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়ার জন্য পন্ডিতদের সভাকেই পরিষদ বলা হত। যেসব স্থানে ঘন ঘন পরিষদ বসত সেখানে ক্রমশ পন্ডিতদের স্থায়ী উপনিবেশ গড়ে ওঠে। প্রখ্যাত গুরুদের কাছে পাঠলাভের জন্য ছাত্ররা আসতে থাকে। গুরুশিষ্যের এই মিলনক্ষেত্রই প্রাচীন ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়। এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- তক্ষশিলা, নালন্দা, বিক্রমশীলা প্রভৃতি।
প্রাচীন ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে তক্ষশিলা, নালন্দা ও বিক্রমশীলার ভূমিকা

প্রাচীন ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র (Institutional Education Centers of Ancient India)
তক্ষশিলা
তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু ব্রাহ্মণ্য যুগে হলেও বৌদ্ধ যুগ পর্যন্ত এর স্থায়িত্ব দেখা যায়। বলা যেতে পারে, এই বিশ্ববিদ্যালয় উভয় যুগের মধ্যে একটি যোগসূত্র রচনা করেছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনা করা হল-
(1) অবস্থান:
কথিত আছে, রাজা ভরত প্রাচীন গাম্বারের রাজধানী তক্ষশিলায় এই শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন। প্রায় বারো বর্গমাইল জায়গা জুড়ে তক্ষশিলা অবস্থিত ছিল। বর্তমানে এই অঞ্চলটির অবস্থান পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির কাছে। তক্ষশিলায় বহু পন্ডিতের সমাবেশ হয়েছিল। সেইসব পন্ডিতের কাছ থেকে শিক্ষালাভের জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সমাবেশ ঘটে। গড়ে ওঠে বিভিন্ন গুরুর অধীনে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোটো ছোটো বিদ্যালয়।
(2) শিক্ষাব্যবস্থা:
তক্ষশিলা ছিল উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র। শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক ও সাধারণ শিক্ষা শেষ করে তক্ষশিলায় আসত উচ্চশিক্ষার জন্য। তক্ষশিলায় প্রবেশের বয়স ছিল ষোলো বছর। প্রায় আট বছর সেখানে তারা শিক্ষাগ্রহণ করত। প্রতিটি বিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা যথেষ্ট ছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা শিক্ষালাভের অধিকারী ছিল। শূদ্রদের শিক্ষার অধিকার ছিল না। ধনী ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ আবাসিক ছিল না। শিক্ষালাভের জন্য গুরুগৃহে বা পৃথকভাবেও থাকা যেত।
(3) শিক্ষার ব্যয়:
তক্ষশিলায় শিক্ষা অবৈতনিক ছিল না। অবস্থাপন্ন শিক্ষার্থীরা শিক্ষার শুরুতেই বেতন দিত। অন্যান্যরা শিক্ষাশেষে বেতন দিত। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা অর্থের পরিবর্তে দিনে গুরুগৃহে নানাধরনের দৈহিক পরিশ্রম করত এবং রাত্রে পাঠ গ্রহণ করত। অনেক সময় ধনী পরিবার দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করত।
(4) পাঠ্যসূচি:
চতুর্বেদ, ইতিহাস, পুরাণ, দর্শন-শাস্ত্রাদি, হিন্দু ও বৌদ্ধধর্ম, ব্যাবসাবাণিজ্য, রাজনীতি, হিসাবশাস্ত্র, নৌ ও জাহাজ নির্মাণ, ভাস্কর্য, কৃষি, চিত্রাঙ্কন, হস্তশিল্প, মানুষ ও পশুচিকিৎসা, সামরিক বিদ্যা প্রভৃতির উল্লেখ পাঠ্যসূচিতে পাওয়া যায়। শিক্ষাসূচিতে ব্যাবহারিক দিকে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হত। বিদ্যার সম্পূর্ণতার জন্য ভ্রমণ ছিল শিক্ষার বিশেষ অঙ্গ।
(5) শিক্ষাদান পদ্ধতি:
মৌখিক পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা হলেও আলোচনা ও বিতর্ক ছিল শিক্ষাদানের বিশেষ অঙ্গ। ব্যক্তিগত ও দলগত উভয়ভাবেই শিক্ষা দেওয়া হত। রাজপুত্র ও সাধারণ শিক্ষার্থী সকলকেই একসঙ্গে শিক্ষা দেওয়া হত।
(6) মূল্যায়ন:
লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। তবে মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর কৃতিত্বের মূল্যায়ন করা হত। এ ছাড়া আলোচনা ও বিতর্কসভায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন হত। ব্যাবহারিক বিদ্যার পরীক্ষা ছিল তক্ষশিলার বৈশিষ্ট্য। চিকিৎসাবিদ্যা, সামরিকবিদ্যায় ব্যাবহারিক পরীক্ষা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
(7) শিক্ষকমণ্ডলী:
তক্ষশিলায় শিক্ষকমণ্ডলী ছিলেন বিভিন্ন বিষয়ে সুপন্ডিত। অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী, গুরুদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি ছিল, যেমন-শিষ্ট, দন্তনীতিক, পুরোহিত ইত্যাদি। পাণিনির মতে, শিক্ষকদের শ্রেণিভেদের মধ্যে ছিল গুরু, আচার্য, উপাধ্যায় ইত্যাদি। উপাধ্যায়া, আচার্যা প্রভৃতির উল্লেখ থাকায় মনে করা হয় যে, এই সুপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলারাও শিক্ষাদানে নিযুক্ত থাকতেন।
(8) শৃঙ্খলা:
তক্ষশিলার শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কেই কিছু নিয়ম মেনে চলতে হত। ফলে শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা খুব কম দেখা যেত।
কুষাণ যুগ পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব অক্ষুণ্ণ ছিল। পরে হুন আক্রমণের ফলে এর গৌরব অস্তমিত হয়।
নালন্দা
প্রাচীন ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খ্যাতিলাভ করেছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। বৌদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে নালন্দার খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
(1) অবস্থান:
রাজগিরের সাত মাইল উত্তরে (বর্তমান বরাগাত্তের কাছে) নালন্দা নামে একটা গ্রাম ছিল। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে ফা-হিয়েনের সময় নালন্দাকে ‘নালা’ বলা হত।
(2) গঠন:
প্রায় সাড়ে তিন বর্গমাইল জুড়ে অবস্থিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়টি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল। পাঁচিলের গায়ে একটি দরজা ছিল, সেটি খুললেই আলাদা আলাদা আটটি হলঘর দেখা যেত। ঘরগুলির মাঝখানে ছিল সংঘারাম। সব দালানগুলিই ছিল একাধিক তলাবিশিষ্ট। সেখানে প্রায় দশ হাজার শিক্ষার্থী এবং এক হাজার শিক্ষক থাকার ব্যবস্থা ছিল।
(3) ব্যয়ভার:
নালন্দার জমি, মঠ, দৈনন্দিন ব্যয়নির্বাহ ইত্যাদি সবেরই উৎস ছিল দান। হিউয়েন-সাং বলেন, পাঁচশো ব্যবসায়ী দশকোটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে জমি কিনে বুদ্ধদেবকে এই জমি দান করেন। শতাব্দীব্যাপী একের পর এক রাজ্যের অবিরত দানের ফলেই ছয় তলাবিশিষ্ট মঠের নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল। যতদূর জানা গেছে একশোটি গ্রামের রোজগার, বিত্তশালী ব্যক্তিদের দান এবং রাজাদের আর্থিক আনুকূল্যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালানো হত।
(4) অবৈতনিক শিক্ষা:
সম্পত্তির আয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় তার সমস্ত ছাত্রদের জন্য বিনামূল্যে খাদ্য, পোশাক, থাকার ব্যবস্থা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করত।
(5) প্রবেশাধিকার:
