ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার ২৫-২৮ নং ধারা আলোচনা করো

ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার ২৫-২৮ নং ধারা
ভারতে যুগ যুগ ধরে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মাবলম্বীরা বসবাস করছে। অর্থাৎ ভারতবর্ষ বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের স্থান দিয়েছে, তাদেরকে গ্রহণ করেছে। দীর্ঘকালব্যাপী ব্রিটিশরা ‘বিভাজন ও শাসন’ (Divide and Rule) নীতির অনুসরণের মাধ্যমে ভারতকে শোষণ করেছিল। এই নীতি অনুসরণ করার ফলে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং তারা বিদ্বেষপ্রবণ হয়ে পড়ে। ফলত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় এবং শেষপর্যন্ত ভারত দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এর ফলে ভারত ও পাকিস্তান নামক স্বতন্ত্র দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তান ধর্মীয় রাষ্ট্র এবং ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
(1) ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষতার অর্থ
ভারতবর্ষ হল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মূল সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ কথাটির উল্লেখ না থাকলেও ১৯৭৬ সালের ৪২ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটির সংযোজন করা হয়েছে। ধর্মের বিষয়ে রাষ্ট্র কোনোরকম পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করবে না-এই কথাই ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটির মাধ্যমে বোঝাতে চাওয়া হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অনন্তসায়নম্ আয়েঙ্গার (Anantsayanam Ayyangar) গণপরিষদে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলতে কোনো ধর্মের প্রতি আমাদের বিশ্বাস নেই কিংবা দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই এরকম কথা বোঝায় না। ধর্মনিরপেক্ষ কথার অর্থ হল রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মকে সাহায্য করবে না, কোনো বিশেষ ধর্মকে প্রাধান্য দেবে না।
এর প্রকৃত অর্থ হল সব ধর্মের প্রতি সমান মর্যাদা প্রদান অর্থাৎ, সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্র কোনো একটি বিশেষ ধর্মের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করবে না। পণ্ডিত রাধাকৃয়াণ তাঁর ‘Recovery of Faith’ শীর্ষক গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলতে অধার্মিক, ধর্মবিরোধী বা ধর্ম বিষয়ে উদাসীন রাষ্ট্রকে বোঝায় না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হল এমন এক রাষ্ট্র, যা ব্যক্তি বা ধর্মীয় মতামত নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির ধর্মীয় স্বাধীনতা স্বীকার করে। আম্বেদকর-এর অভিমত, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত অর্থ হল জনগণের উপর রাষ্ট্র কোনো ধর্ম জোর করে চাপিয়ে দেবে না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে প্রতিটি নাগরিক সমভাবে ধর্ম ও বিবেকের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে (All that a Secular State means is that Parliament shall not be competent to impose any particular religion upon the rest of the people) I
পন্ডিত নেহরু-র মতে, ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে ধর্ম এবং বিবেকের স্বাধীনতাকে বোঝায়, এমনকি যারা কোনো ধর্ম পালন করে না তাদের স্বাধীনতাও এর অন্তর্ভুক্ত (We call our State a Secular one……it means freedom of those religion and conscience, including freedom of those who may have no religion.)। অধ্যাপক জেসি জোহারি ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার কতকগুলি মূল বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর বক্তব্য হল, স্বভাবগতভাবে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা অত্যন্ত উদার, ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা বিশেষ গতিশীল প্রকৃতির, – ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটি এখানে অনিয়ন্ত্রিত নয়। তাছাড়া রাজনীতির বিষয়টিকে এখানে ধর্মীয় আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।
(2) বিবেকের স্বাধীনতা, ধর্মপালন ও প্রচারের স্বাধীনতা
ভারতীয় সংবিধানের ২৫(১) নং ধারায় ভারতীয়দের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার ঘোষিত হয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তির বিবেকের স্বাধীনতা, ধর্মপালন, ধর্মপ্রচার, ধর্মস্বীকার করার স্বাধীনতা রয়েছে [২৫(১) নং ধারা]। রাষ্ট্র সাধারণভাবে কোনো ধর্মীয় বিষয়ের উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তবে কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে।
- বিবেকের স্বাধীনতা, ধর্মপালন ও প্রচারের স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণ : এই স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কিছু কিছু নিয়ন্ত্রণ লক্ষণীয়। জনস্বাস্থ্য, জনশৃঙ্খলা বা সামাজিক নীতিবোধ এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্র এই অধিকারের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেমন-
- কোনো বিশেষধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান কোনো বিশেষ ধর্মের অঙ্গ কি না তা বিচার করার ক্ষমতা আদালতের রয়েছে, এই মর্মে সুপ্রিমকোর্ট ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে হানিফ কুরেশি বনাম বিহার রাজ্য মামলায় রায় দেন। উল্লেখ্য যে, ধর্মের নামে বা কোনো বিশেষ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে যদি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় অথবা নরবলির ন্যায় কোনো প্রথা যদি সমাজে প্রচলিত থাকে অথবা সতীদাহ প্রথার মতো কোনো আইনবিরুদ্ধ প্রথা সমাজে চলতে থাকে তাহলে রাষ্ট্র অবশ্যই হস্তক্ষেপ করবে।
- ২৫(২) (ক) নং ধারায় বলা হয়েছে ধর্মাচরণের সঙ্গে জড়িত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিত্ত-সম্বন্ধীয় বা অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার রাষ্ট্রের রয়েছে। তাছাড়া সামাজিক কল্যাণসাধন ও সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র প্রয়োজনমতো আইন প্রণয়ন করে ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
