মনসবদারি ব্যবস্থা’ কী এবং আকবর পরবর্তী সম্রাটদের আমলে মনসবদারি প্রথার বিবরণ দাও

মনসবদারি ব্যবস্থা’ কী এবং আকবর পরবর্তী সম্রাটদের আমলে মনসবদারি প্রথার বিবরণ দাও

মনসবদারি ব্যবস্থা' কী এবং আকবর পরবর্তী সম্রাটদের আমলে মনসবদারি প্রথার বিবরণ দাও
মনসবদারি ব্যবস্থা’ কী এবং আকবর পরবর্তী সম্রাটদের আমলে মনসবদারি প্রথার বিবরণ দাও

ভূমিকা

মনসবদারি প্রথার উৎপত্তি মধ্য এশিয়ায়। এটি ছিল মূলত একটি পারসিক প্রথা। চেঙ্গিস খান ও তৈমুর লঙের শাসনব্যবস্থায় এই প্রথা ভিন্ন ধারায় প্রচলিত ছিল। এমনকি ভারতে আলাউদ্দিন খলজি ও শেরশাহের আমলেও এই প্রথা কিছুটা স্বতন্ত্র বা পৃথক ধারায় প্রচলিত ছিল বলে একদল ঐতিহাসিক মনে করেন। তবে ভারতে সমগ্র মোগল যুগে যে মনসবদারি ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তার প্রবর্তক ছিলেন সম্রাট আকবর। তিনি ভারতে মনসবদারি ব্যবস্থাকে একটি সুসংবদ্ধ রূপ দেন। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি ও সমকালীন লেখকদের রচনা থেকে মনসবদারি প্রথা সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়।

মনসবদারি ব্যবস্থা 

(1) অর্থ: ‘মনসবদার’ কথাটির উৎপত্তি ‘মনসব’ শব্দ থেকে। মনসব শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল পদ বা পদমর্যাদা (Rank)। এই পদমর্যাদার অধিকারী ব্যক্তিরা মনসবদার নামে পরিচিত। এই অর্থে মোগল প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত উচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তিরা ‘মনসবদার’ নামে পরিচিত ছিলেন।

(2) বৈশিষ্ট্য: আকবরের সময় থেকে সামরিক ও অসামরিক উভয় কাজের ক্ষেত্রেই মনসব প্রদান করা হত। প্রত্যেক মনসবদারকেই তাঁর পদমর্যাদা অনুযায়ী নির্দিষ্টসংখ্যক পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য রাখতে হত। কারণ মনসবদারদের যুদ্ধের সময় সম্রাটকে সৈন্যবাহিনী দিয়ে সাহায্য করতে হত। অধিকাংশ ঐতিহাসিকরা মনে করেন আকবরের আমলে মনসবদারদের ৩৩টি স্তরের অস্তিত্ব ছিল। মনসবদারদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও পদচ্যুতি সবই ছিল সম্রাটের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। মনসবদারদের দুই ভাবে বেতন দেওয়া হত-(1) নগদে এবং (ii) জমি বা জায়গির প্রদানের মাধ্যমে। আকবর এই প্রথায় জাট ও সওয়ার নামক দুটি পদের সংযোজন করেন। এই প্রথা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মোগল প্রশাসনকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা।

আকবর পরবর্তী সম্রাটদের মনসবদারি প্রথা 

(1) জাহাঙ্গিরের আমলে মনসবদারি প্রথা: আকবরের পর মোগল সিংহাসনে বসেন সম্রাট জাহাঙ্গির। তিনি তাঁর পিতা আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি ব্যবস্থাকেই বহাল রাখেন। তবে তিনি এই প্রথায় সামান্য কিছু পরিবর্তন ও সংযোজন করেন। এগুলি হল-(i) জাহাঙ্গির মনসবদারি প্রথায় দু-আস্থা ও শি-আস্পা পদের সংযোজন ঘটান। অর্থাৎ যাঁর অধীনে দুটি ঘোড়া থাকত, তাঁকে বলা হত দু-আম্পা। আর যাঁর অধীনে তিনটি ঘোড়া থাকত, তাঁকে বলা হত শি-আস্পা। দাক্ষিণাত্যের সুবাদার মহাবৎ খাঁ প্রথম এই পদের অধিকার পান। (ii) আকবরের সময়ে মনসবদাররা প্রত্যেক অশ্বারোহী সেনার জন্য বছরে ২৪০ টাকা (দাম) পেতেন। জাহাঙ্গির তা কমিয়ে ২০০ টাকা (দাম) করেন।

(2) শাহজাহানের আমলে মনসবদারি প্রথা: সম্রাট শাহজাহানের আমলে দু-আসপা ও শি-আম্পা পদের সংখ্যা অনেক বেড়েছিল। তিনি এই ব্যবস্থায় কিন্তু পরিবর্তন ঘটান। মনসবদারদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় তাঁদের বেতন সংকোচন করতে তিনি বাধ্য হন। এজন্য তিনি বার্ষিক বেতনের পরিবর্তে মাস অনুপাতে (১০ মাস, ৮ মাস, ৬ মাস) বেতন দেওয়ার রীতি চালু করেন।

(3) ঔরঙ্গজেবের আমলে মনসবদারি প্রথা : পূর্ববর্তী মোগল সম্রাটদের আমলে প্রচলিত মনসবদারি ব্যবস্থা তাঁর আমলেও বহাল ছিল। তবে জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের আমল থেকে মনসবদারদের সংখ্যা ও দুর্নীতি যে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তা তাঁর আমলে চরম আকার ধারণ করে। মনসবদারদের এই দুর্নীতি দূর করতে তিনি দাগ ও চেহরা প্রথাকে আরও কড়াকড়ি করেন।

মূল্যায়ন

সবশেষে বলা যায় যে, মনসবদারি প্রথা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে আকবর একটি বিশাল সৈন্যদল ও দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রবর্তিত ব্যবস্থাই পরবর্তী মোগল সম্রাটদের আমলে প্রচলিত ছিল। তবে আকবরের রাজত্বের শেষ দিক থেকে এই ব্যবস্থায় নানা সংযোজন ও পরিবর্তন ঘটেছিল। কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গির, শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের আমলে ভালো মানের জায়গির লাভের আশায় মনসবদাররা নিজেদের মধ্যে কলহ ও দ্বন্দে লিপ্ত হয়ে পড়েন। ফলে মোগল শাসনের ভিত ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ে। এই কারণে আরভিন, মোরল্যান্ড প্রমুখ একদল ঐতিহাসিক মোগল সাম্রাজ্যের পতনে মনসবদারি ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment