মোগল আমলে মনসবদারি ব্যবস্থার বিবরণ দাও

মোগল আমলে মনসবদারি ব্যবস্থার বিবরণ দাও

অথবা, মোগল আমলে মনসবদারি ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য, ত্রুটি ও গুরুত্ব উল্লেখ করো

মোগল আমলে মনসবদারি ব্যবস্থার বিবরণ দাও
মোগল আমলে মনসবদারি ব্যবস্থার বিবরণ দাও

ভূমিকা

মধ্যযুগে ভারতে মোগলরা প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। বাবর মোগল শাসনের সূচনা করলেও এই সাম্রাজ্যকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন সম্রাট আকবর। একটি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলার পাশাপাশি তিনি মোগল প্রশাসনকে সুসংগঠিত করার উদ্দেশ্যে মনসবদারি প্রথা চালু করেন। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’, সপ্তদশ শতকের বিভিন্ন গ্রন্থ ও সরকারি দলিল-দস্তাবেজ থেকে এই প্রথা সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য জানা যায়।

(1) উদ্ভব: মনসবদারি প্রথার উদ্ভব মধ্য এশিয়ায়। ভারতে এই প্রথা প্রবর্তনের বহুকাল আগে থেকেই মধ্য এশিয়ায় চেঙ্গিস খান ও তৈমুর লঙের শাসনব্যবস্থায় এই প্রথা প্রচলিত ছিল। আবার অনেকের মতে, আলাউদ্দিন খলজি ও শেরশাহের আমলেও এই প্রথা কিছুটা ভিন্ন ধারায় চালু ছিল। তবে আকবরই প্রথম ভারতে এই প্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন।

(2) উদ্দেশ্য: আকবরের মনসবদারি প্রথা প্রবর্তনের পিছনে একাধিক উদ্দেশ্য ছিল। ড. সতীশ চন্দ্র বলেছেন, “মোগল অভিজাত শ্রেণি ও সেনাবাহিনীকে সুসংগঠিত করার উদ্দেশ্যে আকবর এই প্রথা চালু করেন।” আবার অনেকে মনে করেন জায়গিরদারদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও দুর্নীতি দূর করার উদ্দেশ্যেই তিনি এই প্রথা চালু করেছিলেন।

(3) মনসব ও মনসবদারের অর্থ: ‘মনসব’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘পদ’ বা ‘পদমর্যাদা’ (Rank)। এই পদমর্যাদার অধিকারীরা ‘মনসবদার’ নামে পরিচিত। এই অর্থে মোগল প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত উচ্চ পদাধিকারীরা মনসবদার নামে পরিচিত ছিলেন। আকবরের সময় থেকে মনসবদারদের সামরিক দায়িত্বের পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে অসামরিক দায়িত্বও পালন করতে হত।

(4) স্তরবিন্যাস: মনসবদারি প্রথা ছিল একটি স্তরবিন্যস্ত প্রথা। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি-তে পদমর্যাদা অনুযায়ী মনসবদারদের ৬৬টি স্তরের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু বাস্তবে ৩৩টি স্তরের কথা জানা যায়। সর্বনিম্ন মনসবদারদের অধীনে ১০ জন এবং সর্বোচ্চ মনসবদারদের অধীনে ৫ হাজার সৈন্য থাকত। অবশ্য মানসিংহ, টোডরমল, কুলিচ খাঁ প্রমুখ সম্রাটের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিরা ৭ হাজারি এবং নিকটাত্মীয়রা ১০ হাজারি থেকে ১২ হাজারি পর্যন্ত মনসব লাভ করেছিলেন।

(5) জাট ও সওয়ার : মনসবদারি প্রথার সঙ্গে যুক্ত ছিল জাট এবং সওয়ার নামক দুটি পদ। তবে এই দুটি পদের অর্থ বা ব্যাখ্যা নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। ঐতিহাসিক মোরল্যান্ড, আব্দুল আজিজ, ঈশ্বরী প্রসাদ প্রমুখরা মনে করেন ‘জাট’ পদ ছিল মনসবদারদের ব্যক্তিগত পদমর্যাদার প্রতীক এবং সওয়ার ছিল তাঁর অধীনে থাকা অশ্বারোহী বাহিনীর সংখ্যা। আবার অনেকে মনে করেন যে, ‘জাট’ ও ‘সওয়ার’ পদ দুটি ছিল যথাক্রমে পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনীর সূচক।

(6) নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদচ্যুতি: মনসবদারদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদচ্যুতি সব কিছুই ছিল সম্রাটের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। মনসবদারদের নিয়োগ করা হত যোগ্যতার ভিত্তিতে, বংশানুক্রমিকভাবে নয়

(7) বেতন: মনসবদাররা দু-ভাবে বেতন পেতেন। যেসকল মনসবদার নগদ টাকায় (দাম) বেতন পেতেন, তাঁদের বলা হত মনসবদার-ই-নগদি। আর যাঁরা নগদ বেতনের পরিবর্তে ‘জায়গির’ বা জমি বরাদ্দ পেতেন, তাঁদের বলা হত জায়গিরদার বা তুয়ুলদার। ড. সতীশ চন্দ্র উল্লেখ করেছেন একজন ৫ হাজারি মনসবদারের মাসিক বেতন ছিল ৩০ হাজার টাকা (দাম)।

(8) দায়িত্ব : প্রত্যেক মনসবদারকে নির্দিষ্টসংখ্যক পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য পোষণ করতে হত। যুদ্ধের সময় তাঁরা সম্রাটকে সামরিক সাহায্য দিতে বাধ্য থাকতেন। সামরিক দায়িত্বের পাশাপাশি তাঁদের অনেক ক্ষেত্রে বেসামরিক দায়িত্বও পালন করতে হত।

(9) আকবর পরবর্তীকালে মনসবদারি ব্যবস্থা: আকবর পরবর্তী জাহাঙ্গিরের তাঁর আমলে এই ব্যবস্থায় ‘দু-আস্পা’ ও ‘শি-আস্পা’ প্রথা সংযোজন ঘটে। ঐতিহাসিক আব্দুল হামিদ লাহোরী বলেছেন, শাহজাহান মনসবদারের অধীনে মোট সৈন্যসংখ্যার ১/৩ অশ্বারোহী সেনা রাখার নিয়ম চালু করেন। পরে তিনি তা ১/৫ করেন। ঔরঙ্গজেব ‘দাগ’ ও ‘চেহরা’ প্রথা কঠোরভাবে চালু করেন।

ত্রুটি

মনসবদারি প্রথার মধ্যে প্রথাগত নানা ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল, যথা-

  • মনসবদারদের অধিকাংশই ছিলেন অসৎ ও দুর্নীতিপরায়ণ। তাঁদের বেশিরভাগেরই যতসংখ্যক সৈন্য বা অশ্ব রাখার কথা, তা রাখতেন না। তাই ঐতিহাসিক আরভিন বলেছেন, “মোগল সামরিক কাব্যবস্থার মধ্যেই মোগলদের পতনের বীজ নিহিত ছিল।”
  • মনসবদারি ব্যবস্থায় সেনাদের সঙ্গে মনসবদারদের সরাসরি সম্পর্ক ছিল, সম্রাটের সঙ্গে নয়। তাই সম্রাটের প্রতি কোনোদিনই তাদের আনুগত্যের সম্পর্ক তৈরি হয়নি।
  • মনসবদারদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় ‘খালিসা’ (সম্রাটের খাস জমি) জমির পরিবর্তে জায়গির জমির পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পায়। ফলে রাজকোশের আয় ক্রমশই কমতে থাকে।

গুরুত্ব 

মনসবদারি প্রথার কিছু দোষ-ত্রুটি বা কুফল থাকলেও } প্রশাসনে এই প্রথার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। যথা-

  • মনসবদারি প্রথা প্রবর্তনের ফলে মোগল প্রশাসনে উজবেগি, ইরানি, তুরানি, আফগানি প্রভৃতি বিদেশি অভিজাত গোষ্ঠীর একাধিপত্য খর্ব হয়।
  • এই প্রথা প্রবর্তনের দ্বারা মোগল সম্রাটরা অল্প সময়ে এক বিশাল ও শক্তিশালী সৈন্যদল গড়ে তুলেছিলেন।
  • যুদ্ধের সময় মনসবদাররা সৈন্যবাহিনী দিয়ে সম্রাটকে সাহায্য করার ফলে সম্রাটের সামরিক শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

 মূল্যায়ন

মোগল আমলে মনসবদারি প্রথা সম্পূর্ণ এক স্বতন্ত্র ধারায় প্রচলিত ছিল। এই ব্যবস্থার দ্বারা আকবর এক বিশাল মোগল সৈন্যদল ও দক্ষ প্রশাসক শ্রেণি গঠন করেছিলেন। এর পাশাপাশি মোগল প্রশাসনে সম্রাটের নিয়ন্ত্রণ ও চূড়ান্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু আকবর পরবর্তী মোগল সম্রাটদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মনসবদাররা নিজেদের মধ্যে দলাদলিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ সাম্রাজ্যের ভাঙন ত্বরান্বিত হয়।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment