আইন ও নৈতিক বিধির মধ্যে পার্থক্যগুলি উল্লেখ করো

আইন ও নৈতিক বিধির মধ্যে পার্থক্যগুলি উল্লেখ করো।
আইন ও নৈতিক বিধির মধ্যে পার্থক্যগুলি উল্লেখ করো।

আইন ও নৈতিক বিধির পার্থক্য

সমাজে এমন কিছু বিধান আছে যার সঙ্গে মানুষের বিবেকবোধ, উচিত-অনুচিত, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় প্রভৃতি বিষয়গুলি জড়িত এবং এগুলির দ্বারা মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, এইসব বিধানকে বলা হয় নৈতিক বিধি। অপরদিকে মানুষের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও মতাদর্শ প্রভৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুনকে আইন বলা হয়। সুতরাং আইন ও নৈতিক বিধির মধ্যে কতকগুলি ক্ষেত্রে পার্থক্য বিদ্যমান। যেমন-
প্রথমত, রাষ্ট্রের আইন সার্বভৌম শক্তির দ্বারা অনুমোদিত। এই আইন প্রয়োগ করা হয় বাধ্যতামূলকভাবে। কিন্তু নৈতিক বিধির পিছনে সার্বভৌম শক্তির সমর্থন থাকে না। তাই নৈতিক বিধির প্রয়োগ বাধ্যতামূলক নয়। তবে কেউ নীতি বহির্ভূত কোনো কাজ করলে লোক নিন্দা, বিবেকের দংশন প্রভৃতি ভোগজনিত শান্তি পেতে হয়।
দ্বিতীয়ত, সমাজে এমন কিছু বিষয় আছে যা আইনের দৃষ্টিতে অন্যায়, কিন্তু নৈতিক বিধির ক্ষেত্রে অন্যায় নাও হতে পারে। যেমন ভারতীয় যানবাহন আইন অনুসারে বাঁ-দিক ধরে গাড়ি চালানো উচিত। কেউ ডান দিকে গাড়ি চালালে তা আইনের দৃষ্টিতে অন্যায় হলেও নৈতিক দিক থেকে নীতি বিরুদ্ধ নয়। আবার সমাজে এমন কিছু বিষয় আছে যা ভঙ্গ করলে আইনের দৃষ্টিতে অন্যায় নয়, কিন্তু নৈতিক বিধির ক্ষেত্রে অন্যায়। যেমন- মদ্যপান বেআইনি নয় কিন্তু তা নীতি বিরুদ্ধ কাজ।
তৃতীয়ত, নৈতিক বিধির পরিধি আইনের তুলনায় অনেক বেশি ব্যাপক। কোনো রাষ্ট্রের বা সমাজের মানুষের বাহ্যিক জীবন এবং তাদের আচার-আচরণ আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অপরদিকে, মানুষের বাহ্যিক ও অভান্তরীণ উত্তয় প্রকার কাজকর্ম নৈতিক বিধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মানুষের চিন্তাভাবনা, মানসিক অনুভূতি, মননশীলতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে নৈতিক বিধির অনুশাসন বিদ্যমান। এই প্রসঙ্গে ম্যাকাইভার উল্লেখ করেছেন যে, Law does not and cannot cover all the grounds of morality!
চতুর্থত, আইন রাষ্ট্রভেদে বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। অর্থাৎ বিভিন্ন রাষ্ট্র তার নিজ নিজ প্রয়োজন অনুসারে আইন প্রণয়ন করে এবং প্রয়োজন অনুসারে তা সংশোধন করে। কিন্তু নৈতিক বিধির ক্ষেত্রে একথা খাটে না। নৈতিক বিধিগুলি সকল দেশে এবং সবসময় একই ধরনের হয়ে থাকে। মানুষ তার প্রয়োজন মত নৈতিক বিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করতে পারে না।
পঞ্চমত, আইন সবসময়েই সুসংবন্ধ এবং সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। কিন্তু নৈতিক বিধি সুসংবদ্ধ এবং সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান নয়। কারণ নৈতিক বিধির সঙ্গে মানসিক অনুভূতি, মননশীলতা, মানুষের চিন্তাভাবনা প্রভৃতি জড়িত থাকে।
ষষ্ঠত, আইন হল সর্বজনীন বিষয়। কারণ সার্বভৌম শক্তি সকল মানুষকে সমানভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তা প্রণয়ন করে। অপরদিকে নৈতিক বিধি সর্বজনীন নয়। তা ব্যক্তিকেন্দ্রিক। নৈতিক বিধির সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত বিবেকবোধ জড়িত থাকে।

উপসংহার: 

এইসব পার্থক্যের ভিত্তিতে বলা যায় যে, রাষ্ট্র কখনো-কখনো তার অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে এখন আইন প্রণয়ন করতে পারে যা নৈতিক বিধিকে লঙ্ঘন করে। বহিঃশত্রুর আক্রমণ, যুদ্ধ প্রভৃতির সময় এই ধরনের আইন সৃজন করা হয়। কিন্তু নৈতিক বিধির ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য নয়।

Leave a Comment