রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় আইনের অর্থ, প্রকৃতি ও শ্রেণিবিভাজন আলোচনা করো

রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় আইনের অর্থ, প্রকৃতি ও শ্রেণিবিভাজন আলোচনা করো

রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় আইনের অর্থ, প্রকৃতি ও শ্রেণিবিভাজন আলোচনা করো
রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় আইনের অর্থ, প্রকৃতি ও শ্রেণিবিভাজন আলোচনা করো

রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় আইন

(1) রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় আইনের অর্থ

জাতীয় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যে আইন প্রতিষ্ঠিত, তাকে জাতীয় আইন বলে। অধ্যাপক জোহারির মতে, যে। আইন রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের দ্বারা রচিত হয় এবং রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে বসবাসকারী নাগরিকদের মধ্যে প্রযুক্ত হয় তাকে জাতীয় আইন বলে [“A law formulated by the sovereign authority and applicable to the people living under its territorial jurisdiction is called national (municipal) law.”]।

জাতীয় আইন বা রাষ্ট্রীয় আইনকে সার্বভৌম শক্তির আদেশ বলে অভিহিত করা হয়। আইনের বিশ্লেষণধর্মী মতবাদের প্রধান প্রবক্তা জন অস্টিন একমাত্র নির্দিষ্ট রাষ্ট্রনৈতিক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ ছাড়া অন্য কিছুকে আইন বলে স্বীকৃতি দিতে চাননি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হল্যান্ড-এর বক্তব্য হল, সার্বভৌম রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃপক্ষের দ্বারা প্রযুক্ত বাহ্যিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী সাধারণ নিয়মই হল আইন (“A law is general rule of external human action enforced by the sovereign political authority.”) অধ্যাপক গেটেল-এর মতে, শুধুমাত্র সেইসব নিয়মকানুনকে আইন বলা যায়, যেগুলি রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট, স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ও প্রযুক্ত (“Only those rules which the state creates or which it recognises and enforces become law.”)।

(2) রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় আইনের প্রকৃতি: জাতীয় আইন বা রাষ্ট্রীয় আইন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাসকারী ব্যক্তিদের বাহ্যিক আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এই কারণে জাতীয় আইনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাত্ত্বিকদের মতে, রাষ্ট্র নিজেই একটি আইনমূলক প্রতিষ্ঠান। ম্যাকাইভার-এর বক্তব্য হল, “The State is both the child and the parents of law.” ব্যাপক অর্থে যেসব বিধিনিয়ম সভ্য রাষ্ট্রনৈতিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন হয়, সেগুলিকে রাষ্ট্রীয় আইন বা জাতীয় আইন বলে অভিহিত করা যেতে পারে। জাতীয় আইনের প্রকৃতি বৃহত্তর সমাজজীবন ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দ্বারা নির্ধারিত হয় বলে অনেকে মনে করেন।

জাতীয় আইনের পিছনে রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের অনুমোদন থাকে। জনজীবনে শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে রাষ্ট্র জাতীয় আইনের মাধ্যমে ব্যক্তির বাহ্যিক ক্রিয়াকলাপ  নিয়ন্ত্রণ করে। জাতীয় আইনের প্রয়োগ বাধ্যতামূলক। জাতীয় আইন মেনে চলতে নাগরিকরা বাধ্য থাকে। জাতীয় আইন মেনে চলার বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করার জন্য বলপ্রয়োগ বা শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে। এই আইন সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট ও সর্বজনীন। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে বসবাসকারী প্রতিটি নাগরিকের ক্ষেত্রে জাতীয় আইন সমানভাবে প্রযোজ্য হয়।

জাতীয় আইনের প্রকৃতিকে এই কারণে সর্বজনীন আখ্যা দেওয়া হয়। ম্যাকাইভার-এর মতে, রাষ্ট্রীয় আইন যেহেতু সর্বসাধারণের উপর প্রযোজ্য, তাই তা বাধ্যতামূলক হওয়া আবশ্যক [“Because it (National) law is general in its application the law of the State must be compulsive.”]। জাতীয় আইন অনড় বা স্থিতিশীল নয়। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে যুগের প্রয়োজনে জাতীয় আইন পরিবর্তিত হয়। এজন্য জাতীয় আইনকে পরিবর্তনশীল বা গতিশীল বলে আখ্যা দেওয়া হয়। জাতীয় আইনের প্রকৃতি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একমত নন। তাই এ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

  1. সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি: আইনের সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা দ্যুগুই, ব্র্যাবে, ল্যাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন, সামাজিক সংহতির জন্যই জাতীয় আইনের সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় আইনকে শুধুমাত্র রাষ্ট্রের আদেশ বলে মেনে নিতে পারেননি তাঁরা। জাতীয় আইনের পিছনে রয়েছে মানুষের শৃঙ্খলাবোধ ও সমাজবদ্ধতার শুভ চেতনা। অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কি-র মতে, জাতীয় আইনের সার্থকতা তার কল্যাণমূলক প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। সামাজিক কল্যাণসাধন জাতীয় আইনের মূল লক্ষ্য।
  2. বার্কারের বক্তব্য: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর্নেস্ট বার্কার জাতীয় আইনের বিধিসম্মত প্রকৃতির পাশাপাশি তার যুক্তিসংগত দিকটির উপর সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, জাতীয় আইনের বৈধতার পাশাপাশি তার নৈতিক মূল্যও থাকা প্রয়োজন। বার্কার-এর বক্তব্য হল, “Ideally, law ought to have both validity and value.”
  3. গ্রিনের বক্তব্য: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টমাস হিল গ্রিন আইনকে রুশো-র মতো ‘সাধারণ ইচ্ছা’র অভিব্যক্তি বলে অভিহিত করেছেন। গ্রিন-এর মতে, সার্বভৌমিকতা হল চরম ক্ষমতা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ক্ষমতা তখনই প্রকৃত চরম ক্ষমতায় রূপান্তরিত হয়, যখন তা সাধারণ ইচ্ছার দ্বারা সমর্থিত হয় (“Sovereignty is the supreme power but it is only supreme power when supported by the general will.”)।
  4. মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি: জাতীয় আইন বা রাষ্ট্রীয় আইনের প্রকৃতি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, জাতীয় আইন বা রাষ্ট্রীয় আইন হল সমাজের প্রতিপত্তিশালী শাসকশ্রেণির ইচ্ছার প্রকাশ। সমাজের প্রতিপত্তিশালী শাসকশ্রেণি প্রচলিত অর্থনৈতিক কাঠামোকে বজায় রাখার স্বার্থে রাষ্ট্রীয় আইনকে ব্যবহার করে। এভাবে দাস সমাজে মুষ্টিমেয় দাসমালিকদের স্বার্থে, সামন্ত সমাজে সামন্তপ্রভুদের স্বার্থে ও পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতিদের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় আইন বা জাতীয় আইনকে ব্যবহার করা হয়েছে। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থার উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে জাতীয় আইনের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে। সমাজতান্ত্রিক সমাজে জাতীয় আইন সংখ্যাগরিষ্ঠ সর্বহারা শ্রেণির স্বার্থে প্রযুক্ত হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় আইন বা জাতীয় আইন সমাজতান্ত্রিক আইনের চেহারা নিয়ে সমাজতন্ত্র নির্মাণের উপযোগী হিসেবে কাজ করে। সমাজতান্ত্রিক আইনকে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা ও স্বার্থের প্রকাশ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় জীবনে আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ আইন ব্যতীত রাষ্ট্রীয় জীবন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়তে বাধ্য। তবে জাতীয় আইনের অর্থ ও প্রকৃতি স্থিতিশীল নয়। সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জাতীয় আইনেরও বদল ঘটে চলেছে।

(3) রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় আইনের শ্রেণিবিভাজন

জাতীয় আইনের দুটি ভাগ রয়েছে- সরকারি আইন (Public Law) ও বেসরকারি আইন (Private Law)।

সরকারি আইন বলতে বোঝায় সেই আইনগুলিকে, যেগুলি সরকার কর্তৃক রচিত হয় এবং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাসকারী সমস্ত ব্যক্তি, সংঘ ও প্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে সবার উপরে প্রযোজ্য হয়। এই আইন ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। সরকারি আইন মেনে চলতে সবাই বাধ্য থাকে। অন্যদিকে, যে আইন সরকার কর্তৃক রচিত হয় না, যে আইন সরকার কর্তৃক বলবৎ হয় না, যে আইনের মাধ্যমে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয় না, তাকে বেসরকারি আইন বলে। বেসরকারি আইন মেনে চলতে সবাই বাধ্য নন। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য নয়।

সরকারি আইনকে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলি হল- সাংবিধানিক আইন (Constitutional Law), প্রশাসনিক আইন (Administrative Law) ও ফৌজদারি আইন (Criminal Law)।

  • পণ্ডিতদের মতে, যেসব নীতিনিয়মের ভিত্তিতে সরকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলি নির্ধারিত হয়, তাকে সাংবিধানিক আইন বলে। অধ্যাপক গিলক্রিস্ট মনে করেন, সাংবিধানিক আইনের উপরে ভিত্তি করেই সরকার দাঁড়িয়ে থাকে। প্রসঙ্গত বলা যায়, সাংবিধানিক আইন লিখিত এবং অলিখিত দুই-ই হতে পারে।
  • সরকারি আইনের অপর একটি ধরন হল প্রশাসনিক আইন। অধ্যাপক ডাইসি প্রশাসনিক আইন বলতে কতকগুলি নিয়মের সমষ্টিকে বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, এই নিয়মগুলি নাগরিকদের সঙ্গে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ফ্রান্সে এইরূপ প্রশাসনিক আইনের অস্তিত্ব রয়েছে। ওখানে প্রশাসন যাতে নাগরিকদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার না করতে পারে প্রশাসনিক আইন দ্বারা তা সুনিশ্চিত করে নাগরিকদের অধিকারকে সুরক্ষিত করা হয়েছে।
  • সরকারি আইনের তৃতীয় ধরনটি হল ফৌজদারি আইন। ফৌজদারি আইন হল সেই আইন, যার মাধ্যমে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা হয়, নাগরিকদের নিরাপত্তাবিধানের ব্যবস্থা করা হয় এবং অপরাধীদের দণ্ড দেওয়া হয়।

তবে বর্তমানে জাতীয় আইনের অধীনে আরও এক ধরনের আইনের কথা উল্লেখ করা যায়, এটি হল অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন (Deligated Law)। আধুনিক দিনে আইনসভার কার্যাবলি বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আইনসভার একার পক্ষে আইনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে আইন বিভাগ আইনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয়গুলি নির্ধারণ করার দায়িত্ব শাসন বিভাগের হাতে অর্পন করে। আইন বিভাগ কর্তৃক অর্পিত এই ক্ষমতার ভিত্তিতে শাসন বিভাগ প্রণীত আইনকে অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন বলা হয়।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment