স্বাধীনতার প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করো

স্বাধীনতার প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করো
স্বাধীনতার প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করো

স্বাধীনতার প্রকৃতি

ইংরেজি ‘Liberty’ শব্দটি এসেছে লাতিন ‘Liber’ শব্দ থেকে। এর বাংলা অর্থ হল ‘স্বাধীনতা’। ‘স্বাধীনতা’ বলতে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করার অবাধ এবং অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতাকে বোঝায়। সাধারণভাবে স্বাধীনতা হল এমন কাজের ক্ষমতা, যা সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি নিজের ইচ্ছানুসারে করতে পারে। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এইরূপ স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর বলে মনে করা হয়। অতএব, স্বাধীনতা হল এমন এক সামাজিক পরিবেশ, যেখানে প্রত্যেকে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটিয়ে সমান সুযোগসুবিধা লাভ করে। যাঁরা স্বাধীনতাকে সকলপ্রকার বাধানিষেধের অনুপস্থিত বলে মনে করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জেরেমি বেত্থাম, জন স্টুয়ার্ট মিল, অ্যাডাম স্মিথ প্রমুখ।

[1] স্বাধীনতার ভিত্তি হল অধিকার: 

বর্তমান বিশ্বে ‘স্বাধীনতা’ সম্পর্কে আলোচনাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ‘স্বাধীনতা’-র সাধারণ অর্থ হল, প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা। অর্থাৎ বাহ্যিক দিক দিয়ে বাক্তির আচার আচরণের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতা হল স্বাধীনতা। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বাধীনতা বলতে শুধু নিয়ন্ত্রণহীনতাকে বোঝায় না, কারণ নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হয়। ‘স্বাধীনতা’ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ল্যাঙ্কি বলেছেন যে, Liberty is a product of rights | অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন যে, স্বাধীনতার ভিত্তি হল অধিকার। অধিকারহীন মানুষ ক্রীতদাসে পরিণত হয়। ল্যাস্কি ‘স্বাধীনতা’ বলতে এমন একটি পরিবেশকে বুঝিয়েছেন, যেখানে বাস্তি তার বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ পায়। তাঁর মতে, এই ধরনের পরিবেশ তখনই সৃষ্টি হতে পারে, যখন ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে উপযোগী বাহ্যিক সুযোগসুবিধাগুলি সংরক্ষিত হবে।

[2] স্বাধীনতা ও আইন: 

অধিকার ব্যতীত স্বাধীনতার কথা যেমন ভাবা যায় না, তেমনি অধিকারকে আইনের দ্বারাও স্বীকৃত হতে হয়। এই কারণে স্বাধীনতাকেও একটি আইনগত ধারণা বলা যায়। রাষ্ট্র যেহেতু আইনের সৃষ্টিকর্তা সেদিক থেকে স্বাধীনতার উপলক্ষ্মিও রাষ্ট্রের মধ্যেই সম্ভব হতে পারে। অতএব, স্বাধীনতার পরিবেশ সৃষ্টির ও তাকে সম্ভব করে তোলে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ থাকে বলেই স্বাধীনতা অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে না।

[3] স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণ: 

স্বাধীনতা একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের কারণে অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে না-অন্যদিকে তেমনই অতিরিক্ত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকলে তা স্বাধীনতার পরিপন্থী হয়ে ওঠে এবং স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে। ল্যাঙ্কি এ বিষয়ে অভিমত দিয়েছেন যে, স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্যই স্বাধীনতার ওপর থেকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে কমাতে হবে। কারণ মানুষের ব্যক্তিত্ববিকাশের জন্য স্বাধীনতা হল একটি পন্থা।

[4] স্বাধীনতার বিভিন্ন রূপ: 

স্বাধীনতাকে দু-ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন-
[a] নেতিবাচক স্বাধীনতা: যে স্বাধীনতার ধারণায় বাত্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য নিয়ন্ত্রণবিহীনতার কথা বলা হয় তখন তাকে নেতিবাচক স্বাধীনতা বলে। নেতিবাচক স্বাধীনতা সকলপ্রকার নিয়ন্ত্রণের অপসারণ ঘটায় এবং ব্যক্তির স্বাধীন আচরণকে স্বীকৃতি প্রদান করে। মিল ব্যক্তির ‘আত্মকেন্দ্রিক’ (Self-regarding) এবং ‘পরকেন্দ্রিক’ (Other-regarding)-এই দুই ধরনের কাজের কথা বলেছেন। প্রথম ধরনের কাজের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কারণ এরূপ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করলে ব্যক্তিস্বাধীনতার অবসান ঘটবে। হক্স, লক, অ্যাডাম স্মিথ, জেমস মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল, বেত্থাম প্রমুখ নেতিবাচক স্বাধীনতার সমর্থক।
[b] ইতিবাচক স্বাধীনতা: যখন বিভিন্ন ধরনের সুযোগসুবিধাদানের মাধ্যমে ব্যক্তির বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় তখন তাকে ইতিবাচক স্বাধীনতা বলে। ইতিবাচক স্বাধীনতা অনুসারে ব্যক্তি তার স্বাধীনতাকে কার্যকর করে নিজ ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার মধ্য দিয়ে। কারণ এরূপ স্বাধীনতায় বাক্তির স্বশাসন ও স্ব-নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি স্বীকৃত। রুশো বলেছেন, আইনের কাছে আনুগত্য প্রদর্শনই হল স্বাধীনতা। গ্রিন মনে করেন, স্বাধীনতা শুধু বাধানিষেধের অনুপস্থিতিই নয়-তা মানুষের কাছে এমন একটি উপযোগী পরিবেশ, যেখানে মানুষ তার সদিচ্ছা ও নৈতিকতার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করতে পারে। কিন্তু ল্যাঙ্কি এই অভিমতের বিরোধিতা করে বলেছেন যে, কিছুসংখ্যক মানুষকে নিয়ে যে সরকার গঠিত হয়, সেই সরকার কর্তৃক সৃষ্ট আইন সবসময় ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী হয় না। ব্যক্তি যদি তার বিকাশের এই অনুপোযোগী আইনকে মেনে নেয়, তাহলে তার ব্যক্তিস্বাধীনতার অবসান ঘটবে। এই কারণে ল্যাঙ্কি মনে করেন ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণেরও সমন্বয়সাধন সম্ভব।
হবহাউস নেতিবাচক স্বাধীনতাকে গ্রহণ করেননি। তিনি মনে করেন, ব্যক্তি নিজ ক্ষেত্রে নিজে নিজেই পূর্ণ হয়। ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্বকে গড়ে তোলার জন্যই পারস্পরিক আদানপ্রদান করে থাকে। এই কারণে স্বাধীনতা পারস্পরিক নির্ভরতাকে অস্বীকার করে যথার্থ স্থান নিতে পারে না। কারণ, ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তার মধ্যেই স্বাধীনতা নিহিত। মানুষের জন্মগত প্রতিভাসমূহকে স্বাধীনতা তার স্থান করে দেয়। অপর দিকে টি এইচ প্রিন মনে করেন, স্বাধীনতার ধারণাটি ইতিবাচক অর্থ প্রদান করে। তাঁর দৃষ্টিতে কেবল বাধানিষেধের অপসারণই স্বাধীনতা নয়, স্বাধীনতার সঙ্গে একটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিষয় জড়িত। ব্যক্তি তার ক্ষমতা দ্বারা এমন কিছু বিশেষ কাজ সম্পন্ন করবে-যা সমাজের সকল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। রাষ্ট্রই এইসব ক্ষেত্রে দায়িত্বপূর্ণভাবে কাজ করে।
অধ্যাপক বাকার স্বাধীনতার বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করেছেন। তাঁর কাছে স্বাধীনতার তিনটি দিক বিদ্যমান। যেমন- [1] পৌর, [2] রাজনৈতিক ও [3] অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। তিনি এ কথাও বলেছেন যে, এই তিন ধরনের স্বাধীনতার মধ্যে বিরোধ দেখা দিতে পারে।

Leave a Comment