রোমান রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন দিকগুলি আলোচনা করো
অথবা, রোমান রাষ্ট্রচিন্তার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা করো

ভূমিকা
পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল প্রাচীন গ্রিসে। প্লেটো, অ্যারিস্টট্ল প্রমুখ প্রখ্যাত গ্রিক চিন্তাবিদগণ প্রাচীন কালে রাষ্ট্রনীতি চর্চার সূত্রপাত ও বিকাশ ঘটান। এইসকল গ্রিক চিন্তাবিদদের হাত ধরে রাষ্ট্রচিন্তার যে জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন সিসেরো, সেনেকা প্রমুখ প্রাচীন রোমান রাষ্ট্রচিন্তাবিদরা। এঁদের চিন্তাধারা ও রচনায় রোমান রাষ্ট্রচিন্তা বিকশিত হয়েছে।
উৎস
রোমান রাষ্ট্রচিন্তার উৎস ছিল প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হার্মন বলেছেন, প্লেটো, অ্যারিস্টট্ল প্রমুখ গ্রিক চিন্তাবিদগণের রাষ্ট্রচিন্তা রোমান রাষ্ট্রচিন্তার প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করেছিল। এ ছাড়াও ভৌগোলিক পরিবেশ, রোমের আর্থসামাজিক অবস্থা, রাজনৈতিক উত্থানপতন, বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি রোমান রাষ্ট্রচিন্তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।
রোমান রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন দিক
(1) রাষ্ট্র ও ব্যক্তির স্বতন্ত্রতা: রোমান রাষ্ট্রচিন্তায় রাষ্ট্র ও ব্যক্তি উভয়েরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও মর্যাদাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা মনে করতেন ব্যক্তি ব্যতীত রাষ্ট্র অর্থহীন। রাষ্ট্র যেমন মানুষের একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান, তেমনি ব্যক্তি বা জনগণ ব্যতীত রাষ্ট্র অস্তিত্বহীন। তাই রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য ও দায়িত্ব হওয়া উচিত ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষা করা।
(2) ক্ষমতা: প্রাচীন রোমে একাধিকবার রাজনৈতিক উত্থানপতন ঘটেছিল। রোমে কখনও রাজতন্ত্র, কখনও প্রজাতন্ত্র, কখনও-বা আবার সাম্রাজ্যবাদী যুগে সম্রাটের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এইসকল রাজনৈতিক পালাবদলে জনগণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। তাই রোমান রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ মনে করতেন জনগণই হল রাষ্ট্রে সকল ক্ষমতার উৎস। শাসকশ্রেণি তাঁদের সকল রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের জন্য জনগণের কাছে দায়বদ্ধ।
(3) আইন সম্পর্কে তত্ত্ব: সিসেরো, সেনেকা প্রমুখ রোমান রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ স্টোয়িক দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং আইন ও নাগরিকত্ব সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করেছেন। সিসেরোর রাষ্ট্রচিন্তার মূল বিষয় ছিল আইন। তিনি তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে দুইপ্রকার আইনের কথা উল্লেখ করেছেন, যথা-(i) প্রাকৃতিক আইন এবং (ii) রাষ্ট্রীয় আইন। তিনি বলেছেন যে, প্রাকৃতিক আইন হল সর্বজনীন ও চিরন্তন। এই আইন অপরিবর্তনীয়। আর রাষ্ট্রীয় আইন হল মানুষের সৃষ্টি। এই দুইপ্রকার আইন ছাড়াও রোমান চিন্তাবিদরা পৌর আইনের বিষয়েও বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। প্রাচীন রোমান আইনের ভিত্তি ছিল ‘দ্য টুয়েলভ টেবিলস’ (The Twelve Tables) নামে আইন সংহিতা।
(4) নাগরিকত্ব সম্পর্কে তত্ত্ব: রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল নাগরিকত্ব বা নাগরিকতা। রোমান সাম্রাজ্যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। রোমান রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ স্টোয়িক দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সর্বজনীন নাগরিকত্বের ধারণাকে তাঁদের রাষ্ট্রতত্ত্বে তুলে ধরেছেন। এর দ্বারা তাঁরা বিশ্বমানবতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। সিসেরো এ প্রসঙ্গে বলেছেনে, সমগ্র পৃথিবী হল একটি কমনওয়েলথ, সেখানে সকল মানুষ সমান। তাঁরা রাষ্ট্রের সংহতির স্বার্থে নাগরিকতার অধিকারকে কোনো একটি বিশেষ শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ না-রেখে তা সকল শ্রেণির প্রজাদের মধ্যে সম্প্রসারিত করা উচিত বলে মনে করতেন।
(5) সরকার সম্পর্কে তত্ত্ব: সিসেরো, সেনেকা প্রমুখ রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ মূলত তিনপ্রকার সরকারের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা-(i) রাজতন্ত্র, (ii) অভিজাততন্ত্র, (iii) গণতন্ত্র। তবে সিসেরো মনে করতেন যে, এই তিন ধরনের সরকারই যে-কোনো সময় দুর্নীতিপরায়ণ হতে পারে। তাই এই তিন ধরনের সরকারের ভালো গুণাবলির সমন্বয়ে একটি মিশ্র সরকার গড়ে উঠলে তা হবে জনগণের পক্ষে আদর্শ রাষ্ট্র।
(6) ন্যায়বিচার ও জনকল্যাণ : রোমান রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। চিন্তাবিদ সিসেরো আবার জনকল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে, একমাত্র জনকল্যাণকর রাষ্ট্রেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
(7) সমালোচনা: রোমান রাষ্ট্রচিন্তা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। (i) রোমান রাষ্ট্রচিন্তাবিদরা গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার ওপর ভিত্তি করেই তাঁদের রাষ্ট্রতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। তাই এ ব্যাপারে তাঁরা কোনো মৌলিকত্ব দাবি করতে পারেন না। (ii) বাস্তবে মিশ্র শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। (iii) রোমান চিন্তাবিদদের বিশ্বজনীন আইনের ধারণা আকাশকুসুম কল্পনামাত্র।
মূল্যায়ন
নানা ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে রোমান রাষ্ট্রতত্ত্ব গুরুত্বকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। আইন, নাগরিকত্ব, সরকার, সংবিধান, শাসনব্যবস্থা প্রভৃতি রাষ্ট্রব্যবস্থার বিভিন্ন দিকগুলি সম্পর্কে তাঁরা যে ধারণা দিয়ে গেছেন, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশে তার গুরুত্ব অপরিসীম।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর