গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো
পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তার জন্মভূমি গ্রিস। গ্রিকরাই প্রথম জগতের রহস্য উন্মোচনে সচেষ্ট হন। কেবল ঐতিহ্য ও বিশ্বাস দিয়ে নয়; যুক্তি, তর্ক, বুদ্ধি দিয়ে তাঁরা জগৎ ও জীবনকে জানতে চান। মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক সম্বন্ধে এই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রাজনৈতিক দৃষ্টির উদ্ভব ঘটে। এই বিচারে গ্রিকরাই রাষ্ট্রনীতিচর্চার জনক।
গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহ
গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল যেমন অভিনব তেমনি বহুমুখী।
মানুষ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক
গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় মনে করা হয় যে, মানুষ রাজনৈতিক জীব। রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান এবং এর স্থান অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বে। একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যেই মানুষের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব।
রাষ্ট্রপরিচালনায় নাগরিকদের অংশগ্রহণ
গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় রাষ্ট্রনীতি রূপায়ণে নাগরিকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রপরিচালনার কাজে নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ রাষ্ট্রের জনমুখী চরিত্ররক্ষার জন্য আবশ্যিক।
যুক্তির প্রাধান্য
গ্রিক পণ্ডিতেরা তাঁদের সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁরা জগৎ ও জীবনকে যুক্তিসম্পন্ন ও বিধিসম্মত বলে বিশ্বাস করতেন। তাছাড়া অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর চিন্তা বর্জন করে বিশ্লেষণ ও কার্যকারণ সম্পর্ক দ্বারা তাঁরা রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট ছিলেন।
ধর্মবিমুক্ততা
প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা ও কর্মে ধর্মীয় প্রেরণার কোনও ভূমিকা ছিল না। গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশের মূলভিত্তি ছিল ব্যক্তিমানুষের গুরুত্ব।
নৈতিকতার গুরুত্ব
গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় গোটা সমাজের নৈতিকতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। গ্রিক রাষ্ট্রতত্ত্ব অনুযায়ী, রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক বা আইনগত প্রতিষ্ঠানমাত্র নয়, রাষ্ট্র একটি নৈতিক সংগঠনও বটে। গ্রিক তাত্ত্বিকদের মতে, একটি রাষ্ট্র হল সদগুণাবলির অংশীদারিত্ব (Partnership of Virtue)। অর্থাৎ, গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় সমাজের নৈতিক গুণাবলিকে রাষ্ট্রপরিচালনার নির্ধারক হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া এই রাষ্ট্রদর্শনে রাষ্ট্রের এই নৈতিক সত্তার ধারণা পরবর্তীকালে ইউরোপে ভাববাদী রাষ্ট্রচিন্তার উৎস বলে বিবেচিত হয়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আস্থা
গ্রিক রাষ্ট্রদর্শনের মূল সুরটি হল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও নাগরিকদের অধিকারের প্রতিষ্ঠা। এই রাষ্ট্রচিন্তায় একনায়কতন্ত্রকে সবচেয়ে অনিষ্টকর ও নিকৃষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা বলে মনে করা হয়।
বৈচিত্র্য ও বৈপরীত্য
গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় বহুমুখী আবেদন স্পষ্ট। প্লেটো, অ্যারিস্টটল অতীত ঐতিহ্যকে বজায় রেখে সামাজিক প্রগতির সন্ধান করেছেন। কিন্তু সফিস্টরা ছিলেন স্থিতাবস্থার ঘোরতর বিরোধী। স্টোয়িক দর্শনে আবার বিশ্বরাষ্ট্রের ধারণা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু রক্ষণশীল গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় গ্রিক নগররাষ্ট্র ও সংস্কৃতির বাইরে কোনোকিছুই স্থান পায়নি।
স্বাধীনতা ও কর্তৃত্বের সমন্বয়
গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সমন্বয়সাধন গুরুত্ব পেয়েছে। মুক্ত নাগরিকত্ব (Free Citizenship) হবে একটি মুক্ত রাষ্ট্রের (Free state) মূলাধার- এই ছিল প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার সারমর্ম।
আরও পড়ুন – দর্শন শব্দের অর্থ MCQ