- ২৫(২) (খ) নং ধারায় বলা হয়েছে সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে যাতে হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় সে ব্যাপারে রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করতে পারে। সংবিধানে হিন্দু শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। শিখ, জৈন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের, মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে শিখদের ক্ষেত্রে ধর্মাচরণের অঙ্গ হিসেবে কৃপাণ ধারণ ও বহণ সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত।
(3) ধর্মীয় সম্প্রদায় বা ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির অধিকার
সংবিধানের ২৬ নং ধারানুযায়ী প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায় বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে কয়েকটি অধিকার দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক ধর্মীয় গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সংস্থা স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং ধর্মীয় বিষয়ে নিজ কার্যাবলি পরিচালনা করতে পারবে। অর্থাৎ, ধর্মীয় রীতিনীতির ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন। স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি অর্জন ও ভোগদখল করতে পারবে। আইন অনুযায়ী সেই সম্পত্তি পরিচালনা করতে পারবে।
- ধর্মীয় সম্প্রদায় বা ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির অধিকারের নিয়ন্ত্রণসমূহ : এই অধিকারটির উপর কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ লক্ষণীয়। রাষ্ট্র, জনস্বাস্থ্য ও আইনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা রক্ষার জন্য যে-কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর এই অধিকারগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মে জারি করা ‘ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অপব্যবহার রোধ’ শীর্ষক অর্ডিন্যান্সটির কথা বলা যায়। পাঞ্জাবে দীর্ঘকাল যাবৎ উগ্রপন্থীরা যেভাবে গুরুদ্বারগুলিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে, তা রোধ করার উদ্দেশ্যে এই অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। এই অর্ডিন্যান্স অনুসারে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা, বিভেদ-বিদ্বেষ ছড়ানো, অবাঞ্ছিত অপরাধীদের আশ্রয় দেওয়া ও অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। যার বা যাদের উপর এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত থাকবে তারাও শাস্তি পাবেন। এমনকি কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভিতরে বিধিভঙ্গকারী কাজকর্মের সংবাদ পুলিশকে না জানালে তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।
(4) ধমীয় উদ্দেশ্যে কর আদায় নিষিদ্ধকরণ
সংবিধানের ২৭ নং ধারানুসারে বলা যায়, কোনো বিশেষ ধর্ম বা ধর্মসম্প্রদায়ের প্রসার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে কর প্রদানে বাধ্য করা যাবে না। তবে রাষ্ট্র বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কর প্রদানের পরিবর্তে অনুদান ধার্য করতে পারে।
ভারতে যে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি রয়েছে, পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে তেমন দেখা যায় না। বিভিন্ন ধর্মকে রক্ষা করা ধর্মনিরপেক্ষতার কাজ নয়। সমাজ ও রাজনীতির উপর ধর্মের চিরাচরিত প্রভাবকে দুর্বল করাই ধর্মনিরপেক্ষতার লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারণ ধর্ম প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গা। তাই ধর্মনিরপেক্ষতার উচিত শিক্ষা, রাজনীতি, অধিকার ইত্যাদি থেকে ধর্মকে পৃথক রাখা। সম্প্রতি ভারতবর্ষে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবেশ বিপন্ন। মৌলবাদ ও ধর্মীয় আবেগ বৃদ্ধির ফলে সাম্প্রদায়িকতা তৈরি হচ্ছে। তাই আজ ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।
(5) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষা নিষিদ্ধকরণ
সংবিধানের ২৮ নং ধারায় বলা হয়েছে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি সরকারি সাহায্যে পরিচালিত হয় সেখানে ধর্মশিক্ষা দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া সরকার কর্তৃক স্বীকৃত বা আংশিকভাবে সরকারি অর্থে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে শিক্ষার্থীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের বিনা অনুমতিতে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা যাবে না। সম্পূর্ণ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষা নিষেধ করা হয়নি। বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের দ্বারা পরিচালিত হলেও কোনো দাতা বা অছির দ্বারা প্রতিষ্ঠানে দাতা বা অছির উইলে ধর্ম বিষয়ে শিক্ষাদানের কথা উল্লিখিত থাকলে সেখানে ধর্মশিক্ষা দেওয়া যাবে।
মূল্যায়ন
নাগরিক ও বিদেশি নির্বিশেষে সব ব্যক্তিকেই ভারতবর্ষে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সংবিধানে রূপায়িত হয়েছে। পাশাপাশি ধর্মের নামে অনাচার ও সংকীর্ণতা দূর করার জন্য সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ বিধিনিষেধগুলিও রাখা হয়েছে, যার তাৎপর্য কম নয়। ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ-সংবলিত ধর্মীয় স্বাধীনতা শাশ্বত ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সাম্প্রতিককালে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য বিভেদকামী মৌলবাদী শক্তিগুলি সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু মৌলবাদীদের কর্তৃক বাবরি মসজিদ ধ্বংস, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ২০০২ সালে গুজরাতে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা, ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটে খ্রিস্টানদের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালানো ও গির্জাতে অগ্নিসংযোগ করা, ২০০৯ সালে ওড়িশার কমালে ৪৩ জন খ্রিস্টানের প্রাণনাশ প্রভৃতি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করেছে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে সুরক্ষিত করার জন্য বিভেদকামী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির ঘৃণ্য কার্যকলাপের বিরুদ্ধে শক্তিশালী জনমত গঠন করা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে আরও দক্ষতার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলিকে দমন করতে হবে।
আরও পড়ুন – সরকারের বিভিন্ন রূপ প্রশ্ন উত্তর