নালন্দায় প্রবেশের পরীক্ষা খুবই কঠিন ছিল। হিউয়েন-সাং উল্লেখ করেছেন মাত্র কুড়ি শতাংশ পরীক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হত। ভরতির বয়স নির্দিষ্ট ছিল কুড়ি বছর। অভ্যন্তরীণভাবে নিয়মিত ছাত্রদের মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। তাদের ক্ষেত্রে প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রয়োজন হত না।
(6) পাঠক্রম:
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠক্রম ছিল বিস্তৃত। সেই সময়কার সমগ্র জ্ঞান এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ধর্মীয়, ধর্মনিরপেক্ষ, দার্শনিক ও ব্যাবহারিক, বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যা প্রভৃতি শিক্ষার বিভিন্ন শাখার পঠনপাঠনের ব্যবস্থা ছিল। নালন্দার শিক্ষার্থীদের আঠারোটি কলাবিদ্যা, বেদ ও অন্যান্য গ্রন্থ, হেতুবিদ্যা, শব্দবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, জাদুবিদ্যা, অথর্ব বেদ, সাংখ্য প্রভৃতি পঠনপাঠনের সুযোগ ছিল।
(7) শিক্ষাদান পদ্ধতি:
নালন্দাতে আবৃত্তির মাধ্যমে পাঠদান হত। এ ছাড়া আলোচনাচক্র, বিতর্ক প্রভৃতি মৌখিক উপায়ও অবলম্বন করা হত।
(8) গণতান্ত্রিক পরিচালনা:
ইৎ-শিঙের মতে মঠের জীবনযাত্রা কঠোর নিয়মশৃঙ্খলায় আবদ্ধ থাকলেও ঘর ভাগ করা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যাবলি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসারে পরিচালিত হত। নালন্দার বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে সংহতি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। হিউয়েন-সাং উল্লেখ করেছিলেন যে, সাত শতক ধরে এই সংহতিতে একটি ঘটনাও নথিভুক্ত নেই, যেটি অপরাধমূলক কাজের দ্বারা কলঙ্কিত হয়েছে। সংঘচেতনা ব্যক্তি-সন্ন্যাসীদের থেকে বেশি গুরুত্ব পেত। নালন্দার সন্ন্যাসীরা বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তবে তাঁরা নিজেদের মধ্যেকার সংহতিকে কোনোভাবেই বিপন্ন হতে দিতেন না। গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আদর্শগত মতপার্থক্যকে বিতর্ক ও আলোচনার সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করতে হত।
(9) শৃঙ্খলা:
নালন্দা বিহারে শিক্ষার্থী ও অধ্যাপক সকলকেই শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলতে হত। শুধু যে শয্যাগ্রহণ ও শয্যাত্যাগের নির্দিষ্ট সময় ছিল তাই নয়, এর মধ্যবর্তী সময়ে কখন কী করতে হবে এবং কীভাবে করতে হবে তাও সুনির্দিষ্ট ছিল। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সমাজগত অবস্থানের কোনো প্রভাব ছিল না। রাজপুত্র এবং সাধারণ পরিবারের সন্তান সকলকেই শৃঙ্খলা মেনে চলতে হত।
(10) গ্রন্থাগার:
নালন্দায় উত্তম মানের গ্রন্থাগার ছিল। গ্রন্থাগারটি একটি বিশেষ অঞ্চলে অবস্থিত ছিল যার নাম ছিল ধর্মগঞ্জ। রত্নসাগর, রত্নদধি ও রত্নরঞ্জক নামে তিনটি বড়ো গৃহ নিয়ে এটি গঠিত।
(11) অধ্যাপকমণ্ডলী:
শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে নালন্দার খ্যাতি প্রধানত এর বিখ্যাত শিক্ষকমন্ডলীর কারণে ঘটেছিল। এক্ষেত্রে যাঁদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন-ধর্মপাল, শীলভদ্র, চন্দ্রপাল, গুণমতী ও স্থিরমতি, প্রভামিত্র, জিনামিত্র, জ্ঞানচন্দ্র প্রমুখ।
(12) খ্যাতি:
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি চিন, তিব্বত, কোরিয়া, জাভা, সুমাত্রা, সিংহল, যবদ্বীপ প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
(13) ধবংস:
পালরাজত্বের শেষদিকে নালন্দার গৌরব ম্লান হয়ে পড়ে। গোষ্ঠী সংঘর্ষ ও আভ্যন্তরীণ কলহের ফলে নালন্দার জীবনযাত্রার মানের অবনতি ঘটে। সেই সময়ে মুসলিম সেনাপতি বস্তিয়ার খলজির আক্রমণে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়।
(14) মূল্যায়ন:
মোট কথা প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এক অত্যন্ত গৌরবোজ্জল স্থান দখল করেছিল। তার গণতান্ত্রিক পরিচালন ব্যবস্থা, অত্যন্ত উন্নতমানের শিক্ষকমণ্ডলী, সুসমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, ছাত্র-শিক্ষক সবার জন্য শৃঙ্খলা বিধান-ইত্যাদি কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক খ্যাতির শিখরে ওঠে। আমাদের দেশের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশও প্রাচীন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে।
প্রাচীন ভারতে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে নালন্দার খ্যাতি ছিল সর্বাধিক। কেন্দ্রটির সুনাম দেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল। বহু বিদেশি ছাত্র ও শিক্ষক নালন্দায় শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষাদান করতেন। পণ্ডিতসমাজে নালন্দার শিক্ষক বা ছাত্র বিশেষ সম্মান পেত।
বিক্রমশীলা
প্রাচীন ভারতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রাচীনত্বের দিক থেকে নালন্দার পরেই বিক্রমশীলার নাম উল্লেখ করা যায়। বিক্রমশীলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন দিক উল্লেখ করা হল-
(1) অবস্থান:
বিক্রমশীলার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত না হওয়ায় এর অবস্থান নিয়ে মতভেদ দেখা যায়। অনেকে বলেন রাজমহলের পার্বত্য অঞ্চলে বিক্রমশীলা মহাবিহার অবস্থিত ছিল, আবার অনেকের মতে, এটি নালন্দার কাছাকাছি অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। তবে প্রথম মতটি অধিকাংশ ঐতিহাসিক স্বীকার করেছেন। বর্তমানে বিহারের ভাগলপুর জেলায় বিক্রমশীলার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
(2) প্রতিষ্ঠা:
পাল যুগের সম্রাট ধর্মপাল তাঁর নিজের নাম ‘বিক্রমশীল’-এর সঙ্গে সংগতি রেখে আনুমানিক নবম শতাব্দীতে বিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন।
(3) কাঠামো:
মোট একশো আটটি মঠ এবং একশো আটজন মঠাধ্যক্ষ নিয়ে গড়ে উঠেছিল বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়। ছয়টি মহাবিদ্যালয় ছিল বলে জানা গেছে। প্রতিটি মহাবিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল গবেষণাগার, ছাত্রাবাস, সম্মেলন গৃহ ইত্যাদি। ছয়টি মহাবিদ্যালয়ে ছিল ছয়টি দ্বার এবং বিদ্যালয়ের বাইরে প্রাচীরে ছিল প্রধান দ্বার। প্রধান দ্বারের পাশে ছিল ধর্মশালা।
(4) পাঠক্রম ও শিক্ষাদান পদ্ধতি:
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত নথিপত্র ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে বিক্রমশীলার পাঠক্রম সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে অনুমান করা যায় যে, এর পাঠক্রম ও নিয়মবিধি নালন্দার মতোই ছিল। ব্যক্তিগত ও দলগত উভয়ভাবেই শিক্ষাদান করা হত। শিক্ষাদানে মৌখিক পদ্ধতির প্রচলন ছিল। আলোচনা ও বিতর্কসভার আয়োজনও হত।
(5) মূল্যায়ন ও উপাধি:
নালন্দার মতো বিক্রমশীলাতেও মৌখিক পরীক্ষা এবং সভাসমিতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হত এবং উপাধি প্রদান করা হত।
(6) অধ্যাপকমণ্ডলী:
বিক্রমশীলার অধ্যাপকদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, অভয়কর গুপ্ত, জ্ঞানপাদ, প্রভাকরমতি প্রমুখ।
(7) ধবংস:
প্রাচীরবেষ্টিত এই বিহারকে নগরদুর্গ মনে করে মুসলিম সেনাবাহিনী একে ধ্বংস করে সমস্ত সন্ন্যাসীদের হত্যা করে।