রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি (বিষয়বস্তু) আলোচনা করো।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি (বিষয়বস্তু) আলোচনা করো।

ভূমিকা : 

রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল একটি গতিশীল সামাজিক বিজ্ঞান। মানবসমাজ পরিবর্তনশীল। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রও পরিবর্তনশীল। সেজন্য এই বিষয়গুলির সীমানা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আগে রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনাই ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। কিন্তু এখন মানুষের যাবতীয় রাজনৈতিক জীবনই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার এক্তিয়ারে এসে পড়ে। তাই এর প্রকৃতি ও পরিধি আলোচনা করা অত্যন্ত জটিল।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি

প্রথমত : রাষ্ট্র হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয়। এই রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই মানুষের রাজনৈতিক জীবন আবর্তিত হয়।
দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সরকারের মাধ্যমে। তাই রাষ্ট্রের আলোচনার সঙ্গে সরকারের আলোচনাও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।
তৃতীয়ত : সরকার পরিচালিত হয় আইন দ্বারা। তাই আইনের আলোচনাও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি বিষয়।
চতুর্থত: বর্তমান যুগ আন্তর্জাতিকতার যুগ। আন্তর্জাতিক আইন, সংগঠন, সন্ধি, যুক্তি, বিশ্ব জনমত প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়।
পঞ্চমত : শ্রেণি, জাতি, ধর্ম, প্রথা, রীতিনীতি প্রভৃতি বিষয়গুলি মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এগুলিও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়।
ষষ্ঠত : সমাজবিজ্ঞানের পরিবারের নবীনতম সদস্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরও আছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, নিজস্ব আগ্রহের বিষয়, নিজস্ব ধারণার সমষ্টি।
সপ্তমত : বর্তমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় রাষ্ট্রনীতির ক দিকের ঐক্যবদ্ধ তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। ঐক্যবদ্ধ আলোচনার ওপর
অষ্টমত : বিংশ শতাব্দীর প্রাথমিক পর্বে উদারনীতিবাদ, নয়া উদারনীতিবাদ, উত্তর আধুনিকতাবাদ, নারীবাদ, পিতৃতন্ত্র এবং শেষ পর্বে বিশ্বায়ন, সন্ত্রাসবাদ, পরিবেশ আন্দোলন, নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার প্রভৃতি বিষয়গুলি নতুন ভূমিকা গ্রহণ করে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি/বিষয়বস্তু

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোকপাত করা যেতে পারে। যথা—i. সাবেকি দৃষ্টিকোণ, ii. আধুনিক দৃষ্টিকোণ, iii. মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ, iv. অন্যান্য দৃষ্টিকোণ এবং v. আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্মেলন।

i. সাবেকি দৃষ্টিকোণ : 

সাবেকি দৃষ্টিকোণ থেকে যেসব রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু আলোচনা করেছেন তারা হলেন গার্নার, সিলি, লিকক, গ্যাটেল, গিলক্রিস্ট, উইলোবি প্রমুখ। তাঁরা রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি, বিবর্তন, কার্যাবলি, রাষ্ট্রতত্ত্ব, আইন, সরকার প্রভৃতি বিষয়গুলিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। গার্নারের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শুরু ও সমাপ্তি রাষ্ট্রকে নিয়েই। সিলি ও লিককের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান কেবলমাত্র সরকারকে নিয়েই আলোচনা করে। গ্যাটেল ও গিলক্রিস্টের মতে, শুধু রাষ্ট্র বা শুধু সরকার নয়, রাষ্ট্র ও সরকার উভয়েই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। উইলোবি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য সূচিকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে সীমিত করেছেন। সেগুলি হল—রাষ্ট্র, সরকার এবং আইন।

ii. আধুনিক দৃষ্টিকোণ : 

আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেসব রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু আলোচনা করেছেন তাঁরা হলেন–ডেভিড ইস্টন, অ্যালান বল, ল্যাসওয়েল, রবার্ট ডাল, চার্লস মেরিয়াম প্রমুখ। তাঁদের মতে, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচরণ, ভোটদান, রাজনৈতিক দল, চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, মতাদর্শ, যোগাযোগ, জনমত, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ প্রভৃতিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য সূচির অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ডেভিড ইস্টন মূল্য বা বস্তুর কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দের আলোচনাকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বলে উল্লেখ করেছেন। অ্যালান বল নির্বাচনি আচরণ, রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক সংযোগসাধন, রাজনৈতিক দল ও মতাদর্শ প্রভৃতিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ল্যাসওয়েল রাজনীতিকে ‘প্রভাব ও প্রভাবশালীদের সম্পর্ক’ বলে অভিহিত করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। রবার্ট ডাল ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও শাসনকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হিসেবে গণ্য করতে চেয়েছেন।

iii. মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ : 

মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যেসব রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু আলোচনা করেছেন তাঁরা হলেন—কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও-জে-দং, গ্রামসি, লুকাচ প্রমুখ। তাঁরা মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল আলোচ্য বিষয় হল ভিত্তি ও উপরিকাঠামো, শ্রেণি, শ্রেণিশাসন, ক্ষমতা, আধিপত্য প্রভৃতি। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় রাষ্ট্র, সরকার, আইন ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি না অর্থনীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।

iv. অন্যান্য দৃষ্টিকোণ : 

বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়কে বিজ্ঞানসম্মত করার জন্য অনেক দার্শনিক মনোবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, অর্থবিদ্যা, দর্শন প্রভৃতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের কথা বলেছেন। অনেকে আবার আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা, বিশ্বায়ন, নয়া বিশ্বব্যবস্থা প্রভৃতিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য সূচির অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী। আবার কেউ কেউ মনে করেন সাংবিধানিক আইন, কূটনীতি, কেন্দ্রীয়-স্থানীয় সরকার, চাপ- সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী প্রভৃতিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। আবার অনেকে মনে করেন, মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের ঔচিত্য-অনৌচিত্য, ভালো-মন্দ প্রভৃতি মূল্যমানগুলি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত।

v. আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত : 

1948 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে UNESCO-এর উদ্যোগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হল – a. রাজনৈতিক তত্ত্ব ও তার ইতিহাস, b. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, c. বিভিন্ন রাষ্ট্রের তুলনামূলক আলোচনা, d. রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী ও জনমত এবং e. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক আইন ও সংগঠন।

উপসংহার : 

উপসংহারে বলতে হয় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি গতিশীল ও পরিবর্তনশীল সমাজবিজ্ঞান। তাই এর প্রকৃতি ও পরিধি সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না। সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধিও পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে চলেছে।

Leave a Comment