বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য
“ঋতুর দল নাচিয়া চলে
ভরিয়া ডালি ফুলে ও ফলে, নৃত্য-লোল চরণতলে
মুক্তি পায় ধরা ছন্দে মেতে যৌবনেতে রাঙিয়ে ওঠে জরা।” –
– রবীন্দ্রনাথ
ভূমিকা :
রূপময়ী বাংলার প্রকৃতি। এই রূপের জগতে ঋতুর দল নেচে চলে। প্রকৃতির বুকে গ্রীষ্মের প্রকাশ রুদ্ররূপে। আবার কখনও বা শীতল ধারা নেমে আসে গোমুখীর উৎসের মতো প্রেমদাত্রী, দহনজ্বালা মুক্তিরূপী বর্ষা। এরপর আসে উৎসবমুখর অনুপমা শরৎ। এর রেশও ক্ষণিক। কারণ দ্বারে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রশান্তির বার্তা নিয়ে হেমন্ত। এই কি শেষ! না, রয়েছে আবেশ জড়ানো কুয়াশার ঘোমটা দেওয়া শীতের বেশ। তারপরই উদ্দাম হাওয়ার তালে তাল দিতে দিতে প্রাণে নতুন ছোঁয়া জাগিয়ে আসে নব প্রেরণার যৌবনদূত ঋতুরাজ বসন্ত।
রুদ্ররূপী গ্রীষ্ম :
প্রকৃতির রূপভাণ্ডারের প্রথম সৌন্দর্যসম্ভার রুদ্ররূপী গ্রীষ্ম। তার প্রকাশ বছরের প্রথম দুই মাসে অর্থাৎ বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ। খাঁ-খাঁ করে শূন্য প্রান্তর। লেলিহান শিখার মতো ছড়িয়ে পড়ে তার দীপ্তি। এই সময় বৈশাখের রক্তচক্ষু স্নান করে উপস্থিত হয় কালবৈশাখী। একদিকে সুর্যের বহ্নিশিখা, অপরদিকে কালবৈশাখীর পৃথিবী কাঁপানো রণদামামা। গ্রীষ্ম নিজে রুক্ষ শুষ্ক – তবু এই রুক্ষ প্রকৃতি আমাদের উপহার দেয় নানা সরস ফল।
শ্যামলবর্ণা বর্ষা :
রুদ্ররূপী গ্রীষ্ম ধীরে ধীরে কালের নিয়মে চলে যায়। আগমন ঘটে মমতারূপী কোমলস্বভাব বর্ষার। কলাপ বিস্তার করে ঘনধারার স্পর্শ নেয় ময়ূর-ময়ূরী। ভৈরব রাগে বাজতে থাকে ঘন ঘন মেঘের গুরুগম্ভীর রব। বর্ষার নব জলধারায় নদনদী, খালবিলে সর্বত্র প্রাণের জোয়ার। রাতে ভেকের মকমক শব্দ, ঝিঁঝির শব্দ প্রাণে তোলে ভয়মেশানো আনন্দের শিহরন। গ্রামের খড়ো ঘরে বৃষ্টি-ভেজা কৃষকের ঠোঁটে ফোটে হাসি। তবে অতি বর্ষা গ্রামের মানুষকে বিড়ম্বিত করে। নাকাল হয় নগরজীবন। তবুও বর্ষা ঋতুরানি।
অনুপমা শরৎ :
নীল আকাশের বুকে কালো ছায়ার আলপনা সরে যায়। উঁকি দিতে দেখা যায় নীল সুনীল আকাশের মাঝে দিনমণিকে। ‘ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলা।’ কাশ ফুলে ভরা বালুচর। শরতের প্রভাত জেগে ওঠে শিউলির গন্ধে, শিশিরের মৃদু স্পর্শ ঘাসের ডগায় মুক্তোর মালা তৈরি করে। বাতাসে ভেসে বেড়ায় আগমনীর সুর।
ফসল প্রাচুর্যে ভরা হেমস্ত :
শিউলি-ঝরা দিনগুলি হঠাৎ হারিয়ে যায়। কোথা থেকে একরাশ বিষণ্ণ উদাস মূর্তি নিয়ে আবির্ভূত হয় হেমন্ত। এ সময় পল্লির পথে পথে, ‘আঁটি আঁটি ধান চলে ভারে ভার।’ হেমন্তলক্ষ্মীর অকৃপণ দানে দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ। পল্লির ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব।
রিক্ত উদাসী শীত :
হেমন্ত দিনগুলির পরে উত্তরে হিমেল হাওয়াকে সঙ্গী করে চুপি চুপি নেমে আসে বিষণ্ণ শীত। তবে শীতের এই উপস্থিতি সবটাই বিষণ্ণতায় ভরা বা উপেক্ষিত নয়, কারণ শীতের মিঠেকড়া রোদ, নলেন গুড়ের সন্দেশ, পিঠেপুলি, পায়েসের ঘ্রাণ তার সঙ্গে চিড়িয়াখানা, চড়ুইভাতি তো চির আকর্ষণীয় ও আদরণীয়।
ঋতুরাজ বসন্ত :
সবশেষে উপস্থিত হয় ঋতুরাজ বসন্ত। নবযৌবনের অগ্রদূত। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে বনান্তর। কিশলয়ে ভরে ওঠে শাখা-প্রশাখা। কোকিলের কুহুতানে জেগে ওঠে প্রকৃতি। চারিদিকে রঙিন ফুলের বাহার। হোলির রং খেলায় মেতে ওঠে কিশোর-কিশোরী। কিন্তু হায়! এত ক্ষণস্থায়ী। মনের রঙে রঙিন করে বিদায়ের সুর বাজিয়ে চলে যায় বসন্ত। ‘চলে যায়, মরি হায়! বসন্তের দিন চলে যায়।’
উপসংহার :
বাংলার ঋতুরঙ্গশালার এই ছয়টি ঋতুই আপন বৈচিত্র্যে চিরপুরাতন হয়েও যেন চিরনতুন। তাই ষড়ঋতু আমাদের জীবনে, সাহিত্যে, কাব্যে, শিল্পে, সংগীতে সাধনায়, মিলনে- বিরহে, উৎসবে মনে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে।
এই প্রবন্ধের অনুসরণে লেখা যায় : (১) রূপসী বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য (২) বাংলার ঋতুপর্যায়, (৩) বাংলার ঋতু ও পল্লিপ্রকৃতি।