লোককথার একটি অন্যতম শাখা হল-পুরাণকথা। লোকপুরাণকে ইংরেজিতে বলা হয় Myth। সৃষ্টির অজ্ঞাত লীলারহস্য বর্ণনা করে যেসকল অলৌকিক বিবরণ রচিত হয়ে থাকে, ইংরেজিতে তাকে Myth বলা হয়। Myth হল মৌখিক ঐতিহ্যানুসারী, তাই একে মৌখিক শিল্পের আখ্যাও দেওয়া যেতে পারে।
লোককথা প্রশ্ন ও উত্তর

১। উপকথা বা পশুকথার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। এর বৈশিষ্ট্য লেখো।
উপকথা বা পশুকথা: ‘পশুকথা’ শব্দটিকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘Animal Tale’। ‘পশু’ বলতে আমরা সাধারণত চারপেয়ে প্রাণীকে বুঝে থাকি কিন্তু ‘Animal Tale’-এ চতুষ্পদ প্রাণী ছাড়াও অনেক পাখির উল্লেখও পাওয়া যায়। তাই ‘Animal Tale’-এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘পশুপাখিকথা’ হওয়াটাই সমীচীন ছিল। যেসব গল্পে পশুপাখি ও অন্যান্য মনুষ্যেতর প্রাণীই প্রধান সেসকল গল্পকে ‘পশুকথা’ বা ‘উপকথা’ বলা হয়। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, লোককথার মধ্যে পশুপাখিকথাই হল সবচেয়ে প্রাচীন।
বৈশিষ্ট্য:
- নানা ধরনের অলৌকিক ও ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে দিয়ে পশুকথার কাহিনি বর্ণিত হয়।
- পশুকথায়, পশুপাখির উপর মানবসুলভ ও পশুসুলভ উভয় ধরনের দোষ-গুণই ধরা পড়ে। এই ধরনের লোককথায় মানবেতর তথা পশুপাখির উপর মানবিক দোষ-গুণ আরোপ করা হয়। ফলত, পশুপাখিরা মানুষের মতো আচরণ করে আবার তাদের পশুধর্মও সম্পূর্ণভাবে লোপ পায় না।
- পশুপাখি কথার মধ্যে রূপক বা Metaphor দেখা যায়, যা সরাসরি লোকজীবন থেকে নেওয়া।
- বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পশুপাখিকে নানান ধারণার প্রতীকরূপে ধরা হয়। যেমন-রাশিয়ায় শৌর্য ও বীর্যের প্রতীক হিসেবে ভালুক, ভারতে সিংহ ইত্যাদি।
- অনেকক্ষেত্রেই, পশুকথার মধ্যে কোনো-না-কোনো নীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। পশুদের নিয়ে এই নীতিকথাকে Fables বলে। যেমন- Aesop’s fables, পঞ্চতন্ত্র ইত্যাদি।
- অঞ্চলবিশেষে পশুপাখিরা আঞ্চলিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয়বাহী হয়। যেমন-বাংলাদেশে শেয়াল ধূর্ত, কাক খুব চতুর, বক নিরীহ প্রকৃতির জীব।
২। ব্রতকথা কী ও এর বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে, ব্রতকথার মূল উদ্দেশ্যটি ব্যক্ত করো।
ব্রতকথা: বাংলা লোককথার ধারায় ব্রতকথা হল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। ‘ব্রতকথা’-কে ইংরেজিতে বলা হয় ‘Religious Tale’। ব্রত হল ধর্মকেন্দ্রিক আচার-অনুষ্ঠান। ব্রতকথার মূল চরিত্রগুলি সামগ্রিকভাবে রূপকধর্মী, ব্রতকথার কুশীলবরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ। ব্রতকথা বাঙালির একান্ত নিজস্ব সম্পদ। বাঙালির একান্ত নিজস্ব ধর্মবোধ থেকে ব্রতের আচার-অনুষ্ঠানের জন্ম। এই আচার-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সরস ও চিত্তাকর্ষক ‘ব্রতকথা’ ধারাটি গড়ে উঠেছে। সাধারণত শস্য, বৃষ্টি, সুখ, সৌভাগ্য, সন্তান ইত্যাদি কামনা করে ব্রতের অনুষ্ঠান পালিত হয়। ‘ব্রত’ কোনো একক অনুষ্ঠান নয়। খাঁটি মেয়েলি ব্রতে তিনটি ধারা লক্ষণীয়। যথা-ছড়া, আলপনা ও ব্রতকথা। ছড়া ও ব্রতকথা মৌখিক সাহিত্যের ধারা এবং আলপনা লোকশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ দিক।
বৈশিষ্ট্য:
- বাংলার ব্রতকথাগুলি বাংলারই বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবীদের অবলম্বন করে রচিত। ব্রতকথাগুলি দেবতাদেরই মাহাত্ম্যকথা।
- ব্রতকথার কাহিনিগুলিতে দুই ধরনের দেবতা লক্ষ করা যায়। যথা-শান্তশিষ্ট দেবতা ও রুষ্ট দেবতা।
- ব্রতকথা ভীষণভাবে নিয়তিনির্ভর। দেবতা কাকে কৃপা করবেন আর কাকে সর্বস্বান্ত করবেন, তা নিয়তিভিত্তিক।
- ব্রতকথার সব চরিত্রই বৈচিত্র্যহীন এবং একঘেয়ে।
- ব্রতকথার মধ্যে লোকায়ত সমাজের জীবনবোধের অভিব্যক্তির প্রকাশ লক্ষণীয়। ব্রতকথার মধ্যে পৌরাণিক দেবদেবীর আদলে বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনের পরিবেশটি প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে।
- গার্হস্থ্যের মঙ্গলসাধনই ব্রতকথাগুলির মূল উদ্দেশ্য।
ব্রতকথা-র উদ্দেশ্য: ব্রতকথা মূলত দেবতাদের মাহাত্ম্যকথা। বাংলার লৌকিক দেবতাদের অবলম্বন করেই এগুলি রচিত। প্রধানত মানবিক দোষ- গুণযুক্ত দেবদেবী বা অনিষ্টকারী দেবতাকে সন্তুষ্ট করে তাঁর কৃপালাভ এই ব্রতকথাগুলির মূল উদ্দেশ্য। এ ছাড়াও, দেবদেবীদের তুষ্ট করতে ভক্তমানুষের কী কী করণীয় এবং কী কী করা একেবারে নিষিদ্ধ; সেই নির্দেশও ব্রতকথা দেয়। বিশেষত, বিভিন্ন এলাকা ও জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বিশ্বাস ও ধর্মীয় আচারের বাতাবরণে এইগুলি রচিত। দেবতাদের মাহাত্ম্যকীর্তনের মধ্য দিয়ে গার্হস্থ্য মঙ্গলসাধনই ব্রতকথার উদ্দেশ্য।
৩। নীতিকথা কী? নীতিকথার বৈশিষ্ট্য লেখো।
নীতিকথা: নীতিকথা অর্থাৎ, উপদেশকথা। যেসকল কাহিনির শেষে নীতি বা উপদেশ পরোক্ষ পর্দার আবরণে ঢাকা না রেখে শ্রোতার কাছে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থাপন করা হয়, সেই কথাগুলিকে নীতিকথার অন্তর্ভুক্ত করা যায়। নীতিকথা-র দুটি প্রকার রয়েছে। যেমন-পশুপাখিকথার একটি শাখা হল নীতিকথা। পশুপাখিকথা বা Animal Tale-এর সঙ্গে যখন কোনো নীতি বা উপদেশ সংযুক্ত থাকে তাকেই বাংলায় নীতিকথা ও ইংরেজিতে Fable বলে। যেমন-সংস্কৃত সাহিত্যে পঞ্চতন্ত্র, ইংরেজিতে Aesop’s Tale ইত্যাদি।
আবার, রূপকথা, ব্রতকথা প্রভৃতি শাখায় যদি ধর্মগুরু, দেবতা, সন্ন্যাসী, দরবেশ, পির প্রমুখ লোকের উপদেশমূলক কাহিনি পাওয়া যায় সেগুলিকেও বাংলায় নীতিকথা ও ইংরেজিতে Anecdote বলা হয়। এই ধরনের কথায় উপদেশ দ্বারা নীতিশিক্ষা দেওয়া হয়, তাই এগুলি উপদেশ কথা।
বৈশিষ্ট্য: নীতিকথার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহ-
- নীতিকথায় বিশেষ তাৎপর্যবাহী কোনো নীতি বা উপদেশ সংযুক্ত থাকে।
- পশুপাখির গল্পে যদি নীতি বা উপদেশ দান করা হয় তখন তাকে Fable বলে। আবার, – ধর্মগুরু, সন্ন্যাসী, দেবতা, পির প্রমুখ উপদেশ বা নীতিশিক্ষা দিলে তাকে উপদেশকথা তথা Anecdote বলা হয়।
- নীতিকথার নীতি বা উপদেশ সোজাসুজি উপস্থিত করা হয় শ্রোতার কাছে। নীতিকথাগুলি বৃহত্তর জনমানসে নীতিশিক্ষা প্রচারের কাজে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ, কেবল চিত্তবিনোদন নয়, নীতিশিক্ষার একটি বৃহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে।
- নীতিকথাগুলি ধর্মোপদেশ প্রদানের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়।
৪। লোকপুরাণ কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
লোকপুরাণ: লোককথার একটি অন্যতম শাখা হল-পুরাণকথা। লোকপুরাণকে ইংরেজিতে বলা হয় Myth। সৃষ্টির অজ্ঞাত লীলারহস্য বর্ণনা করে যেসকল অলৌকিক বিবরণ রচিত হয়ে থাকে, ইংরেজিতে তাকে Myth বলা হয়। Myth হল মৌখিক ঐতিহ্যানুসারী, তাই একে মৌখিক শিল্পের আখ্যাও দেওয়া যেতে পারে। মিথের রচয়িতা এবং রচনাকাল সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। মিথ একক সৃষ্টি হলেও সমষ্টিগতভাবে এর বিনির্মাণ ঘটে। এর কাহিনি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল এবং সম্প্রসারণশীল। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য-র মতে, ‘Myth’-এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘লৌকিক পুরাণ’ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
তিনি ‘মিথ’-কে লোকসাহিত্যের মর্যাদা দেন। বাংলার পুরাণগুলি রচিত হয়েছে মূলত আর্য-প্রাগার্য সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের মিলনে। পুরাণকথাগুলি ক্ষেত্রবিশেষে আর্য-অনার্যের সংমিশ্রণে ও অতীত বিশ্বাসের কাহিনিকে প্রলম্বিত করেছে কিন্তু মিথ-এ ধর্মের বন্ধন নয়, বিশ্বাস এবং অতিবিশ্বাসের কাহিনিই প্রধান। মানবসৃষ্টি থেকে দেবদেবীর জন্ম, মানববিবর্তন, সনাতন ধর্মের আর্বিভাব, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল এবং অন্যান্য জীবের জন্ম, বিভিন্ন লোকাচার ও তার পালনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এইসব পুরাণকথার জন্ম।
বৈশিষ্ট্য: লোকপুরাণ বা মিথ-এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
- মিথ হল সৃষ্টি-কাহিনিমূলক লৌকিক আখ্যান। এর গল্পগুলি মানুষের কৌতূহলের কথিত রূপ।
- প্রাক্ বৈজ্ঞানিক যুগে মানুষের কল্পনাপ্রবণ মনের প্রকাশ লক্ষ করা যায় মিথ-এ। যেমন-এখানে নদী, পাহাড়, পশু ইত্যাদির জন্মের প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দেবতার জন্মব্যাখ্যাও এখানে থাকে।
- এখানে সাধারণত দেবদেবীর প্রসঙ্গ সরাসরি থাকে না, রূপকের আশ্রয় নিয়ে মানুষই দেবতার পর্যায়ে উন্নীত হয়।
- মূলত, অলৌকিক চরিত্রটি কাহিনির নায়ক-নায়িকা। মিথ-এর কাহিনি সম্প্রসারণশীল, পরিবর্জন ও পরিমার্জনযুক্ত এবং ভ্রাম্যমাণ।
৫। রোমাঞ্চকথা ও স্থানিক কথা কোগুলি ?
রোমাঞ্চকথা: রোমাঞ্চকথা একপ্রকার অধিক দৈর্ঘ্যের রূপকথা। যে গল্পকথাগুলির ঘটনাবলি রূপকথার মতোই অবিশ্বাস্য ও রোমাঞ্চকর হলেও ঘটনামূল এবং পাত্রপাত্রীর নাম ও চরিত্রগুলির সঙ্গে অনেকসময় ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্রসমূহের সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়, সেই দীর্ঘ কাহিনিকে রোমাঞ্চকথা বা Novella বলা হয়। রোমাঞ্চকথাগুলি বাস্তব স্থান ও নির্দিষ্ট ঘটনাকেন্দ্রিক হলেও এর আঙ্গিকটি অদ্ভুতই থাকে এবং তা লোকবিশ্বাসের সীমা অতিক্রম করে না। উদাহরণস্বরূপ, আরব্য উপন্যাস হল একটি রোমাঞ্চকথা এবং আরব্য উপন্যাসের বাদশা সোলেমান বা খলিফা হারুন-আল-রশিদ একজন ঐতিহাসিক চরিত্র। ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’-র রাজা বিক্রমাদিত্যও একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি। এদের নানান অবাস্তব গুণবর্ণনাই হল রোমাঞ্চকথা।
স্থানিক কথা: কোনো কোনো স্থানীয় ঘটনা, যা একদা সত্যিই ঘটেছিল বলে স্থানীয়রা বিশ্বাস করে এবং লোকের মুখে মুখে প্রচারের মাধ্যমে যা জনপ্রিয়তাও লাভ করে-সেই কাহিনিগুলিকে স্থানিককথা বলা হয়। ইংরেজিতে এই স্থানীয় কথাগুলি local legend, local tradition ইত্যাদি নামেও পরিচিত। পূর্ববঙ্গ গীতিকার ‘কমলাসুন্দরী’, ‘চৌধুরীর লড়াই’ প্রভৃতি পালায় স্থানিককথা-র বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।
৬। বীরকথা, রঙ্গকথা ও বোকাকথা-র পরিচয় দাও।
বীরকথা: কোনো কোনো লোকগল্পের একটিমাত্র অসীমসাহসী বীরচরিত্র সব রকমের অসাধ্য সাধন করে লোকচিত্ত জয় করে থাকে। গ্রিক সাহিত্যে হারকিউলিস, প্রমিথিউস থেকে আরব্য উপন্যাসের সিন্দবাদ সকলেই এরূপ বীর, নায়ক চরিত্র, এরূপ দুঃসাহসী অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন, অমানুষিক বলের অধিকারী, অসাধারণ কর্মক্ষম বীরচরিত্রকে অবলম্বন করে রচিত কাহিনিগুলিকে বীরকথা বলা হয়। আন্তর্জাতিক সাহিত্যে হারকিউলিস বা থিসিয়াসের গ্রিক কাহিনি অথবা ভারতীয় সাহিত্যে সংস্কৃত ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’-র বিক্রমাদিত্যের কাহিনি আবার বাংলায় রচিত রঘু ডাকাতের কাহিনি- বীরকথার অন্যতম দৃষ্টান্ত।
রঙ্গকথা: লোককথার শ্রেণিবিন্যাসে রঙ্গকথা এক বিশেষ প্রকার হিসেবে স্বীকৃত-যার মূল উপাদান হাসি, তামাশা, চুটকি বা রঙ্গরসিকতা। আন্তর্জাতিক সাহিত্যে যা Jest, Humorous Anecdots এবং Merry Tales বলে প্রচলিত। বোকা লোকদের নিয়ে বিদ্রূপাত্মক ছোটোগল্প, লোক-ঠকানোর ছোটো ছোটো কাহিনি এবং কখনো-কখনো বিশেষ কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্রের রঙ্গরসিকতা জাতীয় গল্প এই শ্রেণির লোকসাহিত্যের মূল উপজীব্য। রঙ্গকথাগুলি দৈর্ঘ্যে অত্যন্ত ছোটো হয়। জসীমউদ্দিনের ‘বাঙালীর হাসির গল্প’, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘টুনটুনির বই’, গোপাল ভাঁড়ের গল্প, পাজি পিটর, টেটন বুড়ো, খোজা নাসিরুদ্দিন, ঢাকার কুট্টিদের গল্প প্রভৃতি এই জাতীয় রঙ্গকথার উদাহরণ।
বোকাকথা: লোককথা-র মধ্যে রঙ্গকথারই একটি প্রকার হল- বোকাকথা। ইংরেজিতে এই গল্পগুলিকে Numskull tale-ও বলা হয়ে থাকে। বোকা লোকেদের নিয়ে বিদ্রুপ, লোক ঠকানোর অশ্লীল কাহিনিকে বোকাকথা বলা হয়। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প জনপ্রিয় বোকাকথার উদাহরণ।
৭। Anecdote কী? পশুকথা-ই কি উপকথা-আলোচনা করো।
Anecdote বা উপদেশকথা: লোককথার বিভিন্ন শাখা যেমন- রূপকথা, ব্রতকথা ইত্যাদিতে পশুপাখি ব্যতীত অন্য কেউ তথা ধর্মগুরু দেবতা, নবি, সন্ন্যাসী, দরবেশ, পির প্রভৃতি লোকের উপদেশমূলক কাহিনিপ্রাপ্ত হয়, যা থেকে মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষালাভ করতে পারে; সেইসকল কাহিনিকে উপদেশকথা বা Anecdote বলা হয়।
পশুকথা-ই উপকথা কি না: যেসব গল্পগাথায় জীবজন্তু, পশুপাখিই প্রধান, সেইসকল গল্পকথাকে ‘পশুকথা’ বলা হয়। আবার, যেসব গল্পে বিভিন্ন প্রাণী, উদ্ভিদ, জড়বস্তু এবং প্রাকৃতিক উপাদানকে মানবিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়। অর্থাৎ, যা কিছু মনুষ্য নয় অথচ মানুষের মতো হাঁটে-চলে- কথা বলে সেই প্রকারের গল্পগুলিকে উপকথা বলা হয়। সুতরাং, উপকথা আর পশুকথার বিষয়বস্তু প্রায় একই।
অন্যান্য মতানুসারে, ‘Animal Tale’ যেহেতু আকারে ক্ষুদ্র হয় তাই ‘উপ’-কে ‘ক্ষুদ্র অর্থে’ উপসর্গ হিসেবে গ্রহণ করে ‘উপকথা’ নামকরণ করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। তাই মনুষ্যেতর প্রাণীদের নিয়ে প্রচলিত গাথাগুলিকেই উপকথা বা পশুকথা বলে।
৮। লোককথার কয়েকটি প্রকরণ – Novella-Marchen, Nature Saga, Enigma, শিকলি গল্প-এগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
Novella-Marchen: রূপকথা হল কাল্পনিক চরিত্রদের নিয়ে অকল্পনীয় কাহিনি। এই অকল্পনীয় কাহিনির চরিত্রেরা যখন বাস্তব বা ঐতিহাসিক চরিত্র হয় তখন এই রূপকথাগুলিই রোমাঞ্চকথার অন্তর্ভুক্ত হয়। আর, এই সূক্ষ্ম পৃথকীকরণ যখন সম্ভব হয় না অর্থাৎ, রোমাঞ্চকথা এবং রূপকথার মধ্যে সীমারেখা নির্ণয় করা কঠিন হলে, তখন তাকে Novella- Marchen বা রোমাঞ্চ-রূপকথা বলা হয়। বাংলা লোককাহিনিতে এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে। বাংলার ‘সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল’ রূপকথা ও রোমাঞ্চকথার মিশ্ররূপ তথা একটি Novella-Marchen
Nature-Saga: Nature Saga-ও এক প্রকারের লোককাহিনি। কোনো বিশেষ বৃক্ষ, তারকামণ্ডল, এই বিশ্বব্র্যান্ড কেন এবং কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল অথবা বাঘের গায়ে ডোরাকাটা দাগ কীভাবে এল বা কুটুম পাখির গায়ের রং হলুদ কেন-এই ধরনের কারণ বর্ণনা করা হয় যেসব গল্পে সেগুলিকেই আঞ্চলিক ‘সৃষ্টিকথা’ বা Nature Saga বলে।
Enigma: লোককথায়, বুদ্ধিপরীক্ষার জন্য এক ধরনের গল্প পরিলক্ষিত হয়। এই গল্পগুলিকেই ‘ধাঁধামূলক গল্প’-এর আখ্যা দেওয়া হয়, সেগুলিকে ইংরেজিতে Enigma বলে।
শিকলি গল্প: যেসকল গল্পে একটির পর একটি ঘটনা ছড়ার আকারে আবর্তিত হতে থাকে, তাকে ‘শিকলি গল্প’ বা ‘Chain Tale বলা হয়। যেমন- ‘টুনটুনি আর নাপিতের কথা’ গল্পে—
হাতি বলে, সাগর শুষি!
সাগর বলে, আগুন নেবাই।
আগুন বলে, লাঠি পোড়াই!
লাঠি বলে, বিড়াল ঠেঙাই।… ইত্যাদি শিকলি গল্পের দৃষ্টান্ত।
৯। লোককথার অতিপ্রাচীন একটি ভারতীয় সংকলনের নাম লেখো ও তার রচয়িতা কে? বাংলা রূপকথার প্রথম সংগ্রাহক ও তাঁর উত্তরসূরি কে?
ভারতীয় লোককথা সংকলন: ‘পঞ্চতন্ত্র’ হল সংস্কৃত ভাষায় রচিত একটি অতিপ্রাচীন লোককথাসংকলন। এই গ্রন্থটি নানা উপদেশমূলক গল্পের সংকলন। পাঁচটি তন্ত্রে বিভক্ত বলেই এর নাম হয়েছে ‘পঞ্চতন্ত্র’। ‘বন্ধুবিচ্ছেদ’, ‘বন্ধুলাভ’, ‘চিরশত্রুতা, ‘পেয়ে হারানো’, ‘হঠকারিতা’-হল পঞ্চতন্ত্রের পাঁচটি তন্ত্রের অনুবাদিত নাম।
রচয়িতা: ‘পঞ্চতন্ত্র’-এর রচয়িতা হলেন-বিষু শর্মা।
রূপকথার সংগ্রাহক: বাংলা রূপকথার প্রথম সংগ্রাহক হলেন লালবিহারী দে। তিনি ১৮৭৫ সালে Folk Tales of Bengal নামে বাংলা রূপকথার একটি ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন।
উত্তরসূরি: লালবিহারী দে মহাশয়ের উত্তরসূরি মনে করা হয় দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারকে, যিনি বাংলার বিভিন্ন রূপকথা সংগ্রহ করে ‘ঠাকুরদাদার ও ঝুলি’ এবং ‘ঠাকু’মার ঝুলি’ নামে দুটি খণ্ডে প্রকাশ করেন। বই দুটি পরবর্তীতে বিপুল খ্যাতি অর্জন করে।
১০। সর্বপ্রাণবাদ বা Animism কী?
সর্বপ্রাণবাদ: আদিম মানুষেরা বিশ্বাস করত যে, সব কিছুর মধ্যেই প্রাণ আছে-এই ধারণা থেকেই সর্বপ্রাণবাদের জন্ম। লাতিন শব্দ ‘Anima’ থেকে Animism শব্দটি এসেছে। ‘Anima’ শব্দের অর্থ Soul বা আত্মা আর এই আত্মাই হল ধর্ম। উপনিষদে আছে যে আত্মার মৃত্যু নেই, আত্মার ধ্বংস নেই-আত্মা এক দেহ থেকে অন্য দেহে স্থানান্তরিত হয় মাত্র। কোনো পোশাক পুরোনো হয়ে গেলে যেমন আমরা তাকে ত্যাগ করি, আত্মাও তেমনই একটি মানুষের দেহ ত্যাগ করে অন্য দেহে স্থানান্তরিত হয় এবং নবজন্ম লাভ করে।
আদিম মানুষের বিশ্বাস যে শুধু মানুষ নয়, সমস্ত প্রাণীর এবং বৃক্ষ-লতা নদনদী, সমুদ্র, পর্বত প্রভৃতি সব কিছুর মধ্যেই আত্মা থাকতে পারে। আর প্রকৃতির মধ্যে আত্মার অনুপ্রবেশ ঘটলে প্রকৃতি বিশেষ শক্তিসম্পন্ন হয়ে ওঠে। এই বোধ থেকেই মানুষের মনে যে ধর্মভাবনা এসেছে, তাকে E B Tybor- ‘সর্বপ্রাণবাদ’ বা ‘অ্যানিমিজম’ বলে অভিহিত করেছেন।
মূলত, এই সর্বপ্রাণবাদ-এর ধারণা থাকার জন্যই রূপকথা পশুকথা ইত্যাদি লোককথায় পশুপাখি, গাছ পর্বত এসব প্রাণী বা অপ্রাণীদের হেঁটে- চলে বেড়াতে বা মানুষের মতো আচরণ করতে, কথা বলতে দেখা যায়।
১১। ঠাকুমার ঝুলি কি নিছকই শিশুসাহিত্য-তোমার অভিমত ব্যক্ত করো।
প্রকাশকাল ও লেখকবৃত্তান্ত: যুবক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, বিশ শতকের গোড়ার দিকে লোককথা সংগ্রহের এক অভিনব উদ্যোগ নেন। তিনি পল্লিগ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে অগ্রজদের মুখনিঃসৃত গল্প শুনে ফোনোগ্রাফের মোম রেকর্ডে সেগুলিকে লিপিবদ্ধ করেন। অবশেষে, ১৯০৭ সালে নীল মলাটে মোড়া রূপকথার বইটি প্রকাশিত হয়, নাম- ‘ঠাকু’মার ঝুলি’। বইটির ভূমিকা রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সংকলনটির গল্পগুলি
মোট চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত ছিল- দুধের সাগর, রূপ তরাসী, চ্যাঙ ব্যাঙ, আম সন্দেশ। চারটি অধ্যায় মিলিয়ে মোট সতেরোটি গল্পের সমাহার এই বইটি।
আপাত-উদ্দেশ্য: দক্ষিণারঞ্জন যখন একটি লোককথা সংকলন প্রকাশ করার কথা ভাবেন তখন শিশুপাঠ্য রূপকথার বই বলতে ছিল কেবল ইউরোপীয় রূপকথা এবং সেগুলির অনুবাদ। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর বাংলার মানুষেরা এক নতুন জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। কার্যত, এই চেতনারই ফসল ‘ঠাকু’মার ঝুলি’। প্রায় ভুলতে বসা বাংলার লোককাহিনিগুলিকে পুনরুদ্ধার করে সংগ্রহ ও সংকলিত করাই ছিল এই বই তৈরির উদ্দেশ্য, যা বাংলার মানুষকে তাদের সমৃদ্ধ মৌখিক ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দেবে আর এটিই হবে ব্রিটিশদের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি লড়াই। এই প্রাথমিক উদ্দেশ্য ধারণ করে এবং শিশুদের গল্প শোনার সঙ্গী হয়ে উঠতে, ইউরোপীয় রূপকথাকে দেশীয় রূপকথা দ্বারা প্রতিস্থাপন করতেই আপাতভাবে ‘ঠাকু’মার ঝুলি’-র প্রকাশ বলে মনে করা হয়।
নিছকই শিশুসাহিত্য নাকি সমাজের প্রতিচ্ছবি: ‘ঠাকু’মার ঝুলি’-র ভূমিকা অংশে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “দক্ষিণাবাবুকে ধন্য। তিনি ঠাকুরমা’র – মুখের কথাকে ছাপার অক্ষরে তুলিয়া পুঁতিয়াছেন তবু তাহার পাতাগুলি প্রায় তেমনি সবুজ, তেমনি তাজাই রহিয়াছে, রূপকথার সেই বিশেষ ভাষা বিশেষ রীতি, তাহার সেই প্রাচীন সরলতাটুকু তিনি যে এতটা দূর রক্ষা করিতে পারিয়াছেন, ইহাতে তাহার সূক্ষ্ম রসবোধ ও স্বাভাবিক কলানৈপুণ্য প্রকাশ পাইয়াছে।” অর্থাৎ, ঠাকুরমার মুখের গল্পের প্রত্যক্ষ শ্রোতা ছিল শিশুরাই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য অনুযায়ী এ কথাও সত্য যে, “বাঙ্গালীর ছেলে যখন রূপকথা শোনে তখন কেবল যে গল্প শুনিয়া সুখী হয় তাহা নহে-সমস্ত বাংলাদেশের চিরন্তন স্নেহের সুরটি তাহার তরুণ চিত্তের মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাহাকে যেন বাংলার রসে রসাইয়া লয়।” সুতরাং বাংলার লোককথাগুলির মধ্যে যে বাংলার সমাজের ছবিও থাকবে-এ কথা বলাই বাহুল্য। তাই ঠাকুরমার ঝুলির গল্পগুলিও ছিল সেইরূপ।
‘ঠাকু’মার ঝুলি’-র প্রথম গল্প ‘কলাবতী রাজকন্যা’-তে দেখা যায়, রাজার সাত রানি, কারোরই ছেলেপুলে নেই, সেই নিয়ে তাঁরা চিন্তিত। প্রথমেই লক্ষণীয় যে, সন্তানহীনতা কোনো শিশুসমস্যা নয় এটি বড়োদের একটি গুরুতর সমস্যা। এরপর সন্ন্যাসী তাদেরকে শিকড় দিয়ে বলেন যে, সেটি বেটে খেলে ‘সোনার চাঁদ ছেলে’ হবে। সমাজের পুত্রসন্তানের প্রতি ঝোঁকটিও এখান থেকে স্পষ্ট। আবার, গল্পের শেষে রাজা যখন তাঁর নিজের পাঁচ দুষ্ট রাজপুত্রকে কাঁটা দিয়ে পুঁতে ফেলেন তখন পিতার এরূপ কর্মও শিশু তথা কারোর কাছেই কল্পনীয় হয় না কেবল বুদ্ধ-ভুতুম অলৌকিকতা ও তাদের অভাবনীয় কার্যকলাপের জোরেই গল্পটি শিশুপাঠ্য রূপকথায় উত্তীর্ণ হয়। পিতার পুত্রনিধনের নির্মম কাজটিকেও নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া যায়।
‘ঠাকু’মার ঝুলি’-তে নারীবিদ্বেষী মনোভাব খুবই স্পষ্ট। ‘শীত বসন্ত’ গল্পে সুয়োরানির উক্তি “শীত বসন্তের রক্ত নহিলে আমি নাইব না”-এই বীভৎসতা শিশুমনের উপযোগী নয় তবে এই দুষ্টচিন্তার অধিকারিণী সুয়োরানি গল্পের শেষে শাস্তি পাবে-এটুকুতেই শিশুমন তৃপ্ত হয়। তবে গল্পগুলি কখনোই আদ্যন্ত নীতিশিক্ষামূলক হয়ে উঠতে পারে না।
নারীবিদ্বেষের আরও প্রত্যক্ষ উদাহরণ পাওয়া যায় যখন লক্ষ করা যায় যে, ঠাকুমার ঝুলিতে কেবল রাক্ষসী আছে রাক্ষস নেই। ‘রূপ তরাসী’ অংশের গল্পে পাওয়া যায়, “…এক রাজার দুই রাণী; তাহার এক রাণী যে রাক্ষসী। কিন্তু এ কথা কেহই জানে না।” এই রাক্ষসী চরিত্রগুলি সমাজের নারীবিদ্বেষের দৃষ্টান্ত বহন করে। ‘ঠাকু’মার ঝুলি’-তে বর্ণিত রাক্ষসীরা সংসারী, তারা সমাজের উচ্চবর্গের মানুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় সন্তানের জন্ম দেয় এবং রাক্ষসী রানির পুত্রসন্তানের হাতেই শেষপর্যন্ত মা রাক্ষসীর মৃত্যু ঘটে। এভাবেই পুরুষের দ্বারা নারীর নিয়তি নির্ণীত হয়।
প্রকৃতপক্ষে, পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষা দুষ্ট রমণীর শায়েস্তা নারীবিদ্বেষ পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব এগুলি সমাজের মধ্যেই প্রোথিত ছিল আর লোককথা কখনোই সমাজ ব্যতীত তৈরি হতে পারে না। তাই দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার সেই লোককথাগুলিকে পরিমার্জন না করে স্বরূপেই সেগুলিকে সংকলিত করেছেন। তাই সংগ্রাহকরূপে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। অলৌকিক চরিত্রসমূহ ও কাল্পনিক ঘটনাবলির দ্বারা তা শিশুদের মনোগ্রাহী হয়ে ওঠে এবং শিশুসাহিত্যের বেশে ‘ঠাকু’মার ঝুলি’ আদতে সমাজের স্বরূপকেও বহন করে নিয়ে চলে। এ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর মতটিকে প্রাধান্য দেওয়া যায়। তাঁর মতে, “অনেক সময় বোঝা যায় যে লেখক যদিও মুখ্যত বা নামত ছোটোদের জন্য লিখেছেন, তবু সাবালক, নাবালক পাঠকও তার লক্ষ্যের বহির্ভূত ছিল না।”
আরও পড়ুন | Link |
ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
তেলেনাপোতা আবিষ্কার বড় প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
আগুন নাটকের প্রশ্ন উত্তর | Click Here |