ন্যায়ের বিভিন্ন রূপ আলোচনা করো
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, প্রাচীন গ্রিসে পিথাগোরীয় গ্রিক দার্শনিকদের রচনায় ন্যায়বিচারের ধারণার সন্ধান পাওয়া যায়। প্লেটো-র ‘The Republic’ গ্রন্থে ন্যায়বিচারের উল্লেখ রয়েছে। আধ্যাত্মিক বা অধিবিদ্যামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে প্লেটো ন্যায়বিচারকে ব্যাখ্যা করেছেন। রোমান আইনবিদরা রাষ্ট্রীয় আইনকে চূড়ান্ত ন্যায়বিচারের অংশ বলে মনে করতেন। গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার বিকাশের ফলে ন্যায়বিচার সম্পর্কিত ধারণার বদল ঘটেছে। আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে ন্যায়বিচারের ধারণা ব্যক্তিজীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে ব্যাপ্তি লাভ করেছে। ভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ন্যায়ের ধারণাটিকে বিশ্লেষণ করেছেন। ফলে, বর্তমানে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আইনগত ন্যায়বিচারের পরিচয় পাওয়া যায়।
সামাজিক ন্যায়
সামাজিক ন্যায়বিচার (Social Justice) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একে একটি আদর্শগত ধারণারূপে ব্যাখ্যা করেছেন। যদিও সামাজিক ন্যায় ধারণাটি একটি আপেক্ষিক ধারণা (Relative Concept), তাই সামাজিক ন্যায় সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। সামাজিক ন্যায়ের ধারণা অনুসারে, জনগণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণসাধনের উদ্দেশ্যে একটি ন্যায়সংগত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। সামাজিক ন্যায়ের মাধ্যমে ব্যক্তিমানুষের স্বার্থের সঙ্গে সর্বসাধারণের স্বার্থের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করা হয়।
প্রতিটি সমাজব্যবস্থাতেই ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য ন্যূনতম সামাজিক সুযোগসুবিধার মধ্যে সংগতিবিধান থাকা প্রয়োজন। এ ধরনের সুযোগসুবিধা উপভোগের ক্ষেত্রে সমস্ত মানুষের সমান অধিকারের কথা, সামাজিক ন্যায়ে বলা হয়। বস্তুত, সামাজিক সাম্যের সঙ্গে সামাজিক ন্যায়ের ধারণাটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একথা অনস্বীকার্য যে, বৈষম্যমূলক সমাজে কখনো সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ব্যাপক অর্থে আইনের দৃষ্টিতে সাম্য, আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষণ, বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা প্রভৃতি ধারণা সামাজিক ন্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। পশ্চিমি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামাজিক ন্যায়ের এই ধারণাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। অন্যদিকে, ভারতের মতো প্রাচ্যের উন্নয়নশীল দেশে সামাজিক ন্যায়ের সঙ্গে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণ, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অনগ্রসরতা দূরীকরণের ধারণা জড়িত। সামাজিক ন্যায়ের সমসাময়িক ধারণা অনুযায়ী, সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের সঙ্গে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থকে সমন্বিত করা একান্ত আবশ্যক। অনেকসময় সংকীর্ণ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের সঙ্গে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়।
এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সার্বিক সামাজিক স্বার্থে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অধিকার ও স্বাধীনতার উপর যুক্তিযুক্ত বাধা আরোপ করতে হয়। যদিও এই বিধিনিষেধগুলি কখনোই ন্যায় স্থাপনের বিরোধী নয় বরং এগুলি সকলের জন্য ন্যায়কে সুনিশ্চিত করে। উদাহরণ হিসেবে ইউরোপের দাসপ্রথা অথবা ভারতের মতো দেশে সতীদাহ প্রথার বিলোপসাধনের কথা বলা যেতে পারে। যার দ্বারা দাসেদের এবং নারীদের প্রতি ন্যায়কে সুরক্ষিত করা হয়েছে। আবার, দুর্বল পশ্চাত্পদ জাতিগুলির জন্য বিভিন্ন সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এগুলিকে ইতিবাচক বৈষম্য (Affairmative Discrimination) বা সুরক্ষামূলক বৈষম্য (Protective Discrimination) বলা হয়।
ভারতের সংবিধানের মৌলিক অধিকার তপশিলি জাতি, তপশিলি উপজাতি, অন্যান্য পশ্চাত্পদ শ্রেণি, মহিলা ও শিশুদের জন্য বিশেষ নীতি ও ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সামাজিক ন্যায়ের বাস্তব প্রয়োগের দায়িত্ব রাষ্ট্রের, তাই রাষ্ট্রকে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার সহায়ক বলে অভিহিত করা হয়। যদিও মার্কসবাদীদের মতে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সামাজিক ন্যায়ের আড়ালে আসলে শোষণমূলক সমাজকে স্থায়িত্ব দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হয়।
অর্থনৈতিক ন্যায়
সামাজিক ন্যায়ের মতো অর্থনৈতিক ন্যায়ও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থনৈতিক ন্যায় (Economic Equality) ব্যতিরেকে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা অর্থহীন। সাধারণ অর্থে অর্থনৈতিক ন্যায় বলতে বোঝায়, অর্থনৈতিক সম্পদের ক্ষেত্রে পার্থক্যের অনুপস্থিতি। অন্য ভাষায়, অর্থনৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে ব্যক্তিদের মধ্যে বৈষম্যের অবসানকে অর্থনৈতিক ন্যায় বলে। ইতিবাচক অর্থে এটি হল উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে সকলের জন্য স্বাধীনতা। এ ছাড়া অর্থনৈতিক ন্যায় বলতে বোঝায় নির্দিষ্ট কাজের বিনিময়ে যথাযথ মজুরি পাওয়া, দেশের অর্থনৈতিক সুফলগুলিকে সকল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি।
মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অর্থনৈতিক ন্যায়ের ধারণার মধ্যে বিস্তর প্রভেদ রয়েছে। উদারনীতিবাদীরা ও নয়া উদারনীতিবাদীরা অর্থনৈতিক ন্যায় বলতে রাষ্ট্র কর্তৃক জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম রূপায়ণ, গতিশীল কর ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনবৈষম্য হ্রাস, উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতি, অবাধ প্রতিযোগিতা প্রভৃতিকে বুঝিয়েছেন। অন্যদিকে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, অর্থনৈতিক ন্যায় বলতে সমস্ত রকম ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত মালিকানার বিলোপকে বুঝিয়েছে, যেখানে উৎপাদনের উপকরণের সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমের কথা বলা হয়।
মার্কসের মতে, শ্রেণিহীন ও শোষণহীন সমাজ ছাড়া অর্থনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আধুনিক জনকল্যাণকর রাষ্ট্রে বিশেষত উন্নয়নশীল দেশসমূহে অর্থনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দারিদ্র্য দূরীকরণের মতো কর্মসূচি রূপায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দরিদ্র মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিকে উৎপাদনের উপকরণের উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ন্যায়ের ধারণাকে সর্বাগ্রে রূপায়িত করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ন্যায়ের ধারণা সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হয়।
রাজনৈতিক ন্যায়
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, রাজনৈতিক ন্যায়েরও একটি স্বতন্ত্র গুরুত্ব রয়েছে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণায় রাজনৈতিক ন্যায় ও সাম্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণভাবে রাজনৈতিক ন্যায় (Political Justice) বলতে দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণকে বোঝায়। অর্থাৎ রাষ্ট্র জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ, আর্থিক অবস্থা নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সমান রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করবে, যেগুলি তাদের সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করবে ও উৎসাহিত করবে। অধ্যাপক জোহারি-র মতে, রাজনৈতিক ন্যায় বলতে রাজনৈতিক জীবনে জনগণের স্বাধীন ও স্বচ্ছ অংশগ্রহণকে বোঝায় (“…free and fair participation of the people in their political life.”)।
এক্ষেত্রে দৃষ্টান্তস্বরূপ, সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের কথা উল্লেখ করা যায়। রাজনৈতিক ন্যায় হল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিস্বরূপ। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা হয়। ফলে বলা যায়, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক সাম্যের সঙ্গে রাজনৈতিক ন্যায়ের ধারণা অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, রাজনৈতিক ন্যায়ের অর্থ হল নির্বাচিত করা ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকারের সমতা, সরকারি পদ ও সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে সমতা, রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের অধিকার প্রভৃতি।
রাজনৈতিক ন্যায়ের ধারণা অনুযায়ী, রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস হল জনগণ। ফলে সরকারকে নীতিগ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। রাজনৈতিক ন্যায় জনগণের সার্বভৌমিকতার তত্ত্বকে তুলে ধরে। রাজনৈতিক ন্যায় রাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক সাম্যের আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। রাজনৈতিক ন্যায়ের ধারণায় চিন্তা ও বাক্যের পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলা হয়। তবে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা বা সাম্য অসীম হতে পারে না। রাষ্ট্র যুক্তিসংগত কারণে আবশ্যিকভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। তবে মার্কসবাদীদের মতে, অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক সমাজে রাজনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব।
আইনগত ন্যায়
আইনগত ন্যায় (Legal Justice) দেশের আইন প্রণয়নের কাঠামো ও বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী, ন্যায় প্রতিষ্ঠাকে এককথায় আইনগত ন্যায় বলা হয়। দেশে আইনগত ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হলে যুক্তিসংগত আইন প্রণয়নের প্রয়োজন। অযৌক্তিক আইন প্রণীত হলে তা দেশের আইনগত ন্যায়ের পক্ষে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া আইনগত ন্যায় অনুযায়ী সকলের জন্য সমান আইন প্রণয়ন করা উচিত। আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার প্রতিটি নাগরিকের থাকবে। অবশ্য যুক্তিসংগত ভিত্তিতে পৃথক্করণের ব্যবস্থা থাকতে পারে। তবে সমপর্যায়ভুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আইন হবে সমান এবং তা সমভাবে প্রযুক্ত হবে।
আইনগত ন্যায়ের ধারণা অনুসারে, আইন প্রণয়ন পদ্ধতি ন্যায়সংগত হওয়া প্রয়োজন। অন্যায়, অযৌক্তিক বা জনবিরোধী আইন প্রণীত হলে জনগণ তাতে প্রতিবাদ করবে। আইনগত ন্যায় একটি স্বাধীন, নির্ভীক ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলে। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনের যৌক্তিকতা বিচার করার জন্য বিচার বিভাগের হাতে বিচার বিভাগীয় সমীক্ষার ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। আইনগত ন্যায় অনুযায়ী, আইনের অনুশাসন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একান্ত অপরিহার্য।
বস্তুত, ‘আইনের চোখে সাম্য’ ও ‘আইন দ্বারা সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার’ ছাড়া আইনগত ন্যায় প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। তাছাড়া আইন হবে ন্যায়বিচারের অনুগামী এবং ন্যায়বিচার আইনের মধ্যে প্রতিফলিত হবে। আইনগত ন্যায়ের ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বার্কার বিধিসম্মত ও যুক্তিসংগত আইনের উপরে গুরুত্ব দিয়েছেন। আইনগত ন্যায়ের মূল বক্তব্য অনুযায়ী- আইন ন্যায়বিচারকে অনুসরণ করে প্রণীত হবে (Law according to Justice) এবং আইন অনুসারে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে (Justice according to Law)। প্রথমটি অনুযায়ী, আইনকে ন্যায়ের দাবির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হয়, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, আইনকে ভিত্তি করে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হয়।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর