ইক্তা’ ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো

ইক্তা’ ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো

অথবা, সুলতানি যুগে ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন সম্পর্কে লেখো

ইক্তা' ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো
ইক্তা’ ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো

ভূমিকা

মধ্যযুগে ভারতে সুলতানি শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল ইক্তা ব্যবস্থা। ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় সূচনাকাল থেকেই ইসলামীয় জগতে এই ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ঐতিহাসিক কে এম আশরাফ বলেছেন, সম্ভবত খলিফা মুকতিদির এই প্রথার উদ্ভাবক ছিলেন। তবে ভারতে এই প্রথার প্রবর্তক ছিলেন সুলতান ইলতুৎমিস। তাঁর পরবর্তী সুলতানদের আমলে ইস্তা ব্যবস্থার মধ্যে নানা পরিবর্তন ও সংযোজন ঘটেছিল।

(1) ইলতুৎমিসের আমলে ইক্তা ব্যবস্থা: সুলতান ইলতুৎমিসই ভারতে প্রথম ইক্তা ব্যবস্থাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল নববিজিত অঞ্চলের ওপর সুলতানের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য তিনি তাঁর বিশ্বস্ত সমরনায়কদের মধ্যে এই নতুন নতুন জয় করা অঞ্চলগুলিকে ইক্তা হিসেবে বিলি করেন। তবে তিনি মাক্তিদের বিভিন্ন ইক্তায় বদলির ব্যবস্থা করেন যাতে ভবিষ্যতে মাক্তিরা নিজ এলাকায় স্বাধীন ও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে না পারেন। এইভাবে তিনি ইক্তা ব্যবস্থাকে প্রাদেশিক শাসনের ভিত্তি হিসেবে গড়ে তোলেন।

(2) গিয়াসউদ্দিনের আমলে ইক্তা ব্যবস্থা : ইলতুৎমিসের উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছিলেন মাক্তিরা। কিন্তু বলবন সিংহাসনে বসার পর তিনি তাঁদের কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি ইস্তা ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন ঘটান। যেমন-

  • ইতিমধ্যে মাক্তিদের অনেকেই মৃত কিংবা বার্ধক্যের কারণে অকর্মণ্য হয়ে পড়েছিলেন। তিনি এই ইক্তাগুলিকে বাজেয়াপ্ত করেন।
  • ইক্তাদারদের অধিকাংশই কর ফাঁকি দিতেন। তাঁদের এই দুর্নীতি রোধ করার উদ্দেশ্যে। তিনি প্রায় প্রতিটি ইক্তায় খোয়াজা নামক এক শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ করেন। এঁরা ইক্তার প্রকৃত আয়, ব্যয় ও উদ্বৃত্ত অর্থের হিসাব রাখতেন। এইভাবে তিনি ইক্তা ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করেন।

(3) আলাউদ্দিন খলজির আমলে ইক্তা ব্যবস্থা: আলাউদ্দিন খলজির আমলে সুলতানি সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যথা-

  • তিনি দিল্লির দূরবর্তী নববিজিত অঞ্চলগুলিকে ইক্তায় পরিণত করে তা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।
  • দিল্লির নিকটবর্তী অঞ্চলগুলিকে তিনি খালিসা জমিতে পরিণত করে সরকারি রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করেন।
  • তিনি রাজস্ব দপ্তর মারফত প্রতিটি ইক্তার রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেন।
  • তিনি সৈন্যদের ইক্তার পরিবর্তে নগদ বেতন দেওয়ার রীতি চালু করেন।
  • দুর্নীতিগ্রস্ত ইক্তাদারদের তিনি কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করেন।

(4) মহম্মদ-বিন-তুঘলকের আমলে ইক্তা ব্যবস্থা: গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের আমলে ইক্তা ব্যবস্থায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেনি। তিনি কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় নীতির কঠোরতা কিছুটা শিথিল করেন। কিন্তু মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে ইস্তা ব্যবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটানো হয়, যথা-

  • ঐতিহাসিক বরণী, ইসামি, ইবন বতুতা প্রমুখের রচনা থেকে  জানা যায় যে মহম্মদ বিন তুঘলক রাজস্ব সংগ্রহ ও সৈন্য রক্ষণাবেক্ষণ কাজ দুটিকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেন।
  • তিনি নিলামের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানের ইচ্ছুক ব্যক্তিদেরই ইক্তার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেন।

(5) ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে ইক্তা ব্যবস্থা: সুলতান হিসেবে ফিরোজ শাহ তুঘলক ছিলেন যথেষ্ট উদার ও দুর্বল চিত্ত। তাই তিনি সিংহাসনে বসে অভিজাত শ্রেণিকে নানা ধরনের সুযোগসুবিধা দিয়েছিলেন। ফলে ইক্তা ব্যবস্থায় নানা পরিবর্তন ঘটে। যেমন-

  • তাঁর আমলে ইক্তা ব্যবস্থায় জান কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে।
  • তিনি অভিজাতদের ব্যাপক হারে ইক্তা বিলি করায় ‘খালিসা’ জমির পরিমাণ হ্রাস পায়। ফলে  রাজকীয় আয় কমে যায়। এটি সুলতানি সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়।
  • ইক্তা ব্যবস্থাকে তিনি বংশানুক্রমিক করে দেন।
  • তাঁর আমলে ইক্তার হিসাবপরীক্ষার বিষয়টি ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ে।
  • ফিরোজ শাহ তুঘলক সেনাদের নগদ বেতন দেওয়ার পরিবর্তে গ্রামের খাজনা আদায় করার অধিকার দেন। একে বলা হত ওয়াঝ। ঐতিহাসিক আফিফ বলেছেন, ফিরোজ শাহ সমস্ত রাজস্ব, ইত্তা এবং পরগনাগুলি জনগণের মধ্যে বণ্টন করে দেন।

(6) সৈয়দ ও লোদি আমলে ইক্তা ব্যবস্থা: সুলতান ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পর ইস্তার ওপর আর আগের মতো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। সৈয়দ ও লোদি সুলতানদের আমলেও ইক্তা ব্যবস্থার মৌলিক চরিত্রের তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এ সময় থেকে ইস্তার পরিবর্তে ‘সরকার’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

মূল্যায়ন

উক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, সুলতানি যুগে ইক্তা ব্যবস্থার মূল কাঠামোটি অক্ষুণ্ণ থাকলেও বিভিন্ন সুলতানদের আমলে এই ব্যবস্থার মধ্যে নানা পরিবর্তন ঘটেছিল। শক্তিশালী সুলতানেরা ইক্তাদারদের যেভাবে কাঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিলেন, দুর্বল সুলতানদের আমলে তা সম্ভব হয়নি। বিশেষত সুলতান ফিরোজের দুর্বল শাসননীতির ফলে ইক্তা ব্যবস্থার মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা ক্রমশই বাড়তে থাকে। এই ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে জায়গির ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment