ইক্তা প্রথা’ কী এবং এই প্রথার উদ্ভব ও গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো

ভূমিকা
দিল্লির সুলতানি শাসনকালে ভূমিরাজস্ব প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ইক্তা প্রথা। ভারতে প্রচলনের বহুকাল আগে থেকেই এই প্রথা ইসলামীয় জগতে প্রচলিত ছিল। সুলতান ইলতুৎমিস ভারতে প্রথম এই প্রথার প্রচলন করেন। এই প্রথা প্রবর্তনের পিছনে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নববিজিত অঞ্চল থেকে রাজস্ব আদায় করা এবং দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে সুলতানের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। একাদশ শতকের তুর্কি। লেখক নিজাম-উল-মুলক তুসির লেখা সিয়াসৎনামা গ্রন্থ থেকে ইস্তা প্রথা সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়েছে।
ইক্তা ব্যবস্থা
(1) অর্থ : ইক্তা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল এক অংশ বা এলাকা। কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল ইসলাম জগতে প্রচলিত এক ধরনের ভূমিদান ও ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত ব্যবস্থা। একজন শাসক তাঁর বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের প্রতি সেবার পুরস্কার হিসেবে এ ধরনের ভূমি বা এলাকা বণ্টন করতেন। সাধারণভাবে এটি ইক্তা প্রথা নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক মোরল্যান্ড বলেছেন যে, “ভারতে সুলতানি আমলে ছোটো বা বড়ো ভূখণ্ড থেকে ভূমিরাজস্ব আদায়ের অধিকারই হল ইক্তা ব্যবস্থা।”
(2) ইক্তাদার বা মাক্তি: ইক্তার প্রাপক বা মালিককে বলা হত ইক্তাদার বা মাক্তি বা মুক্তি। এঁরা ওয়ালি বা উলিয়াৎ নামেও পরিচিত ছিলেন।
(3) ইক্তাদারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য : (i) প্রত্যেক ইক্তাদার তাঁর নির্দিষ্ট এলাকার প্রজাদের কাছ থেকে ভূমিরাজস্ব আদায় করতেন। কিন্তু ভূমিরাজস্ব আদায় ছাড়া জমি ও কৃষকদের ওপর তাঁর কোনো অধিকার ছিল না। (ii) ইক্তার আয় থেকে তাঁকে সেনাবাহিনী পোষণ করতে হত এবং যুদ্ধের সময় তাঁরা সুলতানকে সামরিক সাহায্য দিতে বাধ্য থাকতেন। তাই ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব বলেছেন, “মাক্তিরা ছিলেন একাধারে রাজস্ব আদায়কারী, সেনাবাহিনীর অধ্যক্ষ ও তাঁদের বেতনদাতা।” (iii) ইক্তাদারদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদচ্যুতি-সবই ছিল সুলতানের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। (iv) ইক্তাদার বা মাক্তিদের স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি কিছু প্রশাসনিক দায়দায়িত্বও পালন করতে হত।
ইক্তা প্রথার উদ্ভব
(1) ইক্তা প্রথার উদ্ভব: ইসলামের আবির্ভাবের সূচনাকাল থেকেই রাষ্ট্রীয় সেবার পুরস্কার হিসেবে ইসলামীয় জগতে ইস্তা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। ঐতিহাসিক কে এম আশরাফ বলেছেন যে সম্ভবত খলিফা মুকতদি এই প্রথার উদ্ভাবক ছিলেন। ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থায় কৃষকদের উৎপাদনের উদ্বৃত্তের একটি অংশ রাষ্ট্রের প্রাপ্য বলে বিবেচিত হত। তাই এদেশে সুলতানি সাম্রাজ্যের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের এই উদ্বৃত্ত উৎপাদনের অংশ সংগ্রহ করা এবং তা শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টন করার উদ্দেশ্যেই ইক্তা প্রথার প্রচলন ঘটে। সুলতানরা নির্দিষ্ট শর্তে তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি, সৈনিক ও অভিজাতদের মধ্যেই জমি বণ্টন করে দিতেন। এই জমি বা এলাকা ইক্তা নামে পরিচিত হয়।
(2) ইক্তা প্রথার গুরুত্ব: ইক্তা ব্যবস্থার মধ্যে নানা ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও এই ব্যবস্থার সুফল বা গুরুত্বকে পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। এগুলি হল-
- সাম্রাজ্যের প্রসার: ইক্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে দিল্লির সুলতানরা ভারতে নিত্যনতুন অঞ্চলে তাঁদের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফলে সুলতানি সাম্রাজ্যের বিস্তার বা প্রসার ঘটে।
- দূরবর্তী অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন : ইস্তা প্রথার মাধ্যমে সুলতানরা রাজধানী দিল্লি থেকে দূরবর্তী প্রদেশ বা অঞ্চলগুলির ওপর কর্তৃত্ব ও যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা সুরক্ষিত হয়েছিল।
- রাজকোশের আয় বৃদ্ধি: ইক্তাদাররা বিপুল পরিমাণে ভূমিরাজস্ব সংগ্রহ করে সুলতানদের রাজকীয় কোশাগারে জমা দিতেন। এইভাবে সুলতানের রাজকোশের আয় বৃদ্ধি পায়।
- প্রশাসনের ত্রুটিবিচ্যুতি দূরীকরণ: ইক্তা প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে যেমন সুলতানি আমলে প্রাদেশিক শাসনের ভিত মজবুত হয়েছিল। এর পাশাপাশি প্রশাসনের নানা ত্রুটিবিচ্যুতিও দূর হয়েছিল।
- অভিজাত শ্রেণির সন্তুষ্টি বিধান: দিল্লিতে প্রথমদিকে মামেলুক বা দাস সুলতানরা আমির-ওমরাহ বা অভিজাতদের বিদ্রোহের আশঙ্কা করতেন। তাই তাঁদের খুশি করার জন্য তাঁরা ইক্তা প্রদান করতেন।
মূল্যায়ন
সবশেষে বলা যায় যে, সুলতান ইলতুৎমিস নতুন নতুন অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মূলত এদেশে ইস্তা প্রথার প্রবর্তন করেন। নতুনভাবে জয় করা অঞ্চলের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, ভূমিরাজস্ব থেকে রাজকোশের আয় বৃদ্ধি করাও ছিল তাঁর অন্যতম লক্ষ্য। আবার ঐতিহাসিক কে এ নিজামি সহ অনেকেই বলেছেন যে, ভারতের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য ইলতুৎমিস ইক্তা ব্যবস্থাকে একটি ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর