বারানির ফতোয়া-ই-জাহান্দারিতে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা কী ছিল

বারানির ফতোয়া-ই-জাহান্দারিতে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা কী ছিল

বারানির ফতোয়া-ই-জাহান্দারিতে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা কী ছিল
বারানির ফতোয়া-ই-জাহান্দারিতে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা কী ছিল

সুলতানি যুগের শাসনব্যবস্থায় জিয়াউদ্দিন বারানি এবং তাঁর রচিত ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থটির এক বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তিনি এই গ্রন্থে সুলতানি যুগের বিভিন্ন বিষয় সুচারুরূপে বর্ণনা করেছেন। একজন শ্রেষ্ঠ সভাসদ হিসেবে সতেরো বছর মহম্মদ বিন তুঘলকের সঙ্গীরূপে তিনি সুলতানি দরবারে ছিলেন। ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে দরবার থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তিনি দুখানি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন, যার মধ্যে একটি হল ফতোয়া-ই-জাহান্দারি। এই গ্রন্থে একজন মুসলিম শাসকের আদর্শ রাজনৈতিক নীতি কেমন হবে তার পর্যালোচনা রয়েছে। তাঁর এই গ্রন্থ থেকে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। :

বারানির ফতোয়া ই-জাহান্দারি গ্রন্থে রাজতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণা

(i) রাজার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা

বারানি বলেন যে, সুলতান বা বাদশাহ ঐশ্বরিক শক্তি (Divine Power) ও গুণাবলি দ্বারা শ্রীমণ্ডিত। এই মুসলিম শাসকেরা হলেন ঈশ্বরের ছায়া বা প্রতিবিম্ব (জিলুল্লাহ্)। তাই এই পার্থিব জগতের যাবতীয় হিতাহিত বা কল্যাণসাধনের দায়িত্ব ঈশ্বর তাঁর ওপর অর্পণ করেছেন। তবে শাসক তাঁর কাজের জন্য সাধারণের কাছে দায়বদ্ধ নন। সমস্ত কাজের জন্য তিনি ঈশ্বরের কাছেই দায়বদ্ধ।

(ii) রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ

ধর্মীয় আদর্শ থেকে বিচ্যুত জনগণকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনার জন্য সুলতান রাজনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারেন বলে বারানি অভিমত প্রকাশ করেছেন।

(iii) রাজ আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন

রাজ আইন মেনে চলা বা তার প্রতি যথাযথ সম্মান জ্ঞাপন করা প্রতিটি মানুষের আবশ্যিক দায়িত্ব। রাজ আইনের যথার্থতা সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন তোলা শুধু অন্যায় নয়, অনৈতিকও বটে।

(iv) রাজকীয় মর্যাদা প্রদর্শন

রাজতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষার জন্য সুলতান নিজের আচরণে গাম্ভীর্য, দরবারে জাঁকজমক ও ব্যক্তিগত বিলাসব্যসনের ব্যবস্থা করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে সর্বজনস্বীকৃত পারস্যের সাসানীয় রাজতন্ত্রের আদবকায়দা অনুসরণের কথা বারানি বলেন। এর মাধ্যমেই প্রজাবর্গ সুলতানকে মান্য করবে বলে তিনি মতপ্রকাশ করেছেন।

(v) আইনের সংরক্ষণ

ফতোয়া-ই-জাহান্দারিতে সুলতানের ইসলামি কর্তব্য হিসেবে শরিয়ত বা ধর্মীয় আইনের সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে সুলতান প্রয়োজনে এই বিধানের সংশোধন বা পরিমার্জনও করতে পারেন।

বারানির ফতোয়া ই জাহান্দারি গ্রন্থে রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত ধারণা

(i) শরিয়ত বা ধর্মীয় বিধিপালন

ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থে বারানি রাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত ব্যাখ্যায় শরিয়ত বা ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী রাজ্য শাসনের কথা বলেছেন। তাঁর মতে, একজন শাসকের প্রধান কর্তব্য হল শরিয়ত অনুযায়ী রাষ্ট্রপরিচালনা করা এবং ইসলাম ধর্মকে সুরক্ষাদানের সঙ্গে সেই ধর্মের প্রচার ও প্রসারের কাজে নিয়োজিত থাকা। এ ছাড়া তিনি একথাও বলেছেন যে, শাসক এমনভাবে রাজকর্তব্য পালন করবেন যেন ঈশ্বরদত্ত সকল ক্ষমতা ও সম্পদ বিধর্মীর বিনাশ এবং অন্যায় প্রতিরোধে ব্যবহৃত হতে পারে।

(ii) দুই রাজ্যের তত্ত্ব

জিয়াউদ্দিন বারানি দুই প্রকার রাজ্যের কথা বলেছেন, যথা-ঈশ্বরের রাজ্য ও ইহজগতের রাজ্য। তাঁর মতে, প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী ঈশ্বরের রাজ্যই হল যথার্থ রাজ্য। অন্যদিকে ইহজগতের রাজ্য ঈশ্বরের ইচ্ছায় পরিচালিত হয়। তিনিই ইহজগতের কাউকে দণ্ড দেন, আবার তিনিই কোনও ব্যক্তিকে রাজ্য প্রদান করে তাকে রাজা হিসেবে নির্বাচিত করেন। তাছাড়া ইহজগতের রাজ্য ও রাজাকে বারানি তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন- প্রথম শ্রেণি (নবীর শাসন),  দ্বিতীয় শ্রেণি (পয়গম্বরের অনুসারী রাজ্য) ও তৃতীয় শ্রেণি (স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র)।

(iii) জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি

বারানির মতে, সুলতানকে সর্বদা প্রজা কল্যাণসাধনের কাজে যুক্ত থাকতে হবে। কারণ, রাষ্ট্রনীতি ও সুশাসন পরিচালনার জন্য জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা বিশেষ প্রয়োজন। বিভিন্নরকম জনহিতকর কার্যাবলির মাধ্যমেই সুলতান প্রজাদের আনুগত্য অর্জনে সক্ষম হবেন।

(iv) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা

ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থে বারানি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উল্লেখ করেছেন। ঈশ্বরের রাজ্যে সব মানুষের সমান অধিকার আছে। তাই সুলতান প্রজাদের ন্যায়বিচার দিয়ে তাদের জীবন ও সম্পত্তির রক্ষা করবেন। বারানির মতে, ন্যায়বিচার হল মূলত সত্য, ন্যায় ও ধর্মের প্রতিষ্ঠা। ন্যায়ের মাপকাঠিতে রাষ্ট্র তার লক্ষ্যে অটুট থাকলে তার স্থায়িত্ব সুদৃঢ় হয় ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকে।

আরও পড়ুন – জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment