ছোটোগল্প প্রশ্ন ও উত্তর Class 11 | Choto Galpo Question Answer

ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্য: 
ছোটোগল্পের শুরু যেমন আকস্মিকভাবে-মাঝখান থেকে তেমনই তার সমাপ্তি ও মাঝপথে, একান্ত নাটকীয়ভাবে, অতৃপ্তিতে।
ছোটোগল্পে জীবনের খণ্ডচিত্র বর্ণিত হয়, এবং সেই খণ্ডচিত্রের মধ্যেই পাঠক উপলব্ধি করেন সমগ্রের ব্যঞ্জনা।
স্বল্প আয়তনে ছোটোগল্পের আয়োজন বাহুল্যবর্জিত।
ছোটোগল্পের ভাষা ব্যঞ্জনাধর্মী, সংকেতময়, শিল্পিত ও সংক্ষিপ্ত। 
ছোটোগল্প হল একমুখী-তার একটিমাত্র সামগ্রিক বক্তব্য।

Table of Contents

ছোটোগল্প প্রশ্ন ও উত্তর

ছোটোগল্প প্রশ্ন ও উত্তর

লোকবিশ্বাস কী? ‘ট্যাবু (Taboo) ও ‘টোটেম’ (Totem) কাকে বলে?

লোকবিশ্বাস: লোকবিশ্বাস ও সংস্কার হল এক ধরনের প্রত্যয়। কোনো সংহত জনসমষ্টি যদি কোনো লোকাচারকে কর্তব্য বা অকর্তব্য বলে বিশ্বাস করে এবং প্রত্যহ ব্যবহারিক জীবনে তা মেনেও চলে তখন সেই লোকাচার, লোকবিশ্বাসে পরিণত হয়। যেমন-মেয়ের শ্বশুর বা শাশুড়ি কেউ মারা গেলে তার বাপের বাড়ি থেকে মেয়ে-জামাই ও তাদের পুত্রকন্যাদের নতুন বস্ত্র দান করতে হয় এবং সেই বস্ত্র পরেই পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়।

বহু লোকবিশ্বাসই কুসংস্কার বা বিধিনিষেধ তথা ‘ট্যাবু’ (taboo)-তে পরিণত হয়।

ট্যাবু: ‘ট্যাবু’ হল সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারজাত বিধিনিষেধ বা অলিখিত নিষেধ। ট্যাবুর মধ্যে ধর্মভাবনা জড়িয়ে থাকে। বিধিনিষেধের প্রতি বিশিষ্ট জনসমষ্টির এত দৃঢ় বিশ্বাস নিহিত থাকে যে, সেই নিষেধ অমান্য করলে কঠোর শাস্তি পেতে হবে। এই ভয়ে তারা যুগের পর যুগ নির্দ্বিধায় ‘taboo’-র পালন করে চলে। তাই ‘ট্যাবু’ সমাজ নিয়ন্ত্রণের শক্তি অর্জন করে। ভীতি, অপরাধবোধ, মৃত্যুভয়, বিবেকদংশন ইত্যাদি থেকেই ট্যাবু-র উৎপত্তি।

টোটেম: ‘টোটেম’ হল-কোনো কিছুকে ‘মান্য করা’। কোনো একটি বিশেষ গোত্র বা জনগোষ্ঠী যদি কোনো প্রাণী, বৃক্ষ বা অপ্রাণীবাচক বস্তুকে } মান্য করে এই ভেবে যে, ওই প্রাণী; বৃক্ষ বা অপ্রাণীবাচক বস্তুতে তাদের আত্মা বা প্রাণ সঞ্চারিত হয়ে আছে তবে সেগুলি হল ওই বিশেষ জনগোষ্ঠীর ‘টোটেম’। এই বিশ্বাসবোধের কারণে ওই নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিশেষ কোনো প্রাণী, বৃক্ষ বা অপ্রাণীর একটি সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই জনগোষ্ঠী মনে করে সেই বিশেষ প্রাণী, বৃক্ষ বা অপ্রাণী থেকেই তাদের জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ, ওই টোটেম (Totem) থেকে তারা জন্ম নিয়েছে এবং তাদের মৃত্যুর পর ওই গোত্রের টোটেমেই তাদের আত্মা বিলীন হয়ে যাবে।

লোকবিশ্বাস ও সংস্কারগুলিকে ক-টি ভাগে ভাগ করা যায় ? ভাগগুলির একটি করে দৃষ্টান্ত দাও।

লোকবিশ্বাসের শ্রেণিবিভাগ: লোকবিশ্বাস ও লোকসংস্কারগুলিকে মূলত পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়—লৌকিক দেবদেবী বিষয়ক, কৃষি বিষয়ক, জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহ বিষয়ক, লৌকিক চিকিৎসা বিষয়ক এবং অন্যান্য। 

লোকবিশ্বাসের দৃষ্টান্ত: লৌকিক দেবদেবী বিষয়ক- রাজবংশ সম্প্রদায়ের ধারণা যে, নিশা ঠাকুর শিশুদের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকলে তারা রাত্রে ঘুমোতে পারে না-সর্বদা ক্ষুধার্ত থাকে। আবার খেতে দিলে সম্পূর্ণ খেতেও পারে না। শিশুর এমন আচরণকে তারা ‘নিশা লাগা’ বলে। কৃষি বিষয়ক-সবজি ক্ষেতে কোনো হাঁড়ি, কলশির মূর্তি তৈরি করে রাখলে তথা কাকতাড়ুয়া রাখলে জমির উপর কারোর নজর লাগে না এবং ফলনও বেশি হয়। জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহ বিষয়ক-একটি লোকবিশ্বাস হল, বিবাহিত রমণীদের গর্ভাবস্থায় সাত ও আট মাসের মধ্যবর্তী সময়ে আত্মীয়স্বজনেরা তাদের আদরযত্ন করে নানা পদ খাওয়ান-একে ‘সাধ’ খাওয়ানো বলে। জন্মের পরে বাচ্চার কপালে কাজলের টিপ পরানো হয় কুনজর এড়ানোর জন্য। এই লোকবিশ্বাসগুলি পরবর্তীতে নগরজীবনেরও অঙ্গ হয়ে উঠে ঐতিহ্যের রূপ ধারণ করেছে।

বাংলাদেশের পাবনা জেলার লোকেদের একটি বিশ্বাস হল-বিয়ের দিন একটি টাকা দিয়ে শাশুড়িকে ‘মা’ বলে ডাকলে, শাশুড়ি-বউয়ের সম্পর্ক মধুর হয়।

মৃত্যু প্রসঙ্গে লোকবিশ্বাস রয়েছে যে, যখাযখি নামক অপদেবতার কুনজরে স্ত্রীলোক মৃত সন্তান প্রসব করেন বা সদ্যোজাতের মৃত্যু ঘটে। এর ফলে সকলে বিশ্বাস করেন যে, পরবর্তী সন্তানের সত্বর বিবাহ দিলে সে আর মরবে না। লৌকিক চিকিৎসা বিষয়ক-লোকবিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল এক জনপ্রিয় চিকিৎসাপদ্ধতি হল ‘কান্দির জল’ ছিটোনো। চৈত্র সংক্রান্তির রাতে একটি মাটির পাত্রে ভাত রেখে তাতে জল দিয়ে সেটি তুলসীমঞ্চের পাশে রেখে দেওয়া হয়। পরপর দুই দিন, দুই রাত্রি ওই ভাতের পাত্রের জল পালটানো হয়। চতুর্থ দিন বাড়ির পূর্ব বা উত্তর দিকের বড়ো ঘরের ‘থানসিরি’ ঠাকুরের সঙ্গে পাত্রটি বেঁধে রাখা হয়-এই জলকেই বলা হয় কান্দির জল। কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলার স্থানীয় রাজবংশি জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, সেই ‘কান্দির জল’ ছিটিয়ে দিলে বজ্রাহত মানুষ সুস্থ হয়ে ওঠে। কেউ বজ্রাহত হলে তাকে স্পর্শ করার পূর্বেও কান্দির জল ছিটিয়ে নেওয়া হয় এবং এভাবেই বজ্রাহতের প্রাথমিক চিকিৎসা করা হয়। অন্যান্য-কোচবিহারের প্রায় সমস্ত গ্রামাঞ্চলেই প্রচলিত একটি লোকবিশ্বাস হল, শনি ও মঙ্গলবার কোনো শ্যাওড়া গাছের তলা দিয়ে যাওয়া নিষেধ; কারণ শ্যাওড়া গাছ মাসান ও অপদেবতার আশ্রয়স্থল।

লোকসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করো।

বৈশিষ্ট্য: লোকসাহিত্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল- 

  • লোকসাহিত্যের উদ্ভবের সময় তা মৌখিকভাবেই আত্মপ্রকাশ করে, লিখিতরূপে এর প্রকাশ ঘটে না। পরবর্তীতে লোকসাহিত্য লিখিত হলে তার একটি প্রামাণ্য রূপ সৃষ্টি হয় মাত্র।
  • লোকসাহিত্যের বিষয় সাধারণত পল্লিসমাজ ও সংহত সমাজভুক্ত জনগোষ্ঠীর ‘লোক’ বা ‘ফোক’-দের জীবনযাপন, তাদের প্রাত্যহিক জীবনযুদ্ধ, আচার-ব্যবহার, বিশ্বাস এসব কিছুকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। তবে লোকসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে তা ভৌগোলিক মানচিত্রকে মান্যতা দেয় না-লোকসাহিত্য যে গ্রামেই রচিত হতে হবে এরূপ কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, গ্রাম বা পল্লিসমাজকে ঘিরে সৃষ্ট হলেই তা লৌকিক সাহিত্যের উপাদান রূপে স্বীকৃতি পায়।
  • লোকসাহিত্যে স্রষ্টার পরিচয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অজানা থেকে যায়। কারণ লোকাসাহিত্যে সৃষ্টিই মুখ্য, স্রষ্টা গৌণ।
  • লোকসাহিত্য কোনো ব্যক্তিবিশেষের রচনা নয়, সংহত সমাজের সৃষ্টি। তবে সমাজের অন্তর্ভুক্ত ‘লোক’-এরা যে একত্রিত হয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করে তা নয়, কোনো একটি লোকসাহিত্য প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যক্তিবিশেষ দ্বারাই সৃষ্ট হয় কিন্তু পরে তা সমষ্টির দ্বারা পরিমার্জন-পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে নতুন রূপ লাভ করে। তাই লোকসাহিত্য সংহত সমাজের সৃষ্টি বলেই গণ্য হয়। পল্লিসমাজের নিরক্ষর, ঐতিহ্যমুখী লোকেরাই লোকসাহিত্যের মূল স্রষ্টা।
  • লোকসাহিত্যের প্রচার কার্যত স্মৃতি এবং শ্রুতিনির্ভর। সংহত সমাজের মানুষেরা তাদের শুনে, মনে রাখা লোকসাহিত্যের স্মৃতিবিজড়িত রূপটিই আর-এক জনের কাছে ব্যক্ত করে-সেও সেটা শোনে, স্মৃতিতে রাখে। সুতরাং, সংহত সমাজের জনগোষ্ঠীই লোকসাহিত্যের প্রধান ধারক ও বাহক।
  • স্মৃতি এবং শ্রুতিজাত বলেই লোকসাহিত্য সদাপরিবর্তনশীল। ‘লোক’- এর মুখে মুখে প্রচারিত হতে হতে লোকসাহিত্যের রূপটি পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হতে হতে এগিয়ে চলে। যদিও লোকসাহিত্যের লিখিত রূপ প্রকাশ পেলে এই পরিবর্তনশীলতা বহুলাংশে ব্যাহত হয়। লিখিত রূপটিকেই মান্যরূপে বিবেচনা করা হয়।
  • লোকসাহিত্যের একই বিভাগের অন্তর্গত বিভিন্ন রচনার মধ্যে আঙ্গিকগত কোনো পার্থক্য লক্ষ করা যায় না। যেমন দুটি উপন্যাস বা দুটি নাটকের মধ্যে আঙ্গিকগত পার্থক্য থাকা সম্ভব কিন্তু দুটি লোককথা-র মধ্যে বা লোকনাট্যের মধ্যে আঙ্গিকগত কোনো পার্থক্য দেখা যায় না।
  • ভাব ও প্রকরণের দিক থেকে লোকসাহিত্য অত্যন্ত সহজসরল এবং জটিলতার কোনো অবকাশ এতে নেই বললেই চলে।

আধুনিক সাহিত্যে লোকসাহিত্যের প্রভাব আলোচনা করো। 

আধুনিক সাহিত্যে লোকসাহিত্য: গল্পের প্রতি মানুষের চিরকালীন আকর্ষণ থেকেই সাহিত্যের সৃষ্টি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এবং আদিতম মহাকাব্যগুলি তথা ইলিয়ড, ওডিসি, রামায়ণ, মহাভারত সমস্তই কাহিনিমূলক। এই আখ্যান বা কাহিনিই পরবর্তীতে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়- লিখিত গল্পকাহিনি বা আখ্যান এবং মৌখিক গল্পকাহিনির ধারা। এই লিখিত রূপটিই ক্রমবিকশিত হয়ে উপন্যাস বা ছোটোগল্পরূপে আখ্যায়িত হল, আর মৌখিক প্রকরণটি লোকসাহিত্যরূপে রূপকথা, ব্রতকথা, উপকথা, ইতিকথা, পুরাকথা নামে চিহ্নিত হল। কিন্তু রামায়ণ, মহাভারতের গল্পকাহিনিগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সেগুলি বহু পূর্ব থেকেই জনশ্রুতিতে মৌখিকভাবে প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ আদি সাহিত্যের মধ্যেও শায়িত রয়েছে লোকসাহিত্যের প্রচ্ছন্ন রূপ। আধুনিক সাহিত্য ব্যক্তিমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টি, আর লোকসাহিত্য সমষ্টিগত সৃষ্টি- তথাপি এই দুটিকে আলাদা করা যায় না।

আধুনিক এবং লোকসাহিত্য পরস্পর নির্ভরশীল। রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “নিম্নসাহিত্য এবং উচ্চ সাহিত্যের মধ্যে একটি ভেতরকার যোগ আছে।” এমনকি, দেশীয় লোকসাহিত্যের সঙ্গে বিদেশীয় রূপকথার সাদৃশ্য আছে বলেও অনেকে মনে করেন। যেমন, আমাদের অতিপরিচিত সিন্ডেরিলা’র (Cinderella) রূপকথাটির মূল বিষয়টি হল-বিমাতার অত্যাচার, যা আমাদের দেশের ‘শীত-বসন্তের রূপকথা’টিরও বিষয়মূল। কেবল আধুনিক লিখিত সাহিত্যগুলি সমাজ ও সময়ের তাগিদে নিজের রূপ পরিবর্তন করতে করতে বিবর্তিত হয় কিন্তু লোকসাহিত্যের বহিরাঙ্গের রূপটি আপাতভাবে সর্বদা অপরিবর্তনশীল-কেবল তার আদি সংস্করণটি মুখে মুখে প্রচারিত হওয়ার দরুন পালটে পালটে যেতে থাকে।

লোকসাহিত্যের অনেক প্রকরণ নিয়ে বহুলাংশে আধুনিক সাহিত্য রচিত হয়েছে। যেমন-লৌকিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রটিকে কেন্দ্র করেই বঙ্কিমচন্দ্র লিখলেন ‘কপালকুণ্ডলা’। ১৮৫২ সালে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ‘বিজয় বসন্ত’-র রূপকথাটি অবলম্বনে রচনা করেন ‘কীর্তিবিলাস’ নাটক। ‘গুলেবকাওলি’-র রূপকথাধর্মী উপাখ্যানটি ঊনবিংশ শতকে গদ্য-নাটক-কাব্য-তিনটি ধারাতেই প্রচলিত ছিল। ১৮৬৩-তে প্রকাশিত ‘পারিজাত কুসুম’ গদ্যটিও লৌকিক রূপকথাজাত। এ ছাড়াও লৌকিক বহু উপাদান সমৃদ্ধ করেছে আধুনিক সাহিত্যকে এবং আজও করে চলেছে।

বাংলা আধুনিক উপন্যাসে বিভিন্ন লৌকিক উপাদান যেভাবে জায়গা করে নিয়েছে, তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দাও।

উপন্যাসে লৌকিক উপকরণ: গল্প শোনার প্রবৃত্তিই মানুষের আদিমতম প্রবৃত্তি। সেই তাগিদ থেকেই কথাসাহিত্যের সূচনা বলে মনে করা হয়। লিখিত কথাসাহিত্যে ঐতিহ্যের বেশ ধারণ করে ঢুকে পড়ে নানান লোকবিশ্বাস, লোককথা, লৌকিক সংস্কার। তারই কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হল-

কপালকুণ্ডলা: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে স্বামীকে বশীকরণ করার জন্য ওষুধ আনার প্রসঙ্গ রয়েছে। কপালকুণ্ডলাকে বলতে শোনা যায়, “শ্যামাসুন্দরী স্বামীকে বশ করিবার জন্য ঔষধ চাহে, আমি ঔষধের সন্ধানে যাইতেছি”-এই প্রসঙ্গ সম্পূর্ণভাবেই লোকবিশ্বাসজাত।

বিষবৃক্ষ: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে ব্যবহৃত গীত এবং ছড়াগুলিতে লৌকিক প্রভাব লক্ষ করা যায়-

“আয়রে চাঁদের কণা 

তোরে খেতে দিব ফুলের মধু, পরতে দেব সোনা 

আতর দিব শিশি ভোরে, 

গোলাপ দিব কার্চ্চা করে 

আর আপনি সেজে বাটা ভোরে 

দিব পানের দোনা।”

কঙ্কাবতী: ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘কঙ্কাবতী’ উপন্যাসটি যাদুবাস্তবতার জগৎকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এটি একটি ছকভাঙা উপন্যাস, যাতে ঔপন্যাসিক তাঁর পাঠকদের এক ফ্যান্টাসি-র জগতে নিয়ে যান। রূপকথা-র আঙ্গিককে মনে করিয়ে দেয় এই উপন্যাস। উপন্যাসের নামচরিত্র কঙ্কাবতীর বিবাহ হয় একটি বাঘের সঙ্গে-এ ছাড়াও সেখানে ব্যাং, মশা, হাতি, চাঁদ, নক্ষত্র, ভূতনি সহ নানাপ্রকার চরিত্রের বিচিত্র কর্মকাণ্ড চলতে থাকে। এসব আমাদের লৌকিক পশুকথা-র আভাস দেয়।

গণদেবতা: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে অনিরুদ্ধ-পদ্মের নিঃসন্তান জীবনে সন্তানলাভের জন্য ঠাকুরের কাছে দোর ধরার প্রসঙ্গ এসেছে। জগন ডাক্তার বলেছেন, “সাপের স্বপ্ন দেখলে কী হয় জানিসতো? বংশবৃদ্ধি, ছেলে হয়…” লোকসমাজে এই ধরনের স্বপ্নভিত্তিক বিশ্বাসের প্রচলন রয়েছে।

হাঁসুলী বাঁকের উপকথা: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসে, বাঁশবনের অন্ধকারের যে বর্ণনা দিয়েছেন ঔপন্যাসিক, তার মধ্যে লুকিয়ে আছে সেখানকার মানুষের অনেক লৌকিক বিশ্বাস ও কুসংস্কারের কাহিনি।

“বাঁশবনে দপদপিয়ে অর্থাৎ দপদপ করে জ্বলে বেড়ায় পেত্যা অর্থাৎ আলেয়া। মধ্যে মধ্যে শাঁকচুন্নির চিলের মতন ডাক শোনা যায় শ্যাওড়া, শিমূলের মাথা থেকে। বাঁশবনে ক্যাঁ-ক্যাক-ক্যাঁ ডাক ওঠে। কাহারেরা মনশ্চক্ষে স্পষ্ট দেখতে পায়-গেছো পেত্নী কি কোনো ছোকরাভূত বাঁশের ডগাটা একবার মাটিতে ঠেকছে আবার ছেড়ে দিচ্ছে সেটা উঠে যাচ্ছে উপরে।”

পুতুল নাচের ইতিকথা: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে লৌকিক জীবনচর্যা, লোকসংস্কার, ট্যাবু ইত্যাদির প্রত্যক্ষ প্রতিফলন ঘটেছে। গ্রামের মানুষেরা যে আজও তাদের নিজস্ব লৌকিক বিশ্বাস, কুসংস্কার, আচার নিয়ে নিজেদের এক ভিন্ন জগৎ গড়ে তুলে প্রবাহিত হয়ে চলেছে-তারই প্রমাণ মেলে এই উপন্যাসে। শশী ডাক্তার যখন পঞ্চানন চক্রবর্তীকে ভুতোর মারা যাওয়ার খবর জানায় তখন তার প্রত্যুত্তর-“বটে? বাঁচল না বুঝি ছেলেটা? তবে তোমাকে বলি শোনো শশী, ভুতো যেদিন আছাড় খেলে, দিনটা ছিল বিষ্যুদবার। খবর পেয়ে মনে কেমন খটকা বাধল। বাড়ি গিয়ে দেখলাম পাঁজি-যা ভেবেছিলাম। ছেলেটাও পড়েছে বারবেলাও হয়েছে খতম। লোকে বলে বারবেলা কি সবটাই সর্বনেশে বাপু? বিপদ যত ওই খতম হবার বেলা।”-বৃহস্পতিবার বারবেলায় আঘাত পেলে মৃত্যু অবধারিত এমন লোকবিশ্বাসে বিশ্বাসী বহু লোকসমাজের মানুষ। লোকবিশ্বাসের এই রকম দেখে শশী ডাক্তারের মনে হয়েছিল-“এতগুলি মানুষের মনে মনে কি আশ্চর্য মিল। কারো স্বাতন্ত্র্য নাই, মৌলিকতা নাই, মনের তারগুলি একসুরে বাঁধা, সুখ দুঃখ এক, রসাভূতি এবং ভয় ও কুসংস্কারে এক, হীনতা ও উদারতার হিসাবে কেউ কারো চেয়ে এতটুকু ছোট অথবা বড় নয়।”-শশীর এই মনে হওয়া আদ্যন্ত একটি সংহত সমাজের পরিচয়কে বহন করে। এভাবেই আধুনিক সাহিত্যে মিশে থাকে লোকসংস্কৃতির সাবেকি উপকরণ।

কারা ‘লোক’ বা ‘ফোক’ নয়? লোকসাহিত্য লিখিত হলে তা কি জনশ্রুতির গুরুত্ব হ্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়?- তোমার অভিমত জানাও।

যারা লোক বা ফোক নয়: শহুরে জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত, আর্থিকভাবে সম্পন্ন, শিক্ষিত, চাকুরিজীবী মানুষ যারা কোনো সমমনোভাবাপন্ন, সম-আচারপালনে বিশ্বাসী নয়, সমবর্ণের সংহত জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয়, তাদেরকে ‘লোক’ বা ‘ফোক’ বলা যায় না। এরা কর্ম-ধর্ম, জীবনযাত্রার মান ও জীবিকা সূত্রে একে অপরের থেকে আলাদা হয়।

প্রসঙ্গত, শহরে বাস করে নাগরিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যারা লোকনৃত্য, লোকনাট্য বা লোকগান পরিবেশন করেন তারা কিন্তু ‘লোক’ বা ‘ফোক’ নন। আবার, শহরে বাস করেও যারা জীবনচর্চা ও মানসচর্চায় পল্লির শিকড়টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি, বিশ্বায়নের যুগেও যারা ঐতিহ্যবিমুখ হয়নি তারা কিন্তু ‘ফোক’-এরই অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ, শহরে বাস করলেই কেউ ‘লোক’ নন, গ্রামে বাস করলেই তিনি ‘লোক’-এই ভৌগোলিক মানচিত্রগত মানদণ্ড ‘লোক’ বা ‘ফোক’ মানে না। যেমন-পল্লি অঞ্চলে বসবাসকারী, আর্থিকভাবে সম্পন্ন, বিত্তবান, শিক্ষিত মানুষও ‘ফোক’ বা ‘লোক’ নন।

লোকসাহিত্যের লিখিত রূপ ‘জনশ্রুতির অন্তরায়: লোকসাহিত্য কখনোই লিখে রচনা করা যায় না। লোকসাহিত্যের যখন উদ্ভব হয় তখন তা মুখে মুখেই রচিত হয় এবং মুখে মুখেই প্রচারিত হয়। কিন্তু বর্তমানে লোকসাহিত্যকে লিখিতরূপে সংরক্ষণ করাই অধিক যুক্তিযুক্ত এবং আবশ্যক বলে মনে করেছেন বহু সমালোচক। কিন্তু সেই লিখন ও সংরক্ষণের কাজটি একজন অভিজ্ঞ শিক্ষিত গবেষকের হাতে হওয়াই কাম্য। একজন অভিজ্ঞ গবেষক লোকসাহিত্য সংরক্ষণকালে, যে জনশ্রুতিটি যেরূপভাবে শুনেছেন সেটিকে সেরূপভাবেই লিপিবদ্ধ করে রাখেন-ফলত, এতে জনশ্রুতির গুরুত্ব হ্রাস পায় না। তবে, লোকসাহিত্য লিখিতরূপে প্রকাশিত হলে ‘লেখ্যরূপ’-টিই একটি মান্যরূপ হিসেবে গৃহীত হয়। তাই অনেকক্ষেত্রেই জনশ্রুতি-র মাধ্যমে, লোকসাহিত্যের প্রচার হতে হতে পরিবর্তিত হওয়ার ঝোঁকটি কমে যায়। লোকসাহিত্যের লিখিত রূপটি তার পরিবর্তনশীলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং এটির একটি বিশিষ্ট রূপ সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়।

টোটেম ও ট্যাবু কি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত?- সংক্ষেপে আলোচনা করো। 

‘টোটেম’ ও ‘ট্যাবু’ : ‘টোটেম’ শব্দটির অর্থ হল- ‘মান্য করা’। কোনো একটি বিশেষ গোত্র বা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা যদি কোনো প্রাণী, বৃক্ষ বা অপ্রাণীবাচক বস্তুকে তাদের জন্মের কারণ হিসেবে মান্য করে তখন সেই প্রাণী, বৃক্ষ বা অপ্রাণীবাচক বস্তুই হয় সেই জনগোষ্ঠীর টোটেম (Totem)।

আর, ‘ট্যাবু’ (Taboo) হল সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন বিশ্বাস ও কুসংস্কার জাত বিধিনিষেধ, যা ভীতি থেকে তৈরি হয়।

‘টোটেম’ ও ‘ট্যাবু’-র সম্পর্ক: সাঁওতাল জনজাতির হাঁসদা গোত্রের মানুষেরা মনে করে যে, পাতিহাঁসের মধ্যে তাদের আত্মা সঞ্চারিত হয়েছে। পাতিহাঁস থেকেই তাদের জন্ম এবং মৃত্যুর পর তারা পাতিহাঁসের মধ্যেই বিলীন হয়ে যাবে। এই বিশ্বাসের জেরে পাতিহাঁস হয়ে উঠেছে, ওই নির্দিষ্ট সাঁওতাল জনজাতির ‘টোটেম’।

এই ‘টোটেম’ প্রচলিত থাকার ফলে, প্রাণনাশের ভয়ে সাঁওতাল জনজাতির হাঁসদা গোত্রের লোকেরা পাতিহাঁস হত্যা করে না। বিশ্বাস থেকে জাত এই নিষেধটি হল একটি ‘ট্যাবু’।

লোকনৃত্য কী? এর বৈশিষ্ট্য লেখো।

লোকনৃত্য: কোনো সংহত জনগোষ্ঠীর লোকেদের জীবন-জীবিকা, উত্তর সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় সংস্কারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত নৃত্যকেই ‘লোকনৃত্য’ বলে। বর্তমানে ভারতে প্রচলিত সকল শাস্ত্রীয় নৃত্যের মূলেও লোকনৃত্যের উপাদানগুলি সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। বাংলার লোকনৃত্যগুলির মধ্যে-অবতার নাচ: গম্ভীরা ও চড়ক, ছৌনাচ, কালীনৃত্য, কাঠিনাচ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

বৈশিষ্ট্য:

  • লোকনৃত্যে জাতিগত, স্থানগত ও দেশগত প্রভাব লক্ষ করা যায়।
  • লোকনৃত্যগুলির বিষয় যেমন বহুপরিচিত পুরাণগাথা থেকে অনুপ্রাণিত হয়, তেমনই বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠীর জীবনের নানাদিকও ফুটে ওঠে নৃত্যের মাধ্যমে।
  • লোকনৃত্যগুলি শাস্ত্রীয় প্রভাবমুক্ত হয়।
  • গান ও তালবাদ্য লোকনৃত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
  • লোকনৃত্য মূলত তিন রকমের-পুরুষের নাচ, নারীর নাচ এবং মিশ্র নাচ।

লোকনাট্য কাকে বলা হয়? লোকনাট্যের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লেখো।

লোকনাট্য: কোনো সংহত সমাজের অন্তর্ভুক্ত ও বিশিষ্ট জনগোষ্ঠীর লোকজীবনের নানান কাহিনির উপর ভিত্তি করে মুখে মুখে রচিত এবং তারপর অভিনীত নাটককেই সাধারণত ‘লোকনাট্য’ বলা হয়। লোকনাট্য একই সঙ্গে দৃশ্য, শ্রাব্য এবং অভিনয়যোগ্য। লোকনাট্যে সমাজজীবনের বাস্তব ছবি ধরা পড়ে।

বৈশিষ্ট্য

  • লোকনাট্য সাধারণ লোকেদের দ্বারা, সাধারণ লোকেদের কাছেই পরিবেশিত হয়। লোকনাট্যের রচয়িতা, শিল্পী ও দর্শক সকলেই লোকায়ত স্তরের মানুষ।
  • গ্রামে খোলা আকাশের নীচে, মুক্ত ও অবারিত প্রাঙ্গণে লোকনাট্য অভিনীত হয়।
  • লোকনাট্য কোনো শিল্পশাসন বা নিয়মনীতির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। এর আকার ও আয়তন নিত্যপরিবর্তনশীল, দর্শকদের রুচি ও চাহিদার উপর নাটকটির রূপ পরিবর্তন নির্ভর করে।
  • লোকনাট্যে সংলাপ অপেক্ষা সংগীতেরই প্রাধান্য লক্ষ করা যায়।
  • লোকনাট্যের বিষয়বস্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্মমূলক। মানবিক বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রেও এখানে ধর্ম ও নীতির আদর্শই ধরা পড়ে।

লোককথার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তার শ্রেণিবিভাগ করো।

লোককথা: প্রত্যেক ভাষাভাষী মানুষের মধ্যেই কথাসাহিত্যের দুটি ধারা লক্ষ করা যায়-একটি মৌখিক এবং অপরটি লিখিত ধারা। কথাসাহিত্যের লিখিত ধারাটির উদ্ভব হওয়ার আগে মৌখিক ধারাটি নিরক্ষর মানুষের দ্বারা রচিত এবং প্রচারিত হয়ে আসছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের ফলে কথাসাহিত্যের লিখিত ধারাটি আত্মপ্রকাশ করতে থাকে এবং মৌখিক ধারাটির প্রাণশক্তি হ্রাস পেতে থাকে। বাংলা ভাষায় কথাসাহিত্যের এই মৌখিক ধারাটিকেই আমরা চিহ্নিত করতে পারি ‘লোককথা’ বলে। লোকমুখে প্রচলিত, কথাসাহিত্যের মৌখিক ধারায় সম্পৃক্ত, বিশেষ ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত, স্রষ্টানামহীন কাহিনিমূলক রচনাই লোককথা। বলা যেতে পারে যে, লোককথা বা লোককাহিনি হলো বংশানুক্রমিকভাবে প্রাপ্ত সম্পদ। ইতিহাস, পুরাণ, বিভিন্ন ধর্মীয় ভাবাদর্শ, লৌকিক ঘটনাধারা, লোকায়ত বিশ্বাস অবলম্বনে ‘লোককথা’ রচিত হয়।

শ্রেণিবিভাগ: লোকসংস্কৃতিবিদগণ বাংলার বহুবিধ লোককথাগুলিকে তাঁদের মতো করে শ্রেণিবিভাগ করেছেন। সেগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ভাগগুলি হল- রূপকথা, উপকথা বা পশুকথা, ব্রতকথা, রোমাঞ্চকথা, পুরাণকথা, বীরকথা, স্থানিককথা, রঙ্গকথা, নীতিকথা, বোকাকথা, কিংবদন্তি বা ইতিকথা। এগুলি ছাড়াও লোককথার বিভিন্ন প্রচ্ছন্ন ধারা লক্ষ করা যায়। যেমন-ধাঁধামূলক গল্প, শিকলি গল্প ইত্যাদি।

লোককথার সংজ্ঞা নির্দেশ করে বিভিন্ন প্রকার লোককথার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

অথবা, লোককথা কাকে বলে? লোককথার যে-কোনো দুটি শাখার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

অথবা, লোককথা কাকে বলে? দুটি লোককথার নাম লেখো এবং যে-কোনো একটি লোককথা সম্পর্কে তোমার মত লিপিবদ্ধ করো।

লোককথা: লোকমুখে প্রচলিত, কথাসাহিত্যের মৌখিক ধারায় সম্পৃক্ত, বিশেষ ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত, স্রষ্টানামহীন কাহিনিমূলক রচনা • লোককথা। লোককথা লোকশ্রুতির ফসল, তাই স্মৃতিবাহিত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গদ্যে রচিত। পদ্যে রচিত লোককাহিনি ‘গীতিকা’ নামে প্রচলিত। লোককথার উদাহরণ-রূপকথা, উপকথা, নীতিকথা, পশুকথা, ব্রতকথা, পুরাণ কথা ও কিংবদন্তি কথা।

রূপকথা: Fairy Tale বা Household tale-এর সমার্থক শব্দ রূপকথা। রূপকথার মধ্যে রাজা-রানি, রাজপুত্র-রাজকন্যা, পরি এবং রাক্ষস ইত্যাদির অতিকল্পিত অতিবাস্তব কাহিনি থাকে। অধিকাংশ রূপকথারই উপজীব্য হল ন্যায় ও অন্যায়ের সংঘাতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। রূপকথায় ইচ্ছাপূরণের বিনোদন লক্ষিত হয়। যেমন-ঠাকুমার ঝুলি।

উপকথা বা পশুকথা, নীতিকথা: যে লৌকিক উপাখ্যানের কাহিনি শিক্ষামূলক, নীতিনির্দিষ্ট এবং মানুষ ছাড়াও পশুপাখি যার বিশিষ্ট চরিত্র, তাকে উপকথা বা পশুকথা বলে। নীতি প্রচারের পাশাপাশি এই জাতীয় উপাখ্যান কৌতুক সৃষ্টি করে। নির্দিষ্ট দেশ-কাল অতিক্রম করে চিরকালীন মানবজীবনের সত্যই উপকথার মূল বিষয়বস্তু। যে উপকথায় নীতি যুক্ত থাকে, তাকে নীতিকথা বলে। যেমন-ঈশপের গল্প, হিতোপদেশ, পঞ্চতন্ত্র।

ব্রতকথা: বাংলার লৌকিক দেবতাদের অবলম্বন করে আদিম সংস্কার ও উচ্চতর সংস্কৃতির মিশ্রণে সৃষ্ট ব্রতকথার মূল বিষয় দেবতাদের মাহাত্ম্যকীর্তন, গার্হস্থ্য মঙ্গলসাধন।

পুরাণ কথা: আর্য-প্রাগার্য সংস্কৃতির মিলনে সৃষ্ট পুরাণ কথায় পৃথিবীর সৃষ্টি, মানুষের বিবর্তন, সনাতন ধর্মের আবির্ভাব, লোকাচারগুলির উৎস কাহিনিকাঠামো তৈরি করে।

বীরকথা: দুঃসাহসী অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন বীরের কাহিনি এর কেন্দ্রীয় বিষয়। যেমন-বিক্রমাদিত্যের কাহিনি।

রোমাঞ্চকথা (Novella)- বাস্তবনির্দিষ্ট স্থানকালের প্রেক্ষাপটে রচিত রোমাঞ্চ কথায় অদ্ভুত ঘটনা থাকলেও তা অবিশ্বাস্য নয়। যেমন- আলিফ- লায়লার কাহিনি।

স্থানিক কথা: বিশেষ কোনো স্থানকে কেন্দ্র করে রচিত স্থানিক কথার কাহিনি অবাস্তব হলেও তা সত্য বলে বিশ্বাস করা হয়।

রঙ্গকথা: হাসিতামাশা, চুটকি, রঙ্গ-রসিকতা নিয়ে রঙ্গ কথা রচিত হয়। যেমন-গোপাল ভাঁড়ের গল্প।

বোকাকথা (Numskull tale): বোকা লোকেদের নিয়ে বিদ্রুপ, লোক ঠকানোর অশ্লীল কাহিনিকে বোকা কথা বলে। যেমন- মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প।

রূপকথা’র পরিচয় দাও। রূপকথার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

রূপকথা শব্দের ব্যুৎপত্তি: ড. সুকুমার সেনের মতে, অপূর্বকথা> অপূরুব কথা > অপরূপ কথা > রূপকথা-এভাবেই শব্দটি এসেছে। পরে ‘রূপকথা’-র ধ্বনি পরিবর্তনগত প্রক্রিয়ায় ‘র’ লুপ্ত হয়ে ‘উপকথা’ নামক তদ্ভব শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। অপরদিকে, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয় মনে করেন- ‘উপকথা’ থেকে ‘র’-কারীভবনের ফলে ‘রূপকথা’ শব্দটি এসেছে।

রূপকথা: রূপকথাকে ইংরেজিতে বলা হয় Fairy Tale। সুইডিশ ভাষায় বলা হয় Saga এবং জার্মান ভাষায় Marchen। লোককথায় বিভিন্ন শাখার মধ্যে রূপকথা হল সবচেয়ে জনপ্রিয় শাখা। ইংরেজি ‘Fairy’ শব্দের অর্থ পরি, যা কল্পলোকের প্রাণী। রূপকথাকে তাই কল্পলোকের কথাও বলা হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতানুসারে, রূপকথার জগৎ শিশুকল্পনার জগৎ। তবে গভীরভাবে বিচার করলে দেখা যায়, রূপকথা কেবল শিশুর আনন্দ উপভোগের বস্তু নয় বরং পরিণতবয়স্ক ব্যক্তিরই উপভোগের রসবস্তু। অর্থাৎ, যে-সমস্ত ইচ্ছা বাস্তবে পূরণ করা সম্ভব হয় না, জীবনতাড়িত মানুষ কল্পনার জগতে তা পূরণ করার জন্য রূপকথার আশ্রয় নিয়েছে। অকল্পনীয় ইচ্ছাপূরণের লোককথাই রূপকথা।

বৈশিষ্ট্য: 

  1. রূপকথাগুলির কাহিনি সাধারণত দীর্ঘ এবং বিচিত্র বিষয় ও শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত হয়। 
  2. নির্দিষ্ট কোনো স্থান বা চরিত্রকে অবলম্বন করে রূপকথার কাহিনি নির্মিত হয় না। অবিশ্বাস্য, উদ্ভট, কল্পিত, রোমাঞ্চকর ঘটনাসমূহই রূপকথার উপজীব্য। 
  3. বেশিরভাগ রূপকথা শুরু হয় নামহীন রাজা-রানির কথা দিয়ে। যেমন-‘এক যে ছিল রাজা…’। 
  4. রূপকথায় রাজা-রানিদের নাম না পাওয়া গেলেও রাজপুত্র বা রাজকন্যাদের নাম পাওয়া যায়। যেমন-লালকমল-নীলকমল, মধুমালা-শঙ্খমালা ইত্যাদি।
  5. অলৌকিক কোনো শক্তিবলে রাজপুত্র বা রাজকন্যারা অভিশপ্ত হতে পারে। পরে অলৌকিক শক্তিবলে পুনরায় তার শাপমুক্তি ঘটে। 
  6. নিয়তি রূপকথার অন্যতম প্রধান চরিত্র, যা কাহিনিকে এবং চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। রূপকথার কাহিনিবিন্যাসের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল ‘ভাগ্যবিপর্যয়’।
  7. রূপকথার শেষে সকল দুর্দশা অতিক্রান্ত হয়ে শান্তি আসে। যে-কোনো প্রকারে দুষ্টের দমন হয় এবং রাজা-রানি, রাজপুত্র-পুত্রবধূদের নিয়ে সুখে- শান্তিতে বসবাস করেন। ইচ্ছাপূরণের মাধ্যমেই রূপকথার পরিসমাপ্তি আবশ্যক।

আরও পড়ুন – সরকারের বিভিন্ন রূপ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment