নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর Class 11 Second Semester WBCHSE

Table of Contents

নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর

নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর
নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর

১। ‘নৈতিক’ বলতে কী বোঝায়? মানুষের কোন্ ধরনের ক্রিয়াগুলি নৈতিক ক্লিয়ার অন্তর্ভুক্ত?

নৈতিক কথার অর্থ

নীতিবিদ্যায় ‘নৈতিক’ শব্দটি গুণ বা বিশেষণকে বোঝায়। সাধারণত মানুষের আচরণ বা ক্রিয়ার বিশেষণ যেমন- ‘ভালো’, ‘মন্দ’ ইত্যাদি নৈতিক বিচারের বিষয় হয়।

(1) ‘নৈতিক’ শব্দটির ব্যাপকতর অর্থ: ব্যাপকতর অর্থে ‘নৈতিক’ বলতে যেমন ভালোকে বোঝায়, তেমনি মন্দকেও বোঝায়। অর্থাৎ ভালো ও মন্দ -এই দুটিই হল নৈতিক গুণ। ‘সত্য কথা বলা ভালো’ -এটি যেমন নৈতিক ক্রিয়াকে নির্দেশ করছে, তেমনি ‘মিথ্যা কথা বলা খারাপ’ -এটিও নৈতিক ক্রিয়াকে নির্দেশ করছে। অর্থাৎ ব্যাপকতর অর্থে নীতিবিদ্যায় নৈতিক শব্দটির দ্বারা নীতিসম্মত এবং নীতিগর্হিত এই উভয় প্রকার ক্রিয়াকেই বোঝানো হয়।

(2) ‘নৈতিক’ শব্দটির সংকীর্ণতর অর্থ: সংকীর্ণতর অর্থে নৈতিক শব্দের দ্বারা যে ক্রিয়া বা আচরণ কেবল ভালো বা ঠিক, তাকেই বোঝায়। সেক্ষেত্রে ‘নৈতিক’ শব্দটি অন্যায় বা ‘Immoral’ শব্দের বিরুদ্ধ শব্দ। কেন-না ‘অন্যায়’ বা ‘Immoral’ বলতে সেই ক্রিয়াকে বোঝায় যে ক্রিয়া নৈতিক দিক থেকে মন্দ ও ভুল। সংকীর্ণ অর্থে ‘সত্য কথা বলা ভালো’ নৈতিক ক্রিয়া হলেও ‘মিথ্যা কথা বলা খারাপ’ নৈতিক ক্রিয়া নয়। নীতিবিজ্ঞানে ‘নৈতিক’ শব্দটিকে ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহার করা হয়। ‘নৈতিক’ বলতে ভালো ও মন্দ উভয়কেই বোঝায়।

স্বেচ্ছাকৃত ক্রিয়া হল নৈতিক ক্রিয়া

নীতিবিদ্যা এক আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান, যা সমাজে বসবাসকারী মানুষের স্বেচ্ছাকৃত ক্রিয়ার মূল্যায়ন করে। মানুষের এই স্বেচ্ছাকৃত বা ঐচ্ছিক ক্রিয়াই হল নৈতিক ক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত।

মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সচেতনভাবে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য যে ক্রিয়া সম্পাদন করে সেই ক্রিয়াই হল স্বেচ্ছাকৃত ক্রিয়া। স্বেচ্ছাকৃত ক্রিয়া সম্পাদন করার ক্ষেত্রে মানুষ সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন, কেন-না এই ক্রিয়ায় কোনোরূপ বাধ্যবাধকতা থাকে না। অর্থাৎ এই ক্রিয়া মানুষ যেমন করতে পারে তেমনি নাও করতে পারে। যেমন- কোনো ব্যক্তি গান গাইতে পারে আবার নাও গাইতে পারে। ‘গান গাওয়া’ তাই স্বেচ্ছাকৃত ক্রিয়া।

যেহেতু স্বেচ্ছাকৃত ক্রিয়ার ক্ষেত্রে মানুষের যেমন ‘করতে পারার’ স্বাধীনতা থাকে আবার ‘না করতে পারার’ স্বাধীনতাও থাকে, সেহেতু ওই ক্রিয়ার দায়ভার মানুষকে নিজেকেই বহন করতে হয়। আর যে ক্রিয়ার দায়ভার মানুষ নিজেই বহন করে সেই ক্রিয়াকে যেমন ভালো, উচিত, ন্যায় ইত্যাদি নীতিসম্মত নৈতিক বিশেষণে বিশেষিত করা যায় তেমনি মন্দ, অনুচিত, অন্যায় ইত্যাদি নীতিগর্হিত নৈতিক বিশেষণেও বিশেষিত করা যায়। যেমন- ‘অসহায়কে সাহায্য করা’ ক্রিয়াটিকে ভালো বলা হয়। আবার ‘অন্যের ক্ষতি করা’ কাজটিকে মন্দ বলে বিবেচিত করা হয়। সুতরাং মানুষের স্বেচ্ছাকৃত ক্রিয়াকেই নৈতিক বিশেষণে বিশেষিত করা যায়। মানুষের যে ক্রিয়া স্বেচ্ছাকৃত নয়, যে ক্রিয়ার ক্ষেত্রে মানুষের কোনো স্বাধীনতা থাকে না সেই ক্রিয়াকে নৈতিক বিশেষণে বিশেষিত করা যায় না। তাই মানুষের স্বেচ্ছাকৃত ক্রিয়াই কেবল নৈতিক ক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত।

২। অনৈতিক ক্রিয়া কাকে বলে? বিভিন্ন প্রকার অনৈতিক ক্রিয়ার উদাহরণ দাও।

অনৈতিক ক্রিয়া

যে ক্রিয়ার উপর আমাদের ইচ্ছার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না, যে ক্রিয়াকে ভালো বা মন্দ কিছুই বলা যায় না, সেই ক্রিয়া হল অনৈতিক বা নীতি বর্হিভূত ক্রিয়া। যেমন- যখন বন্যা হয়, মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীর অনেক ক্ষতি হয়, বাড়ি-ঘর নষ্ট হয়ে যায়, প্রাণহানি ঘটে, শস্যক্ষেত্র জলে প্লাবিত হয়, কিন্তু তাও এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের উপর কোনো নৈতিক গুণ আরোপ করা যায় না।

বিভিন্ন প্রকার অনৈতিক ক্রিয়া

বিভিন্ন প্রকার অনৈতিক ক্রিয়া সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল-

(1) প্রতিবর্ষ ক্রিয়া (Reflex Action): ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে কোনো বাইরের উদ্দীপক দেহের উপর কাজ করার ফলে দেহে যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয় তাকে প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে। যেমন- গরম কেটলিতে হাত লাগা মাত্র আমি হাত সরিয়ে ফেললাম। ফলে কেটলিটি হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল। এই কাজটিকে নৈতিক বলা যায় না। এই ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছার কোনো স্বাধীনতা থাকে না। তাই এই ক্রিয়াটি অনৈতিক ক্রিয়া।

(2) সহজাত প্রবৃত্তিমূলক ক্রিয়া (Instinctive Action): আগে থেকে কোনো সংকল্প না করে, উদ্দেশ্য ও ফলাফল সম্পর্কে অচেতন থেকে প্রত্যকটি জীব আত্মরক্ষা বা বংশরক্ষামূলক যে জটিল কার্য বংশপরম্পরায় একই ধাঁচে করে থাকে, তাকে বলা হয় সহজাত প্রবৃত্তিমূলক ক্রিয়া বা সাহজিক ক্রিয়া। যেমন- প্রতিটি প্রাণী সহজাত প্রবৃত্তিবশে শাবক প্রতিপালন করে, আত্মরক্ষার জন্য অন্য প্রাণীকে আক্রমণ করে। এই ক্রিয়াগুলি অনৈতিক ক্রিয়া।

(3) স্বতঃসঞ্জাত ক্রিয়া (Spontaneous Action): বাইরের কোনো উদ্দীপনা ছাড়া দেহের অভ্যন্তরে যে শক্তি সঞ্চিত থাকে, সেই শক্তির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের ফলে যে ক্রিয়ার উৎপত্তি হয়, তাকে স্বতঃসজ্ঞাত ক্রিয়া বলে। হাত-পা নাড়াচাড়া করে ব্যায়াম করা-এইরূপ ক্রিয়ার ফলে শরীর সুস্থ থাকে। কিন্তু শিশু যখন হাত-পা ছুঁড়ে খেলা করে তখন এটি তার শরীরের পক্ষে ভালো ব্যায়াম এ কথা ভেবে হাত-পা ছোঁড়ে না। তাই শিশুটির এই ক্রিয়াটি অনৈতিক ক্রিয়া।

(4) ভাবজ ক্রিয়া (Ideo-motor Action): যখন কোনো ভাবনা বা ধারণা ক্রিয়ায় পরিণত হয়, অথচ সেই ক্রিয়ার মূলে ইচ্ছার সহযোগিতা থাকে না, তখন তাকে ভাবজ ক্রিয়া বলে। যেমন- কোনো শিক্ষক যখন ছাত্রের কাছ থেকে তার কলমটি চেয়ে নিয়ে লেখার পর ‘নিজের কলম’ ভেবে নিজের কাছে রেখে দেন তখন তার এই আচরণ ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়। তাই এটি অনৈতিক ক্রিয়া।

(5) অনুকরণমূলক ক্রিয়া (Imitative Action): আমরা কখনো-কখনো আমাদের অজ্ঞাতসারে অর্থাৎ কিছুটা অচেতনভাবে অপরের কোনো আচরণকে অনুকরণ করে ফেলি। অনুকরণমূলক ক্রিয়া কখনো-কখনো তাই অনৈচ্ছিক হয়। যেমন- মনুষ্যেতর প্রাণী বা শিশু এ ধরনের অনুকরণমূলক ক্রিয়া করে থাকে। যেমন- তোতা পাখি যা শোনে, মানে না বুঝেই তা আওড়ায়। এইরূপ অনুকরণমূলক ক্রিয়া অনৈতিক।

(6) আকস্মিক ক্রিয়া (Accidental Action): অনিচ্ছা সত্ত্বেও বা আকস্মিকভাবে কোনো ক্রিয়া যদি ঘটে যায়, তাহলে ওই ক্রিয়া সম্পাদনের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো নৈতিক দায়বদ্ধতা থাকে না। যেমন- হঠাৎ হাত থেকে পড়ে যদি আমার দামি মোবাইল ভেঙে যায় তাহলে সেটি আকস্মিক হওয়ায় ক্রিয়াটি অনৈতিক ক্রিয়া।

(7) উন্মাদ ব্যক্তির আচরণ (Actions of Insane person): মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ বা ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তির আচরণ ইচ্ছাকৃত নয়। কারণ কোনো বিচারবোধ দ্বারা চালিত হয়ে তারা কাজ করে না। ইচ্ছাকৃত না হওয়ায় এবং বিচারবোধ বিযুক্ত হওয়ায় এই ধরনের ব্যক্তির আচরণকে ভালো-মন্দ ইত্যাদি বলা যায় না। এই জাতীয় কাজকে তাই অনৈতিক বা নীতিবহির্ভূত বলা হয়।

৩। নৈতিক ক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরগুলি উদাহরণ-সহ আলোচনা করো।

নৈতিক ক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর

বিভিন্ন প্রকার নৈতিক কর্মকে বিশ্লেষণ করলে নৈতিক ক্রিয়ার তিনটি স্তর লক্ষ করা যায়। সেই স্তরগুলি হল- (a) মানসিক স্তর,(b) দৈহিক স্তর এবং (c) বাহ্যিক স্তর বা দেহাতিরিক্ত স্তর।

(1) মানসিক স্তর : নীতিবিজ্ঞানীদের মতে, নৈতিক ক্রিয়া সম্পাদনের মূল উদ্যোগটি নিহিত আছে মানসিক স্তরে (Mental Stage) অর্থাৎ কর্মকর্তার কর্ম সম্পাদনের ইচ্ছার মধ্যে। এই স্তরকে বিশ্লেষণ করলে এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপস্তরের সন্ধান পাওয়া যায়। সেগুলি হল-

  • অভাববোধ (Feeling of Want): প্রতিটি মানসিক ক্রিয়ার মূলে থাকে অভাববোধ, প্রয়োজনবোধ বা অসম্পূর্ণতাবোধ। এটি একপ্রকার অস্বস্তিবোধের অনুভূতি সৃষ্টি করে। এই অভাববোধ কাল্পনিক হতে পারে। আবার বর্তমানের না হয়ে ভবিষ্যতেরও হতে পারে। যেমন- ‘পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য একটি বই আমার এখনই দরকার’- এই ধরনের অভাববোধ হল বাস্তব বা বর্তমানের। আর যখন বলি, ‘আগামী বার্ষিক পরীক্ষার জন্য বইটি আমার দরকার’ তখন সেই অভাববোধকে বলে ভবিষ্যতের বা কাল্পনিক অভাববোধ।
  • লক্ষ্য সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা (The End and the Motive): মনে অভাববোধ দেখা দিলে বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তি তার অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চিন্তা করতে থাকে বা অনুমান করতে থাকে, ঠিক কী ধরনের বস্তু তার এই অভাববোধ দূর করার পক্ষে উপযুক্ত হবে। এইরূপ চিন্তা- ভাবনা আমাদের ক্রিয়ার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। যেমন- আমাদের যখন খিদে পায় আমরা তখন খাবারের কথা চিন্তা করি এবং এই খাবারের ধারণাই আমাদের খাদ্য সংগ্রহে প্রবৃত্ত করে।
  • কামনা (Desire): অভাববোধ থেকে যে অস্বাচ্ছন্দ্যবোধের উদ্রেক হয় এবং যে বস্তু ওই অভাববোধকে দূর করতে পারে, সেই বস্তুর চিন্তা মিলিতভাবে যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি করে, সেটিকে কামনার স্তর বলা হয়। এই স্তরে কাম্যবস্তুকে লাভ করার জন্য এক ধরনের আকাঙ্ক্ষা লক্ষ করা যায়।
  • কামনার বিরোধ (Conflict of Motives): অনেক সময় মনের মধ্যে একাধিক কামনার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই কামনাগুলির পরিতৃপ্তি একই সময়ে সম্ভব হয় না। একটিকে লাভ করতে হলে অপরগুলিকে বাতিল করতে হয় বা সাময়িকভাবে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়। এইসব ইচ্ছেগুলি কখনো- কখনো পারস্পরিক অসংগতিপূর্ণ হয়। ফলে একটির পরিতৃপ্তি হলে অপরটির পরিতৃপ্তিকে প্রায় অসম্ভব করে তোলে। তখন বিভিন্ন কামনার মধ্যে নির্বাচনের প্রশ্ন দেখা দেয়।
  • নির্বাচন ও সিদধান্তগ্রহণ (Decision and Determination): এরপর মন একটি কর্মপন্থাকে নির্বাচন করে ও অন্যগুলিকে বর্জন করে। এই নির্বাচিত কর্মপন্থা যা তাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে সেটি হল উপায়। আর লক্ষ্যটি হল উদ্দেশ্য। অভিপ্রায় হল উদ্দেশ্য, উপায় ও ফলাফলের সম্মিলিত রূপ।

(2) দৈহিক স্তর (Organic or Bodily stage): নির্বাচিত কামনাকে কার্যে রূপান্তরিত করার জন্য দেহযন্ত্র ও পেশিগুলি সচল হয়ে ওঠে। এসব ক্রিয়াকে নৈতিক ক্রিয়ার দৈহিক স্তর বলে। যেমন- কোনো বইকে কাম্য বলে মনে করলে তাকে অর্জন করার জন্য দোকানে যেতে হবে। ফলস্বরূপ দেহযন্ত্র ও পেশিগুলি সচল হয়ে উঠবে।

(3) বাহ্যিক বা দেহাতিরিন্দ্র স্তর (External Stage): কাম্যবস্তুকে লাভ করার জন্য অঙ্গ সঞ্চালন করলে বাহ্যজগতে যেমন কিছু পরিবর্তন ঘটে, তেমনি ঐ কর্ম সম্পাদনের ফলে এক ধরনের তৃপ্তি বা সুখানুভূতি ব্যক্তিমনে উৎপন্ন হয়।

৪। কামনার উপাদানগুলি উল্লেখ করো।

কামনার উপাদান

কামনা হল এমন এক অতৃপ্ত ও জটিল মানসিক ব্যাকুলতা, যাকে না পেলে ব্যক্তির মনে এক ধরনের অস্বস্তিবোধ সৃষ্টি হয় এবং ব্যক্তি ঐ অস্বস্তিবোধ থেকে মুক্তি লাভের জন্য লক্ষ্যবস্তুটি পেতে চায়। কামনাকে বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত তিনটি উপাদান পাওয়া যায়-

(1) জ্ঞানাত্মক উপাদান (Cognitive Element): যে উপাদানগুলির উপস্থিতিতে ব্যক্তির মধ্যে কামনা সম্পর্কে জ্ঞান বা ধারণা উৎপন্ন হয়, – সেগুলিকে কামনার জ্ঞানাত্মক উপাদান বলে। জ্ঞানাত্মক উপাদানগুলি হল – 

  • অভাববোধ বা চাহিদার অনুভূতি সম্পর্কে ধারণা।
  • চাহিদার অনুভূতিকে বিলুপ্ত করতে পারে এমন বস্তু তথা লক্ষ্যবস্তু বা কাম্যবস্তু সম্পর্কে ধারণা।
  • যে উপায়ে লক্ষ্যবস্তুটি লাভ করা যায়, সেই উপায় সম্পর্কে ধারণা।
  • লক্ষ্যবস্তু লাভের পর যে সুখানুভূতি হবে, সেই সম্পর্কে ধারণা।
  • এক্ষেত্রে ‘কামনা’ বলতে সুখ ও দুঃখ মিশ্রিত কোনো বস্তুর চেতনাকেই বোঝায় না, বরং কোনো বস্তুকে ভালো হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়াকে বোঝায়।

(2) আবেগপূর্ণ উপাদাল (Affective Element): যে উপাদানগুলির উপস্থিতিতে ব্যক্তির মনে সুখ ও দুঃখের অনুভূতি জাগ্রত হয়, সেগুলিকে কামনার আবেগমূলক বা আবেগপূর্ণ উপাদান বলে। আবেগমূলক উপাদানগুলি হল-

  • অভাববোধ অর্থাৎ লক্ষ্যবস্তুটি লাভ করতে না পারলে ব্যক্তির মনে একপ্রকার দুঃখানুভূতির সৃষ্টি হয়।
  • লক্ষ্যবস্তুটি লাভ করলে ভবিষ্যতের তৃপ্তিলাভ সম্পর্কে ব্যক্তির মনে > একপ্রকার সুখানুভূতির সৃষ্টি হয়।

(3) কর্ম-প্রবৃত্তিমূলক উপাদান (Conative Element): যেসব উপাদানের উপস্থিতিতে ব্যক্তির মধ্যে একপ্রকার কর্ম করার প্রবৃত্তি জাগ্রত হয়, সেগুলিকে কামনার কর্ম-প্রবৃত্তিমূলক উপাদান বলে। কর্ম-প্রবৃত্তিমূলক উপাদানগুলি হল-

  • লক্ষ্যবস্তু লাভ করার জন্য কর্মকর্তা বিভিন্ন প্রকার কর্ম করে থাকে।
  • কর্মের মাধ্যমে কর্মকর্তা কিছু প্রবৃত্তি প্রকাশ করে।
  • যতক্ষণ না পর্যন্ত কর্মকর্তার লক্ষ্যবস্তুর প্রাপ্তি ঘটছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে কর্মের মধ্য দিয়ে প্রবৃত্তির প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে।

ঐচ্ছিক ক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরিভাবে যুক্ত থাকায় কামনার উপরোক্ত তিনটি উপাদানের মধ্যে তৃতীয় তথা কর্ম-প্রবৃত্তিমূলক উপাদানটি সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ।

৫। উদাহরণ-সহ নৈতিক ও অনৈতিক ক্রিয়ার পার্থক্য লেখো।

কোন্ ধরনের ক্রিয়াকে নৈতিক বলা যায়, আর কোন্ ধরনের ক্রিয়াকে অনৈতিক বলা যায় তা বিশ্লেষণ করলে উভয় প্রকার ক্রিয়ার মধ্যে কিছু পার্থক্য লক্ষ করা যায়। সেগুলি হল-

  • প্রথমত:  যেসব ক্রিয়া ঐচ্ছিক বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত (Voluntary or Intentional) সেই সব ক্রিয়াকে নৈতিক ক্রিয়া বলা হয়। ঐচ্ছিক বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত ক্রিয়া কোনো বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব দ্বারা সম্পাদিত হয়। অপরদিকে, অনৈতিক ক্রিয়া হল অনৈচ্ছিক ক্রিয়া অর্থাৎ যে ক্রিয়া করার আগে কোনো চিন্তা বা পরিকল্পনা থাকে না। ধরা যাক, আমি স্থির করেছি যে একটি পাঠ্যপুস্তক কিনতে হবে এবং সেজন্য আমি বইয়ের দোকানে যাব। কাজেই আমি আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন। উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা ঐচ্ছিক ক্রিয়ার একটি বিশিষ্ট লক্ষণ। অনৈচ্ছিক ক্রিয়ার মধ্যে এ লক্ষণ অনুপস্থিত। হঠাৎ জোরে শব্দ শুনে আমরা চোখ বন্ধ করে ফেলি। আমার এই ক্রিয়া উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়। এটির উপর আমার ইচ্ছার নিয়ন্ত্রণ নেই। অপরপক্ষে, যখন আমি কোনো দৃশ্য দেখব না বলে চোখ বন্ধ করে ফেলি, তখন সেটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং ঐচ্ছিক।
  • দ্বিতীয়ত:  নৈতিক ক্রিয়া কেবলমাত্র অন্ধ-আবেগের তাড়নায় সম্পাদিত হয় না। ব্যক্তি তার জ্ঞাতসারে, বিচারবুদ্ধি অনুসারে কাজ করে। লক্ষ্য এবং উপায়ের ক্ষেত্রে তার অগ্রদৃষ্টি, ইচ্ছা এবং অবাধ নির্বাচনের ক্ষমতা উপস্থিত থাকে। এই ধরনের ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তির নৈতিক দায়বদ্ধতা উপস্থিত থাকে। যেমন- উপরের দৃষ্টান্তে আমার উদ্দেশ্য হল বই সংগ্রহ করা। বিভিন্ন উপায়ে আমি এই বই সংগ্রহ করতে পারি। বন্ধুর কাছ থেকে বইটি ধার নিতে পারি, লাইব্রেরি থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারি অথবা দোকান থেকে বইটি কিনতে পারি। প্রথম দুটি ক্ষেত্রের মধ্যে প্রথমটিতে কোনো অর্থ ব্যয় হবে না। দ্বিতীয়টিতে সদস্যপদ থাকায় অল্প অর্থ ব্যয় এবং তৃতীয়টিতে দোকান থেকে কিনতে গেলে তুলনামূলকভাবে অধিক অর্থব্যয় হবে। কিন্তু তৃতীয় ক্ষেত্রে বইটি কিনতে বা ওই বই ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমি যতটা স্বাধীন অন্য দুটি ক্ষেত্রে ততটা নয়। অর্থাৎ আমি আমার ক্রিয়ার উদ্দেশ্য, উপায় এবং ফলাফল তিনটি সম্বন্ধ সম্পর্কে অবহিত থাকি।

অনৈচ্ছিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে আমি কোনো সচেতন উদ্দেশ্য নিয়ে ক্রিয়া সম্পন্ন করি না। তার উপায় এবং ফলাফল সম্বন্ধেও অবহিত থাকি না। তাই অনৈচ্ছিক ক্রিয়াকে অনৈতিক বলা হয়। এইরূপ ক্রিয়াকে ভালো বা মন্দ কিছুই বলা যায় না।

৬। নীতিবিদ্যার বিষয় হিসেবে উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ের স্বরূপ ও সম্বন্ধ ব্যাখ্যা করো।

উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ের স্বরূপ

উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়-এর স্বরূপ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল-

(1) উদ্দেশ্য: 

(a) উদ্দেশ্য হল কাম্যবস্তু বা লক্ষ্যবস্তুর ধারণা,  যা আমাদের কোনো কর্মে প্রবৃত্ত করে। 

(b) অধ্যাপক লিলির মতে, উদ্দেশ্য হল কর্ম করার পিছনে চালিকাশক্তি। 

(c)  উদ্দেশ্য হল এক সহজাত প্রবৃত্তি, যা আমাদের কাম্যবস্তু লাভে প্ররোচিত করে।

(2) অভিপ্রায়: 

(a) অভিপ্রায় হল কাম্য বা লক্ষ্যবস্তুর ধারণা, কাম্যবস্তু লাভের উপায় এবং অনিবার্য ফলাফল-এই সব কিছুর সমষ্টি।

(b) বেথামের মতে, অভিপ্রায়ের মধ্যে দুটি পরস্পরবিরোধী উপাদান আছে। একটি উপাদান হল প্ররোচকমূলক যা ব্যক্তিকে কাজটি করতে প্রবৃত্ত করে এবং অন্যটি হল প্রতিরোধমূলক যা ব্যক্তিকে কাজটি করতে বাধার সৃষ্টি করে। 

(c) কোনো কাজের নৈতিক বিচার করার সময় শুধুমাত্র কর্মের উদ্দেশ্যকে বিচার করা হয় না, অভিপ্রায়ই হল নৈতিক বিচারের প্রকৃত বিষয়বস্তু।

উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ের সম্বন্ধ

আমরা সাধারণত আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ‘উদ্দেশ্য’ ও ‘অভিপ্রায়’ শব্দ দুটিকে একই অর্থে ব্যবহার করলেও নীতিবিদ্যায় শব্দ দুটিকে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়। বাস্তবিক পক্ষে নীতিবিদ্যায় অভিপ্রায় শব্দটি উদ্দেশ্য অপেক্ষা বৃহৎ অর্থে ব্যবহৃত হয়।

উদ্দেশ্য বলতে বোঝায় কোনো নির্দিষ্ট কাম্য বা লক্ষ্যবস্তুর ধারণা, যা আমরা লাভ করতে চাই এবং যার জন্য কর্মে প্রবৃত্ত হই। কিন্তু অভিপ্রায়ের ক্ষেত্রে কেবল কাম্যবস্তুর চিন্তা করি না, এর সঙ্গে ঐ কাম্যবস্তু লাভ করার উপায় এবং কাম্যবস্তু লাভ করার ফলে যে পরিণাম বা ফলাফল পাওয়া যেতে পারে- এইসব কিছুকেই বুঝে থাকি। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বোঝা যাক্ কোনো এক সমাজসংস্কারক শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গণহত্যা করতে পারে। এক্ষেত্রে শোষণমুক্ত সমাজ গঠন হল উদ্দেশ্য আর এই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার উপায় হল ‘গণহত্যা’ এবং এই গণহত্যার ফলে দুঃখদায়ক পরিণাম বা ফলাফল- এসবই এই সমাজ সংস্কারকের অভিপ্রায়ের অন্তর্ভুক্ত।

স্পষ্টতই এর থেকে বোঝা যায় উদ্দেশ্য অভিপ্রায়ের অন্তর্ভুক্ত হলেও অভিপ্রায় উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত নয়। উদ্দেশ্য হল অভিপ্রায়ের অংশ। সুতরাং অভিপ্রায় শব্দটির অর্থ উদ্দেশ্যের অর্থ অপেক্ষা অনেক ব্যাপক।

৭। অভিপ্রায় বলতে কী বোঝো? বিভিন্ন প্রকার অভিপ্রায় দৃষ্টান্ত-সহ আলোচনা করো।

অভিপ্রায়

দৈনন্দিন জীবনে আমরা ‘উদ্দেশ্য’ ও ‘অভিপ্রায়’ কথা দুটিকে একই অর্থে ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু নীতিবিদ্যায় ‘অভিপ্রায়’ শব্দটি ‘উদ্দেশ্য’ অপেক্ষা অনেক বেশি ব্যাপক। উদ্দেশ্য বলতে কেবল কাম্যবস্তুর ধারণাকেই বোঝায়। কিন্তু অভিপ্রায় বলতে কাম্যবস্তুর ধারণা, কাম্যবস্তু লাভের উপায় এবং ফলাফলের চিন্তাকেও বোঝায়।

বিভিন্ন প্রকার অভিপ্রায়

ম্যাকেঞ্জি (Mackenzie) বিভিন্ন প্রকার অভিপ্রায়ের পরিচয় দিয়েছেন-

(1) তাৎক্ষণিক ও দূরবর্তী অভিপ্রায়: অভিপ্রায় তাৎক্ষণিক (Immediate) ও দূরবর্তী (Remote) হতে পারে। দুইজন ব্যক্তি একই ধরনের কর্মে নিযুক্ত থাকলে তাদের তাৎক্ষণিক অভিপ্রায় অভিন্ন হলেও দূরবর্তী অভিপ্রায় কখনোই অভিন্ন হতে পারে না। যেমন- নদীতে ঝাঁপ দেওয়া একজন হত্যাকারীকে উদ্ধারের জন্য (তাৎক্ষণিক অভিপ্রায়) দুইজন ব্যক্তি অর্থাৎ একজন পথিক ও একজন পুলিশকর্মী একই অভিপ্রায়ে নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল, যদিও তাদের একজনের দূরবর্তী অভিপ্রায় কিন্তু আলাদা। পথিক হত্যাকারীকে বাঁচানোর জন্যই নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে এবং পুলিশকর্মী হত্যাকারীকে জেলে পাঠানোর জন্য নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে।

(2) বাহ্য ও আন্তর অভিপ্রায়: অভিপ্রায় বাহ্য (Outer) ও আন্তর (Inner) হতে পারে। যেমন- কোনো বিপন্ন বা অসহায় ব্যক্তিকে দেখে আমার দুঃখ হল এবং সেই দুঃখ থেকে পরিত্রাণের জন্য আমি যদি তাকে সাহায্য করি তাহলে তা হবে আমার বাহ্য অভিপ্রায় এবং আমার এই দুঃখকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া হল আমার আন্তর অভিপ্রায়।

(3) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিপ্রায়: অভিপ্রায় প্রত্যক্ষ (Direct) ও পরোক্ষ (Indirect) হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একদল বিপ্লবী যদি কোনো ইংরেজ সাহেবকে হত্যা করার জন্য তিনি যে রেলগাড়িতে যাত্রা করছেন, তাতে বোমা নিক্ষেপ করে; তাহলে বিপ্লবীদের প্রত্যক্ষ অভিপ্রায় হবে ইংরেজ সাহেবকে হত্যা করা এবং তাদের পরোক্ষ অভিপ্রায় হবে ইংরেজ সাহেবের সহযাত্রীদের প্রাণনাশ করা।

(4) সচেতন ও আচতন অভিপ্রায়: অভিপ্রায় সচেতন (Conscious) ও অচেতন (Unconscious) হতে পারে। আধুনিক মনোসমীক্ষকরা মনে করেন যে, মানুষের মধ্যে এমন এক মানসবৃত্তি আছে যেগুলি সম্পর্কে ব্যক্তি সচেতন নয়। মানুষের নিজ্ঞান মন ওই সকল মানসবৃত্তিকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। যেমন- তারা বলেন মানুষ যখন কোনো জনকল্যাণমূলক কাজ করে তখন তার চেতন অভিপ্রায়টি হল জনগণের কল্যাণ করা। কিন্তু তার অচেতন বা নিজ্ঞান অভিপ্রায়টি হল আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করা। অধ্যাপক লিলি অভিপ্রায়ের এই প্রকারভেদকে নীতিবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত বলেননি।

(5) আকারগত ও বিষয়গত অভিপ্রায়: অভিপ্রায় আকারগত (Formal) ও বিষয়গত (Materialistic) হতে পারে। যে নীতি অনুসরণ করে কোনো কর্ম করা হয় তাকে আকারগত অভিপ্রায় বলে। কোনো কর্মের পরিণাম চিন্তা করে যে কাজ করা হয় তাকে বিষয়গত অভিপ্রায় বলে। দুজন ব্যক্তির বিষয়গত অভিপ্রায় অভিন্ন হলেও তাদের আকারগত অভিপ্রায় ভিন্ন হতে পারে। যেমন- কোনো দেশের পরিচালিত সরকারকে কেউ মনে করতে পারে অতিপ্রগতিশীল, কেউ মনে করতে পারে অতিরক্ষণশীল। দুটি ভিন্ন ধরনের চিন্তা করে দুজন ব্যক্তিই যদি ওই সরকারের পতন ঘটাতে চায় তবে বলা যাবে যে, ওই দুজন ব্যক্তির বিষয়গত অভিপ্রায় অভিন্ন, কিন্তু তাদের আকারগত অভিপ্রায় ভিন্ন। একজন সরকারের অতিপ্রগতিশীলতা নীতি অনুসরণ করার বিপক্ষে এবং অন্যজন অতিরক্ষণশীলতা নীতির বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment