ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো

ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো

ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো
ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো

ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন

দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ইক্তা ব্যবস্থা। ভারতে দিল্লির সুলতানরা এই ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। ইক্তাদারি ব্যবস্থা তুর্কীদের মধ্যে আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ভারতে আসার আগেই তারা এই ব্যবস্থা সম্পর্কে পরিচিত ছিল। ইলতুৎমিসের সময়ে ভারতে ইক্তা ব্যবস্থা বৈধ ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। কালক্রমে প্রাদেশিক শাসনের ভিত্তি হিসেবে ও প্রশাসনের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে ইক্তা প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র অর্জন করে।

ইলতুৎমিসের আমল

  1. ইলতুৎমিসের আমলে ভারতে প্রথম খালিসা জমি সংরক্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়। দিল্লির পার্শ্ববর্তী কিছু অঞ্চল এবং দোয়াবের কিছু অংশ খালিসার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
  2. ইলতুৎমিস এই জমির রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব তুর্কি সেনাপতিদের হাতে অর্পণ করেন।
  3. এই ভূখণ্ডের রাজস্বকে সেনাবাহিনীর ভরণ- পোষণ ও সেনানায়কদের বেতন হিসেবে গণ্য করা হত।
  4. এই ব্যবস্থাকে ভারতে ইক্তা প্রথার আদিপর্ব বলা যায়। এই সময় জমির প্রাপকের কাছে কোনও রাজস্ব অর্থ দিল্লি দাবি করত না।
  5. ইক্তার প্রাপকদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের প্রবণতা এবং সুলতানের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই ইলতুৎমিস মুকৃতিদের অধীন ইকতা জমি বদলি করার নীতি নেন।

গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমল

ইলতুৎমিসের মৃত্যু এবং গিয়াসউদ্দিন বলবনের সিংহাসনে বসার মধ্যবর্তীকালে (১২৩৬-১২৬৬ খ্রিস্টাব্দ) ইক্তা ব্যবস্থা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। বলবন কঠোর হাতে ইতা ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা পুনঃপ্রবর্তনের উদ্যোগ নেন। এজন্য তিনি-

  1. রাষ্ট্রের অধীনে জমি ও ভাতা ভোগ করা সত্ত্বেও যেসকল মুক্তি প্রয়োজনে সুলতানকে সামরিক সাহায্য প্রদান করতেন না, তাদের তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে মৃত এবং বৃদ্ধ মুক্তিদের বরাদ্দ করা ইক্কা কেড়ে নেন। যদিও শেষপর্যন্ত বৃদ্ধদের ইক্তা বহাল রাখা হয়। বলবন মূলত শারীরিকভাবে সক্ষম ও উপযুক্ত ব্যক্তিদেরই রাজস্ব ভোগের অধিকার দেন।
  2. মুক্তির কাছ থেকে ইক্তার উদ্বৃত্ত রাজস্ব দিল্লিতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
  3. ইক্তার রাজস্বের আয়ব্যয়ের সঠিক হিসাব পরীক্ষার জন্য খোয়াজা নামক কর্মচারী নিয়োগ করেন।

আলাউদ্দিন খলজির আমল

আলাউদ্দিন খলজির সময় সাম্রাজ্যের পরিধি আরও বিস্তার লাভ করে। বলবনের নীতি থেকে কিছুটা সরে এসে ইক্তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তিনিও কিছু নতুন নীতি অবলম্বন করেন, সেগুলি হল-

  1. সুলতান দিল্লির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে খালিসায় পরিণত করেন এবং দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে ইক্তা ব্যবস্থা বজায় রেখে রাজস্ব সংগ্রহের ব্যবস্থাকে সুনিশ্চিত করেন।
  2. সুলতানের অশ্বারোহী সেনাবাহিনীকে ইকতা দানের বদলে নগদে বেতন প্রদানের ব্যবস্থা করা হয় এবং অন্যদিকে সুলতানের সেনাপতি বা সৈন্যবাহিনীর উচ্চশ্রেণির আধিকারিকদের ক্ষেত্রে ইক্তা প্রদান বহাল থাকে। স্থির হয় যে, দেওয়ান-ই-ওয়াজিরৎ বিভাগ মুক্তিদের দেওয়া ইক্তার মোট রাজস্ব নির্ধারণ করবে।
  3. ইক্তার ভূখণ্ডকে দু’ভাগে ভাগ করে এক ভাগ থেকে সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ ও সেনাদের বেতন প্রদান এবং দ্বিতীয় ভাগ থেকে মুক্তির প্রশাসনিক অর্থব্যয় নির্দিষ্ট করা হয়।
  4. সেনাবাহিনীর ব্যয় এবং মুক্তি ও ইক্তার ব্যয়সংকুলানের পর উদ্বৃত্ত রাজস্ব সুলতানের দফতরে জমা দিতে বলা হয়।
  5. প্রতিটি ইক্তার নিয়মিত বার্ষিক আয়ব্যয় পরীক্ষার উপর জোর দেওয়া হয় এবং হিসাবে কারচুপি কিংবা উদ্‌বৃত্ত রাজস্ব দিল্লিতে জমা দেওয়ার কাজে গাফিলতি ধরা পড়লে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়।

গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের আমল

গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ইকতা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের বদলে নীতির কঠোরতা শিথিল করে দেন এবং কয়েকটি সংশোধনীমূলক নীতি গ্রহণ করেন। যেমন- মুক্তিরা তাদের অধীনস্থ কর্মচারীদের প্রাপ্য বেতনের এক শতাংশও কম দিতে পারবেন না। পাশাপাশি মুকৃতিদের কর্মচারীরাও প্রাপ্ত বেতনের অতিরিক্ত অর্থ সংগ্রহ করলেও তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না।

মহম্মদ বিন তুঘলকের আমল

মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে ইক্তা ব্যবস্থায় কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটে।

  1. এসময় রাজস্ব আদায় এবং সেনা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পৃথক করে দেওয়া হয়।
  2. রাজস্ব আদায়ের ভার নিলাম ডেকে সর্বোচ্চ নিলামদারকে ইজারা (Contract) দেওয়া হয়। ইজারাদারকে সেনাবাহিনী পোষণের দায়িত্ব পালন করতে হত না।
  3. সর্বনিম্নে সিপাহশালার থেকে ঊর্ধ্বক্রমে খান পদমর্যাদার সেনানায়করা বেতন বাবদ ইক্তা বরাদ্দ পেতেন। সাধারণ সেনাদের নগদ টাকায় বেতন দেওয়া হত।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমল

মহম্মদ বিন তুঘলক ইক্তা ব্যবস্থায় বিভিন্ন নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে যে কঠোরতা দেখিয়েছিলেন, তা ইক্‌তাদারদের অসন্তুষ্ট করেছিল। সেকারণে ফিরোজ শাহ তুঘলক তাদের সন্তুষ্ট করতে কতকগুলি কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তবে এতে ইক্তা ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামো ভেঙে পড়ে।

  1. তিনি অভিজাতদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা প্রচুর বৃদ্ধি করলে তার প্রভাব পড়ে ইক্তা ব্যবস্থাতেও। যেমন- খান পদমর্যাদার একজন অভিজাতের বার্ষিক বেতন ২ লক্ষ তঙ্কা থেকে বেড়ে হয় ৪ থেকে ৮ লক্ষ তঙ্কা।
  2. সেনাবাহিনীর সকল সদস্যকে নগদ অর্থের বদলে বেতন খাতে ইক্কা বরাদ্দ করা হয়।
  3. গ্রামাঞ্চলে সেনারা জমির খাজনা আদায় করে নিজেদের বেতন সংগ্রহের অধিকার পায়। একে বলা হত ওয়াঝ বা মোয়াজব (অর্থাৎ বেতনের বিকল্প)।
  4. ফিরোজ শাহ সরকারিভাবে ইক্তার উপর মুক্তির বংশানুক্রমিক অধিকার মেনে নেন।
  5. ইক্তার আয় বার্ষিকভাবে নির্ধারণের পরিবর্তে সমগ্র শাসনকালের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।

লোদি বংশের আমল

ফিরোজ শাহ তুঘলক যেভাবে ইক্তার উপর সুলতানের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেছিলেন তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। লোদি বংশের শাসনকালে (১৪৫১-১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ) ইক্তা ব্যবস্থার নতুন কোনও পরিবর্তন ঘটেনি।

  1. তবে এই সময় ইক্তা-র পরিবর্তে সরকার নাম ব্যবহার করা হয়। কয়েকটি পরগনা নিয়ে একটি সরকার গড়ে উঠত।
  2. মূলত অনুমানের ভিত্তিতে এসময় প্রত্যেক ‘সরকার’-এর মোট রাজস্ব (জমা) দিল্লির দফতর স্থির করে দিত। এই জমা সরকার হিসেবে বিশিষ্ট অভিজাতদের বন্দোবস্ত দেওয়া হত এবং এরই ভিত্তিতে গ্রহীতার দায়িত্ব ও কর্তব্য স্থির করা হত। সরকারের প্রাপক তাঁর প্রাপ্ত ভূখণ্ড ছোটো ছোটো অংশে ভাগ করে ইজারা বন্দোবস্ত দিতে পারতেন।

সবশেষে, অধ্যাপক আশরাফের মন্তব্যকে দিয়ে আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটানো যায়। তিনি বলেছেন, ‘ক্রমাগত একের পর এক দুর্বল সুলতান সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে ইক্তার অধিকারী নিরবচ্ছিন্নভাবে ইক্তা ভোগদখলের সুযোগ পেত এবং তার ফলে ওই জায়গির প্রায় তার নিজস্ব ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে দাঁড়াত।’ ফলস্বরূপ ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থা অবসানের পথে এগিয়ে যায়।

আরও পড়ুন – গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো

Leave a Comment