প্রযুক্তি বিপ্লব সম্পর্কে লেখো
অথবা, কারিগরি বিপ্লব কাকে বলে
অথবা, টীকা লেখো: কারিগরি বিপ্লব

প্রযুক্তি বিপ্লব
ইউরোপে মধ্যযুগের অবসান এবং আধুনিক যুগের সূচনার লক্ষণীয় প্রকাশ ঘটেছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে। পঞ্চদশ শতক থেকে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের সূত্রে যে জ্ঞানদীপ্তি ঘটেছিল, তারই অনুসঙ্গ রূপে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। আলোচ্য পর্বে বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তি তথা কারিগরি ব্যবস্থার উন্নয়নে জোয়ার আসে, যাকে Technological Revolution বা কারিগরি বা প্রযুক্তি বিপ্লব নামে আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। এর ফলে কৃষিক্ষেত্র, সামরিক ক্ষেত্র, নৌযাত্রা, ধাতুর ব্যবহার ইত্যাদিতে নব নব উন্নত প্রযুক্তির উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছিল।
(1) ইউরোপে প্রযুক্তির বিকাশ: ইউরোপে প্রযুক্তি বিপ্লবের পশ্চাৎপটে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিকাশ, কৃষির চাহিদা বৃদ্ধি, শিল্পপণ্যের চাহিদা, ক্রমবর্ধিত জনসংখ্যা ইত্যাদি নানা বিষয়কে বিভিন্ন ঐতিহাসিকেরা দায়ী করেছেন। ইউরোপীয় নবজাগরণের যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কাজেই বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার প্রকৃতির উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধিতে হয়ে উঠেছিল সহায়ক। এই সময় গ্যালিলিও, কেপলার প্রমুখের বিজ্ঞানচেতনা আধুনিক বিজ্ঞানের যে উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল, পরবর্তীতে চার্লস বয়েল (Charles Boyle), আইজ্যাক নিউটন (Isaac Newton), হামফ্রে ডেভি (Humphry Davy), জেমস ওয়াট (James Watt)-এর বিজ্ঞানসাধনা ও বিভিন্ন আবিষ্কার সেই ক্ষেত্রেই ফলিয়েছিল সোনার ফসল।
- প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন: পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে ইউরোপে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের যে জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা প্রভাবিত করেছিল কৃষি, শিল্প, নৌযাত্রা, রণাঙ্গন, চিকিৎসাব্যবস্থা ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রকে। এই কালপর্বে জার্মানিতে গুটেনবার্গ কর্তৃক আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার (১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ) বৌদ্ধিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত করেছিল। আবার কৃষিক্ষেত্রে ভারী লোহাযুক্ত লাঙল, কাঠের মই, হ্যারো, শস্যপেষাই যন্ত্রের ব্যবহার এবং উন্নত জলসেচ, আবর্তন পদ্ধতির প্রয়োগ কৃষি উৎপাদনে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে। একইভাবে যুদ্ধক্ষেত্রেও বারুদের ব্যাপক ব্যবহার, উন্নততর অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ সংঘটিত করে সামরিক বিপ্লব (Military Revolution)। পাশাপাশি পরিবর্তন আসে নৌ-প্রযুক্তিতেও। সামুদ্রিক অভিযানের ক্ষেত্রে সেক্টট্যান্ট যন্ত্র, অ্যাস্ট্রোল্যাব (Astrolab), নাবিকের কম্পাস (Mariners Compass) নৌ অভিযাত্রীদের দূরবর্তী অঞ্চলে সফলভাবে যাত্রা করতে সহায়তা করে। এ ছাড়া গ্যালিলিওর টেলিস্কোপ (Telescope) যন্ত্রাবিষ্কার জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক নতুন দিকনির্দেশ করেছিল। পাশাপাশি চিকিৎসাক্ষেত্রে মাইক্রোস্কোপ (Microscope), ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতির মধ্যে ক্রিশ্চিয়ান হাইজেন্স (Christiaan Huygens) কর্তৃক উদ্ভাবিত পেন্ডুলাম ঘড়ি (Pendulam Clock) ও প্রযুক্তির জগতে ছিল মাইলফলক স্বরূপ।
(2) ফলাফল: ইউরোপে প্রযুক্তি বিপ্লবের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এগুলি হল-
(a) সপ্তদশ শতক পর্যন্ত প্রযুক্তিগত উন্নতি শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
(b) প্রযুক্তি বিপ্লব ইউরোপের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। একদিকে যেমন শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে তেমনই ইউরোপীয় দেশগুলি উপনিবেশ স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
(c) মুদ্রণ প্রযুক্তির উন্নতির ফলে বই অনেক সহজলভ্য হয়ে ওঠে, যা শিক্ষার প্রসারকে ত্বরান্বিত করেছিল।
(d) প্রযুক্তি বিপ্লবের ফলস্বরূপ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাক্ষেত্রেও প্রভূত উন্নতি হয়।
(e) সামরিক প্রযুক্তির বিকাশের ফলে প্রতিষ্ঠা হয় জাতীয় রাজতন্ত্রের। পরিশেষে বলা যায়, প্রযুক্তি বিপ্লব বা কারিগরি বিপ্লব ইউরোপের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিশ্বের ইতিহাসে এর প্রভাব আজও বর্তমান।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর