গঙ্গাদূষণ : সমস্যা ও প্রতিকার রচনা

গঙ্গাদূষণ : সমস্যা ও প্রতিকার রচনা
গঙ্গাদূষণ : সমস্যা ও প্রতিকার রচনা

ভূমিকা

কলুষনাশিনী, সর্বসন্তাপহারিণী পবিত্র গঙ্গা একদিন আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ ছিল। গঙ্গার তীরেই গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন সভ্যতা। জীবনধারণের জল ও কৃষির উপাদান যুগিয়ে কৃষি সভ্যতাকে এই গঙ্গা বাঁচিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আজকের সেই গঙ্গায় জমেছে সভ্যতার উদ্বৃত্ত। যে গঙ্গা একদিন বিভিন্ন জায়গার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে পবিত্রতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল, কালের পরিবর্তনে সেই গঙ্গা এখন অপবিত্র এবং এই অপবিত্রতা আমাদের ও আমাদের পরিবেশকে করেছে দূষিত।

গঙ্গার উৎপত্তি ও পৌরাণিক ব্যাখ্যা

পুরাকালে অযোধ্যার রাজা সগর অশ্বমেধ যজ্ঞের জন্য প্রস্তুতি নিলে, নিয়ম অনুযায়ী অশ্বমেধের ঘোড়া সর্বত্র পরিভ্রমণ করে। ইন্দ্র রাক্ষসরূপ ধারণ করে সেই অশ্বটি অপহরণ করেন। সগরের আদেশে তাঁর ষাট হাজার পুত্র সর্বত্র অনুসন্ধান করেও যখন অশ্বের কোন সন্ধান পেল না, তখন পাতালে কপিল মুনির আশ্রমে গিয়ে তাকে অশ্বাপহারক বলে ক্রোধ প্রকাশ করলে কপিল মুনি রাগে সগর রাজার পুত্রদের ভস্ম করেন। এরপর সগরের পৌত্র অংশুমান এসে তাঁর পিতৃব্যদের ধ্বংসের কারণ ও উদ্ধারের উপায় অবগত হলেন। উপায়টি হল, স্বর্গ থেকে গঙ্গা অবতরণ কালে গঙ্গার জল এই ভস্মের উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে তাঁরা পুনরুজ্জীবিত হয়ে স্বর্গে যাবেন। সেজন্য অংশুমান ও তাঁর পুত্র দিলীপ চেষ্টা করে না পারলে দিলীপের পুত্র ভগীরথ নানা কঠোর তপস্যার মাধ্যমে ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করে স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে পৃথিবীতে আনয়নের অনুমতি পান ও গঙ্গাকে স্বর্গ থেকে মর্ত্য ও পাতালে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।

ভৌগোলিক রূপ

গঙ্গা হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে হরিদ্বারের সমভূমিতে প্রবেশ করেছে। ভৌগোলিক দিক থেকে ভারতের দীর্ঘতম নদী গঙ্গা-যার দৈর্ঘ্য ২৫১০ কিমি। গঙ্গার উচ্চগতি হল গঙ্গোত্রী থেকে হরিদ্বার পর্যন্ত ৩২০ কিমি। উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের মধ্যে গঙ্গার মধ্যগতি-র সঙ্গে যুক্ত বহু উপনদী-রামগঙ্গা, গোমতী, ঘর্ঘরা, গণ্ডক, বুড়ীগণ্ডক, কোশী প্রভৃতি। গঙ্গার নিম্নগতি হল ভাগীরথী ও পদ্মার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত।

গঙ্গা দূষণের কারণ

গঙ্গোত্রী থেকে গঙ্গাসাগর এই সুদীর্ঘ পথে গঙ্গা নানা কারণে দূষিত। নদী-তীরবর্তী শহরের বর্জ্য এবং কল-কারখানার বর্জ্য প্রতিদিন গঙ্গাকে দূষিত করছে। এই দূষণের স্বরূপ নিম্নরূপঃ (ক) শহর ও কল-কারখানার বর্জ্য, মলমূত্র, নোংরা আবর্জনা গঙ্গায় এসে পড়ছে। (খ) কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিক ও কীটনাশক এসে গঙ্গার দূষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। (গ) বিভিন্ন অঞ্চলের পলিমাটি এসে গঙ্গার নাব্যতা কমিয়ে দিচ্ছে। (ঘ) গঙ্গার দুপারে কাপড় কাচা, গরু-মহিষ স্নান করানোর জন্য দূষণের মাত্রা বাড়ছে। (ঙ) গঙ্গা যেহেতু হিন্দুদের কাছে পবিত্র নদী, তাই যে কোন উৎসব অনুষ্ঠানকে ঘিরে উৎসবের শেষে যে বর্জ্য এসে গঙ্গায় পড়ছে, তার ফলেও গঙ্গা দূষিত হচ্ছে। (চ) নদীপাড়ের ভাঙন, ভূমিক্ষয় প্রভৃতির কারণে জলের পঙ্কিলতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং গতিপথের পরিবর্তনে তা দূষণের কারণ হয়ে পড়ছে। (ছ) গঙ্গাবক্ষে অতিরিক্ত যানবাহন চলাচলের ফলেও গঙ্গা দূষিত হচ্ছে।

দূষণের ফলাফল

গঙ্গাদূষণের ফল হয়েছে মারাত্মক। কলুষনাশিনী গঙ্গা এখন নিজেই কলুষের উৎস। গঙ্গাস্নান করে পবিত্র না হয়ে অপবিত্র হওয়ার সমস্ত উপকরণ আজ গঙ্গার মধ্যে বর্তমান। গঙ্গার নাব্যতা নষ্ট হচ্ছে অতিরিক্ত বর্জ্যের সংগ্রহে। কলকারখানার বর্জ্য নদীজলের বিশুদ্ধতাকে নষ্ট করছে। অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক মেশার ফলে গঙ্গায় মাছের উৎপাদন কমেছে। যে গঙ্গার জল হিন্দুদের দেবদেবীর পূজায় ব্যবহৃত হত, তার গ্রহণযোগ্যতা এখন কমেছে।

গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান

১৯৮৫ সালে ভারতের পরিবেশ ও জনমন্ত্রকের অধীনে গঙ্গা প্রজেক্ট ডাইরেক্টরেট গঠন করা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৪ই জুন বারাণসীতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গঙ্গা অ্যাকশান প্ল্যান প্রকল্পের উদ্বোধন করেন-
(অ) অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে: (ক) শ্মশানে বৈদ্যুতিক চুল্লি ও স্নানের ঘাট নির্মাণ। (খ) অল্প খরচে শৌচাগার নির্মাণ। (গ) পয়ঃপ্রণালীর গতিপথ গঙ্গার থেকে ভিন্নমুখী করা। (ঘ) পয়ঃপ্রণালী ও নর্দমার জল শোধন করে তা গঙ্গায় ফেলা। (ঙ) গঙ্গার ভাঙন রোধে ব্যবস্থা।

(আ) প্রতিরোধমূলক ক্ষেত্রে: (ক) পরিবেশ সংক্রান্ত আইনগুলির যথাযথ বাস্তবায়ন। (খ) শিল্প সংগঠনগুলিকে দূষণ নিয়ন্ত্রণে বাধ্য করা। (গ) গঙ্গা নদীতে জলপ্রবাহ ঠিক রাখা। (ঘ) রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহার সীমিত করা।

(ই) জনমত গঠন ও সক্রিয় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে: (ক) জনসাধারণকে সচেতন করা। (খ) বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে কাজে লাগানো। (গ) এ বিষয়ে সভা-সমিতি, প্রদর্শনী ও বক্তৃতার আয়োজন করা।

ঈ) প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে:
(ক) গঙ্গার জলের মান ও দূষণের পরিমাণ নিয়মিত পরীক্ষা করা। (খ) বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের পদ্ধতি ও উপায় অবলম্বন করা। (গ) বর্জ্য পদার্থ শোধনের ব্যবস্থা করা। (ঘ) বৈজ্ঞানিক উপায়ে জলের দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখা। এই প্ল্যান গ্রহণের কারণগুলি হল: (ক) গঙ্গা ভারতের অন্যতম জলসম্পদ। (খ) গঙ্গার জল সেচের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। (গ) গঙ্গা দূষিত হলে মাটিও দূষিত হবে, ফলে মাটি দূষণঘটিত রোগের সমস্যা দেখা দেবে। (ঘ) গঙ্গা দূষণ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি তথা জলজ সম্পদের প্রাচুর্যকে নষ্ট করবে। (ঙ) গঙ্গার নাব্যতা কমে গেলে বন্যা দেখা দেবে। (চ) জল পরিবহনের ক্ষেত্রেও গঙ্গা নাব্যতা হারিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। (ছ) গঙ্গা দূষিত হলে ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হবে।

উপসংহার

দূষণ যেখানে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে, যান্ত্রিকতা যেখানে মানুষের প্রাকৃতিক হয়ে ওঠার পথকে রুদ্ধ করছে, আধুনিক বিশ্ব যখন জেনে-শুনেও সেই পথকে পরম পথ বলে মেনে নিয়েছে সেখানে গঙ্গাদূষণ পৃথক কোন বিষয় তো নয়-ই, বরং তা সামগ্রিক বিশ্বের একটি অবশ্যম্ভাবী ঘটনা। তাই পতিতপাবনী হোক্, কলুষনাশিনী-ই হোক্, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি যদি পরিবর্তিত না হয়, তাহলে গঙ্গা কি তার সেই শক্তি নিয়ে আমাদের কাছে উপস্থিত হতে পারবে। আমরাই পারি গঙ্গার সেই প্রাচীন ঐতিহ্যকে অনেকটা ফিরিয়ে আনতে-এই বোধে আমাদের দীক্ষিত হতে হবে। স্মরণ করতে হবে বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী ভূপেন হাজরিকার সেই বিশিষ্ট অনুভবের গান- “বিস্তীর্ণ দুপারে, অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও নিঃশব্দে নীরবে, ও গঙ্গা তুমি, ও গঙ্গা বইছ কেন?”


Related Keyword
গঙ্গা দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা
গঙ্গা দূষণ রচনা
গঙ্গা দূষণ ও তার প্রতিকার pdf
গঙ্গা দূষণের কারণ ও ফলাফল
গঙ্গা দূষণ pdf
গঙ্গা নদীর সমস্যা
গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান PDF
গঙ্গা দূষণ নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা

Leave a Comment