ইউরোপে সামরিক বিপ্লবের ফল কী ছিল

ইউরোপে সামরিক বিপ্লবের ফল কী ছিল

অথবা, প্রযুক্তির প্রভাবে সামরিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ফলাফল কী হয়েছিল

অথবা, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে আগ্নেয়াস্ত্র ও যুদ্ধের আধুনিক রীতি কৌশলের প্রভাব আলোচনা করো

ইউরোপে সামরিক বিপ্লবের ফল কী ছিল
ইউরোপে সামরিক বিপ্লবের ফল কী ছিল

ইউরোপে সামরিক বিপ্লবের ফলাফলসমূহ

বারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্রের আবিষ্কার সামরিক ক্ষেত্রে যেমন ব্যাপক পরিবর্তন আনে, তেমনই রাজনীতি ও সমাজের উপরেও এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।

(1) রাজার শক্তিবৃদ্ধি: বারুদ তৈরির উপকরণ সোরা, গন্ধক ইত্যাদি এবং কামান ও গোলা তৈরির উপকরণ লোহা, তামা, কয়লা ইত্যাদির উপরে ছিল রাজার নিয়ন্ত্রণ। তাই অন্য কারও পক্ষে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করা সম্ভব ছিল না। আগ্নেয়াস্ত্রের একচেটিয়া কর্তৃত্ব রাজার ক্ষমতা চূড়ান্ত করেছিল।

(2) বৃহৎ সাম্রাজ্য গঠন: আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত সেনাবাহিনী রাজকীয় আগ্রাসন বৃদ্ধি করে। ফলে বৃহৎ সেনাবাহিনী ও আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে রাজা পার্শ্ববর্তী সামন্তশাসিত এলাকাগুলি দখল করে সাম্রাজ্যের পরিধি বাড়াতে সক্ষম হন।

(3) অর্থনৈতিক দুরবস্থা: উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অস্ত্রশস্ত্রের নির্মাণকার্য শুরু হলে দেশের প্রভূত অর্থসম্পদ ব্যয় করা হয়। ফলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও স্পেনের মতো দেশগুলির অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও ব্যয়বৃদ্ধির ফলে প্রজাদের উপর করের বোঝা বাড়ে।

(4) জাতীয় রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা: আগ্নেয়াস্ত্রের উপর রাজার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বিচ্ছিন্নতাবাদী সামন্তব্যবস্থার ভিত দুর্বল করে দেয়। বিশাল বাহিনী ও আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রে বলীয়ান রাজা একক কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ দ্বারা জাতীয় রাজতন্ত্র গঠনের কাজে সমর্থ হন। ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে একাধিক রাজতান্ত্রিক জাতীয় রাষ্ট্র।

(5) সর্বহারাদের জয়: মধ্যযুগে পদাতিকরা ছিলেন সাধারণ মর্যাদাহীন দীন-দরিদ্র শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষ। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্র পদাতিক বাহিনীর হাতে এলে তারা যেমন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন, অন্যদিকে নাইটদের আভিজাত্য ও গুরুত্ব ধ্বসে পড়ে। তাই মার্কিন ঐতিহাসিক ইউজিন এফ রাইস বলেছেন যে, ‘আগ্নেয়াস্ত্র যেমন যুদ্ধের রাজকীয়করণ করেছিল, তেমনই এক অর্থে এটি যুদ্ধের সাধারণীকরণও করেছিল।’

(6) সামন্তদের গুরুত্ব হ্রাস: মধ্যযুগে রাজা যুদ্ধের সময় সামন্তদের বাহিনীর সাহায্য নিতেন। সামন্তদের সম্মিলিত বাহিনী রাজার একক বাহিনীর থেকে বেশি হওয়ায় রাজা সামন্ত শ্রেণির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতেন। কিন্তু এই পর্বে আগ্নেয়াস্ত্রের অধিকারী রাজার একক শক্তি সামন্তদের মিলিত শক্তির তুলনায় বেশি হলে সামন্তরা রাজার কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন এবং রাজানুগ্রহে অস্তিত্ব রক্ষা করতে বাধ্য হন।

(7) নাইটতন্ত্রের গৌরব হ্রাস: মধ্যযুগে অশ্বারোহী বাহিনীর মর্যাদা ছিল সর্বাধিক। এই বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন অভিজাতবংশীয়, শিভালরি (Chivalry) ও ব্যক্তিগত বীরত্বের প্রতীক নাইট যোদ্ধা। তবে বারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্র আবিষ্কারের ফলে অশ্বারোহী বাহিনী গুরুত্বহীন হয়ে পড়লে মধ্যযুগের সামন্ততন্ত্রের প্রস্ফুটিত ফুলস্বরূপ নাইটগোষ্ঠীর গৌরব অস্তমিত হয়। সুতরাং, আলোচনা শেষে এটা বলা যায় যে, সামরিক প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি মারণাস্ত্রকে করে তুলেছিল আরও কার্যকরী ও ভয়ংকর। এর ফলে রণক্ষেত্রে ধ্বংসের পরিমাণ পূর্বের চেয়ে বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment