আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি প্রথার বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব বিশ্লেষণ করো

আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি প্রথার বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব বিশ্লেষণ করো

আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি প্রথার বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব বিশ্লেষণ করো
আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি প্রথার বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব বিশ্লেষণ করো

ভূমিকা

মোগল সম্রাট আকবর ছিলেন শাসক হিসেবে অত্যন্ত দক্ষ, বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তাঁর নেতৃত্বেই ভারতে এক  বিশাল মোগল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। সাম্রাজ্য গঠনের পাশাপাশি তিনি মোগল শাসনকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি নানা শাসনতান্ত্রিক পরীক্ষানিরীক্ষা ও প্রশাসনিক সংস্কার করেছিলেন। তাঁর এই প্রশাসনিক সংস্কারগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিল মনসবদারি প্রথার প্রবর্তন।

মনসবদারি প্রথার বৈশিষ্ট্য

আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি ও সপ্তদশ শতকের কিছু গ্রন্থ থেকে মনসবদারি প্রথা সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায়। এইসকল তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই মনসবদারি প্রথার কতকগুলি গরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন আব্দুল আজিজ, শিরিন মুসভি, আতাহার আলি, সতীশচন্দ্র, ইরফান হাবিব প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ। আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি প্রথার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

(1) ‘মনসব’ ও ‘মনসবদার’: ‘মনসবদার’ কথাটির উৎপত্তি আরবি ‘মনসব’ শব্দ থেকে। মনসব শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘পদমর্যাদা’  (Rank)। এই পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা ‘মনসবদার’ নামে পরিচিত। এই অর্থে মোগল প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত উচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তিদের ‘মনসবদার’ বলা হয়।

(2) স্তরবিন্যাস প্রথা: ‘আইন-ই-আকবরি’তে মনসবদারদের ৬৬টি স্তরের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু বাস্তবে পদমর্যাদা অনুযায়ী তাঁদের ৩৩টি স্তরের কথা জানা যায়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক অনিল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন- “আকবর সম্ভবত ৬৬টি স্তরের পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু বাস্তবে ৩৩টি স্তর গঠন করতে পেরেছিলেন।” সর্বনিম্ন মনসবদারের অধীনে ১০ জন, সর্বোচ্চ মনসবদারের অধীনে ৫ হাজার সৈন্য থাকত। তবে মানসিংহ, টোডরমল, কুলিচ খাঁ প্রমুখ আকবরের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিরা সাত হাজারি মনসব দ্বারা সম্মানিত হয়েছিলেন। এমনকি সম্রাটের নিকট আত্মীয়দের কেউ কেউ দশ হাজারি বা তারও বেশি মনসবদারের পদ পেতেন।

(3) জাট ও সওয়ার : মনসবদারি প্রথার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবেই যুক্ত ছিল ‘জাট’ ও ‘সওয়ার’ নামক দুটি পদ। কিন্তু এই দুটি পদের অর্থ বা ব্যাখ্যা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা বিতর্ক আছে। ঐতিহাসিক আরভিন, ঈশ্বরী প্রসাদ, অনিরুদ্ধ রায় প্রমুখরা মনে করেন যে, ‘জাট’ পদ দ্বারা মনসবদারের ব্যক্তিগত পদমর্যাদা ও বেতনকে বোঝায়। আর সওয়ার ছিল তাঁর অধীনে থাকা অশ্বারোহী বাহিনীর সংখ্যা। আবার অনেকের মতে, জাট ও সওয়ার পদ দুটি ছিল যথাক্রমে পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনীর সূচক।

(4) নিয়োগ, বদলি ও পদচ্যুতি: আকবরের আমল থেকেই মনসবদারদের নিয়োগ বদলি, পদোন্নতি ও পদচ্যুতি সব কিছুই ছিল সম্রাটের – মর্জির ওপর নির্ভরশীল। মনসবদারদের নিয়োগ করা হত যোগ্যতার ভিত্তিতে, বংশানুক্রমিকভাবে নয়। কোনো মনসবদার সঠিকভাবে তাঁর দায়িত্ব বা কর্তব্য পালন করতে না-পারলে সম্রাট যে-কোনো সময় তাঁকে বদলি কিংবা পদচ্যুত করতে পারতেন।

(5) বেতন ব্যবস্থা: মনসবদারদের দু-ভাবে বেতন দেওয়া হত। যেসকল মনসবদার নগদ টাকায় (দাম) বেতন পেতেন তাঁদের বলা হত মনসবদার-ই-নগদি। আর যাঁরা বেতন বাবদ জমি বরাদ্দ পেতেন, তাঁদের বলা হত ‘জায়গিরদার’।

(6) দাগ ও চেহরা প্রথা: মনসবদারদের অনেকেই ছিলেন অসৎ ও সুযোগসন্ধানী। অনেক সময়ই তাঁরা নির্দিষ্টসংখ্যক সৈন্য ও অশ্ব রাখতেন না। সেনাবাহিনীর মধ্যে এই দুর্নীতি রোধ করার জন্য আকবর ‘দাগ’ ও ‘চেহরা’ প্রথা চালু করেন।

(7) সামরিক ও বেসামরিক দায়িত্ব পালন: পদমর্যাদা অনুযায়ী প্রত্যেক মনসবদারকেই তাঁদের নির্দিষ্টসংখ্যক পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী পোষণ করতে হত। যুদ্ধের সময়ে তাঁরা সম্রাটকে এই সৈন্যবাহিনী দিয়ে সাহায্য করতে বাধ্য থাকতেন। মনসবদারদের সামরিক সাহায্যের পাশাপাশি নানা বেসামরিক কাজ বা দায়িত্বও পালন করতে হত।

গুরুত্ব

মোগল প্রশাসনিক ব্যবস্থায় মনসবদারি ব্যবস্থার গুরুত্বগুলি হল-

(1) দক্ষ প্রশাসন গঠন: আকবর মনসবদারি প্রথা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে মোগল অভিজাত ও সৈন্যবাহিনীকে সুসংগঠিত করেছিলেন। তা ছাড়া মনসবদারদের নিয়োগ করা হত যোগ্যতার ভিত্তিতে। তাই এই ব্যবস্থার মাধ্যমে অনেকটাই দুর্নীতিমুক্ত ও দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল।

(2) বিশাল সৈন্যদল গঠন: প্রত্যেক মনসবদারের নির্দিষ্টসংখ্যক পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য পোষণ বাধ্যতামূলক ছিল। তাই এই প্রথা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে আকবর অল্প সময়ে একটি বিশাল ও শক্তিশালী সৈন্যদল গঠন করতে পেরেছিলেন।

(3) সম্রাটের ক্ষমতা ও শক্তি বৃদ্ধি: মনসবদাররা যুদ্ধের সময় সৈন্যবাহিনী দিয়ে সাহায্য করে সম্রাটের হাত শক্ত করতেন। ফলে সামরিক ক্ষেত্রে সম্রাটের শক্তি ও ক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

(4) সাম্রাজ্যের সংহতির সহায়ক: সম্রাটের ইচ্ছার ওপর মনসবদারদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করত। তাই তাঁরা সম্রাটের প্রিয়পাত্রে পরিণত হওয়ার চেষ্টা করতেন। ফলে সম্রাটের প্রতি তাঁদের আনুগত্য বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা সাম্রাজ্যের সংহতির সহায়ক হয়েছিল।

(5) মোগল-রাজপুত মৈত্রী প্রতিষ্ঠা: আকবর তাঁর একান্ত বিশ্বাসভাজন মানসিংহ, টোডরমল প্রমুখ রাজপুতদের উচ্চ মনসব দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। ফলে মোগল-রাজপুত মৈত্রী সুদৃঢ় হয়েছিল।

মূল্যায়ন

সবশেষে বলা যায় যে, মোগল সামরিক ও অসামরিক প্রশাসনকে সুসংগঠিত করার উদ্দেশ্যেই আকবর এই প্রথা চালু করেছিলেন। এই প্রথা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে মোগল প্রশাসনে সম্রাটের { চূড়ান্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment