শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো | Vidyasagar’s contribution to education and social reform

শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে বিদ্যাসাগরের অবদান – বাংলা তথা ভারতবর্ষের দ্বিতীয় পর্যায়ের নবজাগরণে যেসব মনীষী সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন প্রকৃত অর্থে তাঁদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী অথচ নরম মনের মানুষ ঈশ্বরচন্দ্র বাংলার নবজাগরণে একটা বিশেষ মাত্রা যোগ করেছিলেন। নবজাগরণের চিন্তাধারার মধ্যে যে গুণগুলি বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়, যেমন-যুক্তিবাদ, স্বাধীন বিচারশক্তি, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজমনস্কতা, প্রবল ব্যক্তিস্বতন্ত্রতা ও মুক্ত মানবতাবোধ- সবই ঈশ্বরচন্দ্রের ব্যক্তিত্বের মধ্যে ফুটে উঠেছিল।

শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে বিদ্যাসাগরের অবদান

শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো
শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো

ঈশ্বরচন্দ্রের সংক্ষিপ্ত জীবনী

1820 খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতা ও পিতার নাম ছিল যথাক্রমে ভগবতী দেবী ও ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। উজ্জ্বল ছাত্রজীবন অতিক্রম করে 1841 খ্রিস্টাব্দের 29 ডিসেম্বর ঈশ্বরচন্দ্র ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগের প্রধান পণ্ডিত হিসেবে কাজে যোগ দেন। এই সময়ে হ্যালিডে, পিটার গ্রান্ট, সিসিল বিডন, উইলিয়াম গ্রে প্রমুখ উদারমনস্ক এবং সংস্কৃতিবান ইংরেজের সঙ্গে পরিচয় বিদ্যাসাগরের উত্তরজীবনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। 1846 খ্রিস্টাব্দের 5 এপ্রিল ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজের সহসম্পাদক নিয়োজিত হন। তাঁর শিক্ষাসংস্কার সম্পর্কিত কিছু প্রস্তাব তদানীন্তন সম্পাদক রসময় দত্তের মনঃপুত না হওয়ায় এবং প্রস্তাবগুলি বাতিল হয়ে যাওয়ায় তিনি সহসম্পাদকের পদ ত্যাগ করেন।

1850 খ্রিস্টাব্দে পুনরায় তাঁকে সংস্কৃত কলেজের কাজে আহ্বান করা হয় এবং সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে তিনি যোগদান করেন। সংস্কার সম্পর্কিত কিছু প্রস্তাবের ব্যাপারে সম্পাদক রসময় দত্তের সঙ্গে তাঁর আবারও মনোমালিন্য হয়। তবে এবার রসময় দত্ত পদত্যাগ করেন। বিদ্যাসাগরকে কলেজের সম্পাদক নিয়োগ করা হয়। 1851 থেকে 1858 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। দর্শন ও সংস্কৃতে তাঁর অগাধ পান্ডিত্যের জন্য সংস্কৃত কলেজের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি দেওয়া হয়।

1855 খ্রিস্টাব্দে অধ্যক্ষ পদের পাশাপাশি তিনি দক্ষিণবাংলার স্কুলে ইনস্পেকটর পদ গ্রহণ করেন। ব্যক্তিগত কারণে 1858 খ্রিস্টাব্দের 5 আগস্ট তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ ত্যাগ করেন। 1859 খ্রিস্টাব্দে কয়েকজন সতীর্থকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কলিকাতা ট্রেনিং স্কুল স্থাপন করেন। 1864 খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুল-এর নাম পালটে মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন করে তিনি এর পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই প্রথম দেশীয় ব্যক্তিদের উদ্যোগে স্বাধীনভাবে কলেজ স্থাপিত হয়।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদানকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়- শিক্ষাসংস্কার, বাংলা সাহিত্যের বিকাশ এবং সমাজসংস্কার।

(1) শিক্ষাসংস্কার: 

বিদ্যাসাগর মনে করতেন যে ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবন, উভয়ক্ষেত্রেই শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই, মানুষের চরিত্র গঠনের স্বার্থে তিনি সর্বস্তরের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের ওপর জোর দেন। তাঁর সময়ে দুইটি পরস্পরবিরোধী ক্ষতিকারক প্রবণতা আমাদের দেশে কাজ করছিল। একদিকে কিছু মানুষ নির্বিচারে পুরোনো ধ্যানধারণাকে আঁকড়ে রেখেছিলেন; অন্যদিকে কিছু মানুষ নির্বিচারে সব পুরোনো ধ্যানধারণা পরিত্যাগ করে অন্ধভাবে পাশ্চাত্যকে অনুকরণ করছিলেন। বিদ্যাসাগর ভারতীয় সংস্কৃতি ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি উভয়ের মধ্যে যা কিছু গ্রহণীয় সেগুলিকে সমন্বিত করেন এবং শিক্ষার মাধ্যমে সেই সমন্বিত আদর্শকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে স্থানান্তরিত করে তাদেরকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত করেন। এইভাবে তিনি শিক্ষাকে মানুষ গড়ার হাতিয়ার তথা অবক্ষয়ের পাঁকে ডুবে যাওয়া একটি জাতিকে পুনর্জীবিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের পথ নির্দেশ করেন।

শিক্ষাসংস্কারে বিদ্যাসাগরের বহুমুখী ভূমিকাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়-

  1. প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার: প্রাথমিক শিক্ষা এবং স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 1853 খ্রিস্টাব্দে একটি প্রতিবেদনে ঈশ্বরচন্দ্র গণশিক্ষাকে খুব জরুরি বলে ব্যক্ত করেন। ওই প্রতিবেদনে তিনি প্রাথমিক স্কুল স্থাপন করা, পাঠ্যবই রচনা করা এবং শিক্ষক-শিক্ষণের ব্যবস্থা করার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন। 1854 খ্রিস্টাব্দে লেফটেন্যান্ট গভর্নর মি. হ্যালিডের সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগর কিছু সংখ্যক মডেল স্কুল স্থাপন ও পরিদর্শনের ব্যবস্থা করেন। এসব স্কুলে কোন্ কোন্ বিষয় পড়ানো হবে তা-ও তিনি স্থির করে দেন। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে তিনি মাতৃভাষার (বাংলা) ওপর জোর দেন। বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য একজন হেড পণ্ডিত ও দুজন সহকারী পন্ডিত নিয়োগের কথা বলেন। হুগলি, বর্ধমান, নদীয়া ও মেদিনীপুরে এই বিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব দেন। এইসব বিদ্যালয়ে শিক্ষক তৈরি করার জন্য একটি নর্মাল স্কুল তৈরি করার কথাও বলেন।
  2. সংস্কৃত শিক্ষার প্রসার: বিদ্যাসাগর লক্ষ করেন বাংলা ভাষার লৌকিক ব্যবহার এবং কথোপকথন বেশ অনুন্নত। যদি সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার থেকে কিছু শব্দ বাংলা ভাষার মধ্যে প্রয়োগ করা যায়, তাহলে বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সংস্কৃত শিক্ষাপ্রণালীর সংস্কারের মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি সম্ভব। সংস্কৃত শিক্ষাকে আরও সহজ করার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র নানান কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তিনি সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যসূচিতে সংস্কৃত ব্যাকরণের পরিবর্তে বাংলা ব্যাকরণ পাঠের ওপর গুরুত্ব দেন। তিন-চার বছরের মধ্যে শিক্ষার্থীরা যাতে সংস্কৃত ভাষা এবং সাহিত্যে মোটামুটি জ্ঞান অর্জন করতে পারে তার জন্য তিনি কয়েকটি পুস্তক লেখেন। এই পুস্তকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা, ঋজুপাঠ এবং ব্যাকরণ কৌমুদী। বিদ্যাসাগরের মূল উদ্দেশ্য ছিল সংস্কৃত সাহিত্যের অফুরন্ত জ্ঞানভান্ডারকে কাজে লাগিয়ে নতুন যুগের উপযোগী বাংলা ভাষার বুনিয়াদ রচনা করা। বিদ্যাসাগর পন্ডিতদের জন্য উন্নতমানের সংস্কৃত শিক্ষা বহাল রেখে, সাধারণ লোকের জন্য মাতৃভাষার মাধ্যমে সংস্কৃত পড়ানোর কথা বলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সাধারণ লোকের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষা বেশি প্রয়োজনীয়।
  3. কলেজ স্তরে দেশি শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন: 1859 খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। 1861 খ্রিস্টাব্দে এই স্কুলটির নাম হয় কলকাতা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি। 1864 খ্রিস্টাব্দে স্কুলটির নাম পরিবর্তন করে হয় মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন। তখনকার দিনে এটিই ছিল শুধু ভারতীয়দের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত কলেজ। সেখানে কেবল ভারতীয়রাই অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। 1872 খ্রিস্টাব্দে এই কলেজ একটি দ্বিতীয় গ্রেডের কলেজ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পায়। 1879 খ্রিস্টাব্দে এটি হয় প্রথম গ্রেড কলেজ এবং ওই সময় থেকেই কলেজে বিএ এবং এমএ পড়াবার ব্যবস্থা হয়। 1882 থেকে 1909 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিএ পড়াবার ব্যবস্থা বহাল থাকে।
  4. নারীশিক্ষার প্রসার: স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বেথুন সাহেব ও কয়েকজন উদারমনস্ক বাঙালির সহায়তায় বিদ্যাসাগর 1849 খ্রিস্টাব্দে মেয়েদের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার জন্য একটি অবৈতনিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্কুলটি প্রাথমিকভাবে কলিকাতা ফিমেল স্কুল, হিন্দু ফিমেল স্কুল, নেটিভ ফিমেল স্কুল প্রভৃতি বিভিন্ন নামে এবং অবশেষে বেথুন বালিকা বিদ্যালয় নামে পরিচিত হয়। 1857 খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বর্ধমান জেলার জৌগ্রামে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এফ, হ্যালিডের সঙ্গে একমত হয়ে তিনি পরিকল্পনা করেন, যেসব গ্রামে গ্রামবাসীরা বিদ্যালয়ের ঘর দিতে পারবেন সেখানে বালিকাদের জন্য বিদ্যালয় তৈরি করা হবে। ফলে নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য মেদিনীপুর জেলায় তিনটি, বর্ধমান জেলায় এগারোটি, হুগলি জেলায় তেইশটি এবং নদিয়া জেলায় একটি-মোট আটত্রিশটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ আর্থিক সাহায্য না আসায়, বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য বিদ্যাসাগর বেসরকারিভাবে ‘নারীশিক্ষা ভান্ডার’ তৈরি করেন। নারীশিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের আন্তরিক প্রচেষ্টা রক্ষণশীল হিন্দুদেরও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
  5. বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে ভূমিকা: 1855 খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র দক্ষিণ বাংলার স্কুলগুলির স্পেশাল ইনস্পেকটর হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি একসঙ্গে সংস্কৃত কলেজ, নর্মাল স্কুল, চার জেলার মডেল স্কুল ও হিন্দু কলেজের বাংলা পাঠশালার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে 1860 খ্রিস্টাব্দের ও নভেম্বর সব পদ থেকেই তিনি স্বেচ্ছাবসর নেন।
  6. পাঠ্যপুস্তক রচনা: শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তকের অভাব থাকায় বিদ্যাসাগর নিজেই পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে উদ্যোগী হন। তিনি বাংলায় সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা ও ব্যাকরণ কৌমুদী রচনা করেন। প্রসিদ্ধ সংস্কৃত গদ্য ও কাব্যগ্রন্থের নির্বাচিত অংশ নিয়ে তিনি ঋজুপাঠ রচনা করেন। তাঁর রচিত বোধোদয়, বর্ণপরিচয়, কথামালা, চরিতাবলী, আখ্যানমঞ্জরী প্রভৃতি পাঠ্য বই বাংলা ভাষার অতুলনীয় সম্পদ।

শিক্ষার বিভিন্ন দিকে বিদ্যাসাগরের দূরদৃষ্টি ও অবদানের কথা চিন্তা করলে এ কথা বলতেই হবে ভারতবর্ষে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, শিক্ষার যেটুকু উন্নতি হয়েছে তার জন্য বিদ্যাসাগরের কাছে আমাদের ঋণ অপরিসীম।

(2) বাংলা সাহিত্যের বিকাশ: 

বাংলা সাহিত্যে পালাবদলের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান অনস্বীকার্য।

  1. বাংলা ভাষায় সাহিত্যিক গদ্যের নির্মাণ: বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষায় সাহিত্যিক গদ্যের সহজসরল রূপ দান করেছিলেন। সে যুগে আমাদের পূর্বপুরুষদের পান্ডিত্য, জ্ঞান প্রভৃতি সংস্কৃত সাহিত্যের মধ্যেই লিপিবদ্ধ থাকত। বিদ্যাসাগর আমাদের সেই মূল্যবান সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে সাবলীল বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসারে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর অনূদিত গ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল-বেতাল পঞ্চবিংশতি (হিন্দি বেতালপচ্চিশি-র অনুবাদ), শকুন্তলা (কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম্-এর অনুবাদ), ভ্রান্তিবিলাস (শেকসপিয়রের Comedy of Errors-এর অনুবাদ)। তাঁর লেখা সীতার বনবাস, বাঙ্গালার ইতিহাস, জীবনচরিত প্রভৃতি মৌলিক রচনার সংখ্যাও কম নয়। বর্ণপরিচয় বিদ্যাসাগরের অবিস্মরণীয় কীর্তি। বাংলা ভাষা বলা ও লেখার পদ্ধতিকরণ সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের সুচিন্তিত ফলই হল বর্ণপরিচয়। তিনি বর্ণপরিচয়-এর প্রথম ও দ্বিতীয় দুটি ভাগ প্রকাশ করেন। প্রথম ভাগে আছে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহার এবং দ্বিতীয় ভাগে আছে সংযুক্ত বর্ণের ব্যবহার। বিদ্যাসাগরের শব্দচয়নের ক্ষেত্রে সরল আবেগ ও পরিবেশগত প্রভাব দেখা যায়। বাঙালি মননের সঙ্গে তাঁর চিন্তাধারার যোগ এত গভীর ছিল যে বাংলা গদ্যকে তিনি একটা যুগোপযোগী রূপ দিতে পেরেছিলেন।
  2. সাময়িকপত্রের উন্নয়ন: সাময়িকপত্রের জগতেও বিদ্যাসাগরের অবদান তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার কার্যকরী সদস্য ছিলেন। সর্বশুভকরী পত্রিকাতেও তিনি লিখতেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর কর্তৃক প্রকাশিত সোমপ্রকাশ পত্রিকার পরিকল্পনা ঈশ্বরচন্দ্রই করেছিলেন। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে যখন হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা উঠে যাচ্ছিল, তখন তিনিই সেটিকে বাঁচিয়েছিলেন।

(3) সমাজসংস্কার: 

নিপীড়িতের প্রতি সহমর্মিতা মানবতাবাদী বিদ্যাসাগরের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নারীর প্রতি সমাজের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি গর্জে উঠেছিলেন। নারীদের স্বার্থরক্ষার জন্য তিনি যা করেছিলেন তা তাঁকে ভারতের অন্যতম প্রধান সমাজসংস্কারকের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

  1. বিধবাবিবাহ: ঈশ্বরচন্দ্র বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের প্রয়াসকে গণ-আন্দোলনের রূপ দিয়েছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়ে শাস্ত্রের সাহায্যে দেখালেন যে, পরাশর সংহিতায় বিধবাদের বিবাহই প্রকৃষ্ট পন্থা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক প্রস্তাব (দুই খণ্ড 1855) নামক পুস্তিকাটির হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। তাঁর উদ্যোগে 1855 খ্রিস্টাব্দের 4 অক্টোবর 987 স্বাক্ষর সম্বলিত গণ-দরখাস্ত বিধবাবিবাহের পক্ষে পেশ করা হয়। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় 1856 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে বিধবাবিবাহের পক্ষে আইন পাস হয়েছিল। আইন পাস করিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি। তিনি তাঁর একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে শম্ভু মুখোপাধ্যায়ের একাদশ বর্ষীয়া বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীর বিবাহ দেন। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, “বিধবাবিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম…”।
  2. বহুবিবাহ নিবারণ: শুধু বিধবাবিবাহই নয়, 1856 খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ নিবারণ আন্দোলনের সূচনা করেন। এক্ষেত্রেও তিনি যুক্তি দিয়ে বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (প্রথম পুস্তিকা 1871, দ্বিতীয় পুস্তিকা 1873) নামক পুস্তিকা প্রকাশ করেন।
  3. বাল্যবিবাহ রোধ: বাল্যবিবাহ রোধেও বিদ্যাসাগর সচেষ্ট ছিলেন। 1850 খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসে মতিলাল চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদিত সর্বশুভকরী পত্রিকার প্রথম সংস্করণে তিনি ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন।
  4. সুরাপান নিবারণ: ইয়ং বেঙ্গলদের প্রগতিশীল চিন্তা ও কুসংস্কারমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করলেও তাদের অনাচার এবং সুরাপানকে বিদ্যাসাগর সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। 1864 খ্রিস্টাব্দে প্যারীচরণ সরকার সুরাপান রোধে একটি সমিতি স্থাপন করেন। বিদ্যাসাগর সেই সমিতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। আসলে বিদ্যাসাগর ছিলেন সত্য, শিব ও সুন্দরের পুজারি। কোনো গোঁড়ামিও যেমন তাঁর ছিল না, তেমনি অনুকরণ প্রবৃত্তিও তাঁর ছিল না। ইংরেজি শিক্ষাকে তিনি শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। ইংরেজদের যুক্তিবাদ ও কুসংস্কারমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে খুব আকর্ষণ করে। কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতিও তাঁর মমতা ছিল অপরিসীম। ভারতীয় সংস্কৃতির মানবতাবাদ ও উচ্চ মূল্যবোধগুলিকে মানবজাতির অনন্য সম্পদ বলে তিনি মনে করতেন। আসলে উভয় সংস্কৃতির মধ্যে যা যা সুস্থ ও সুন্দর, তিনি সেগুলির মেলবন্ধন চেয়েছেন। এরই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর শিক্ষা ও সমাজ সংক্রান্ত ভাবনায়।
  5. হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড: বিদ্যাসাগর হিন্দু বিধবাদের দুরবস্থা নিবারণে হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড গঠন করেন।

বিদ্যাসাগরের কার্যাবলির মূল্যায়ন

(1) মানবদরদি মন: 

অসহায়, নিপীড়িত, অত্যাচারিত মানুষের জন্য মানবদরদি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হৃদয় সর্বদা কেঁদে উঠত। শুধু নিপীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধেই নয়, শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও তিনি নিপীড়িতের স্বার্থরক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়ন, বহুবিবাহরোধ, বাল্যবিবাহ নিবারণ প্রভৃতি সংস্কারমূলক কর্মসূচি গ্রহণের নেপথ্যে সক্রিয় ছিল তাঁর মানবদরদি মন। শিক্ষাসংস্কারের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন অসহায় মানুষদের জেগে ওঠার জন্য যে সাহস ও স্বাধিকারবোধ প্রয়োজন তা কেবল শিক্ষাই দিতে পারে। শিক্ষা মানুষের মধ্যে চেতনার জন্ম দেয় আর এই চেতনা মানুষকে সংগ্রাম করার সাহস জোগায়।

(2) নবজাগরণের দিশারী: 

পান্ডিত্য, তেজস্বিতা, অধ্যবসায় এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বিদ্যাসাগরের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা বাংলা তথা ভারতবর্ষের নবজাগরণকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।

(3) ভাষা দক্ষতায় সাহিত্যের উন্নতি: 

একাধিক ভাষা যেমন সংস্কৃত, বাংলা ও ইংরেজির ওপর তাঁর দক্ষতা একদিকে যেমন বাংলা গদ্যসাহিত্যের উন্নয়নে ও সার্থক অনুবাদ সাহিত্য রচনায় বিশেষ সাহায্য করেছে এবং পরবর্তী সাহিত্য সৃষ্টিকারীদের চলার পথ সুগম করেছে, অন্যদিকে তেমনই সাধারণ মানুষদের ইংরেজি ও সংস্কৃত সাহিত্যের রস আস্বাদনে সাহায্য করেছে।

আরও পড়ুনLink
ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তরClick Here
তেলেনাপোতা আবিষ্কার বড় প্রশ্ন উত্তরClick Here
আগুন নাটকের প্রশ্ন উত্তরClick Here

Leave a Comment