পরিবর্তনশীল ঐতিহ্য প্রশ্ন উত্তর
প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনে ফিলিপ মেলাংকখন এর ভূমিকা
লুথারবাদের বিবর্তনের প্রথম পর্যায়ে মার্টিন লুথারের বেশকিছু ঘনিষ্ঠ অনুচর প্রচারাভিযানের মাধ্যমে এক রাজনৈতিক মতাদর্শ তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যেই অন্যতম ছিলেন ফিলিপ মেলাংকথন (Philip Melanchthon, ১৪৯৭-১৫৬০ খ্রিস্টাব্দ)। মার্টিন লুথারের অন্যতম অনুগামী এই বিশিষ্ট জার্মান নেতা শান্ত, সংযত ও উদারপন্থী এক পণ্ডিত, যাঁর মধ্যে লুথারের মতো দোদুল্যমানতা ছিল না। সংস্কার আন্দোলনে তাঁর বিশেষ অবদান হল স্বাভাবিক আইন (Natural Law) সম্পর্কিত ধারণার প্রতিষ্ঠা ও প্রচার।
(1) মতবাদ
মেলাংকথনের মতে, স্বাভাবিক আইন হল সেই সকল নীতি, যা ঈশ্বর মানুষের মনে বপন করেছেন। এই নীতির অন্যতম দিকগুলি হল, ঈশ্বরে বিশ্বাস এবং তাঁর ইচ্ছা সম্পর্কে সচেতনতা, ঈশ্বরের আনুগত্য, রাষ্ট্রের মধ্যে ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতিফলন। তিনি বিখ্যাত The Tenth Article রচনার মাধ্যমে স্বাভাবিক আইন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তাঁর মতে, রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তাই তিনি রাষ্ট্রচালনার পাশাপাশি স্বাভাবিক আইনেরও রক্ষক। চার্চ বিপথগামী হলে রাষ্ট্র চার্চকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারী। তাই রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ সকলের অবশ্য কর্তব্য।
(2) মেলাংকথনের বক্তব্যের সীমাবদ্ধতা
মেলাংকথনের বক্তব্যের অন্যতম দুর্বলতা এটাই যে, প্রোটেস্ট্যান্টবাদী রাজা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অনাচারী হলে কীভাবে তার প্রতিবাদ করা হবে, এ বিষয়ে তিনি নীরব থেকেছেন।
প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনে উলরিখ জুইংলির ভূমিকা
জার্মানিতে মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের বিস্তারের পাশাপাশি সুইটজারল্যান্ডেও তা ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। এক্ষেত্রে উলরিখ জুইংলি (Ulrich Zwingli, ১৪৮৪-১৫৩১ খ্রিস্টাব্দ)-এর ভূমিকা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
(1) প্রথম জীবন
জাতিতে জার্মান জুইংলি ভিয়েনা ও বাসেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষালাভ করেন। পাশাপাশি গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষাতেও তিনি যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তিনি ছাত্রাবস্থায় মানবতাবাদী পণ্ডিত কনরাড কেল্টিস (Conrad Celtes)-এর কাছে যুক্তিবাদে দীক্ষিত হন। এরপর ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দে জুইংলি জুরিখের প্রধান পুরোহিত পদে নিযুক্ত হন। এই সময় থেকেই সুইটজারল্যান্ডের ক্যাথলিক চার্চের দুর্নীতি ও অনাচার দেখে ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু করেন তিনি।
(2) মতবাদ
জুইংলি মনে করতেন যে, ক্যাথলিক ধর্মমতের সংস্কার প্রয়োজন এবং এই কাজে চার্চ নয়, সরকারের উদ্যোগই যথার্থ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ধর্ম ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলারক্ষার জন্য লোকায়ত প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ, সরকারের সদর্থক ভূমিকা জরুরি। উইলিয়ম ডানিং-এর মতে, জুইংলি চার্চ ও রাষ্ট্রকে একক ধর্মীয় সংগঠনে সমন্বিত করেছিলেন।
(3) পোপতন্ত্রের বিরোধিতা
মার্টিন লুথারের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উলরিখ জুইংলি সুইটজারল্যান্ডে ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দে Indulgence বা পাপমুক্তির ছাড়পত্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি জুরিখের ধর্মসভায় ৬৭টি নিবন্ধ (67 Theses) প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, বাইবেল যেহেতু ঈশ্বরের বাণী, তাই তা অভ্রান্ত এবং স্বয়ং পোপও এর পরিবর্তন করতে পারেন না। জুইংলি বিভিন্ন ক্যাথলিক আচার যেমন, উপবাস, যাজকদের ব্রহ্মচর্য, তীর্থভ্রমণ, নরক ও প্রায়শ্চিত্ত -এই সবকিছুকে আক্রমণ করেন। সমস্ত প্রতীক, ক্রুশ, মন্ত্রণাগান বাতিল করার পরামর্শ দেন।
(4) খ্রিস্ট ধর্মের শুদ্ধতা রক্ষা
খ্রিস্ট ধর্মের শুদ্ধতা রক্ষার জন্য জুইংলি জুরিখ শহরে প্রিভি কাউন্সিল নামক একটি সভা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়ে বলেন যে, এই সভা চার্চ ও রাষ্ট্রপরিচালনা করলে চার্চের দুর্নীতি কমবে এবং রাষ্ট্র জনগণের স্বার্থে কাজ করতে উদ্যত হবে। এ ছাড়া তিনি প্রস্তাব দেন যে, যাজকদের বিবাহের স্বাধীনতা স্বীকার করা হলে তাঁরা চারিত্রিক কলুষতামুক্ত হবেন এবং চার্চের অনাচারও বন্ধ হবে। তাঁর এই আদর্শ ও কার্যকলাপের ফলে সুইটজারল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের বিশেষ প্রসার ঘটে।
(5) ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
১৫২৯ খ্রিস্টাব্দ থেকেই সুইটজারল্যান্ডের ক্যাথলিক চার্চ জুইংলি এবং প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে শুরু করে। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে জুইংলির পরামর্শে সুইস পার্লামেন্ট ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে সম্মত হয়। শেষপর্যন্ত ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে ক্যাঙ্গেল (Kappel) নামক এক স্থানে সংঘটিত এক যুদ্ধে জুইংলি স্বয়ং ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এই যুদ্ধে জুইংলি মারা যান।
অবশ্য জুইংলির সুইটজারল্যান্ড ও দক্ষিণ জার্মান কেন্দ্রিক প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন সমগ্র খ্রিস্টান জগতের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সুইটজারল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ধর্মসহিষ্ণুতার বাতাবরণ, যা তৎকালীন পরিস্থিতিতে কম তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না। বিশিষ্ট পণ্ডিত ও রাষ্ট্রনীতিবিদ রেমন্ড গেটেল (Raymond Gettell)-এর মতে, জুইংলি ছিলেন- “More of a humanist and more radical than Luther.”
প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনে জন ক্যালভিনের ভূমিকা
প্রোটেস্ট্যান্টবাদের প্রবর্তক মার্টিন লুথার হলেও এই ধর্মের প্রচার ও প্রসারের কাজে জন ক্যালভিন (John Calvin, ১৫০৯-১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দ)-এর বিশেষ অবদান রয়েছে। তাঁর মতাদর্শ ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পরবর্তী প্রায় দুশো বছর পর্যন্ত টিকেছিল।
(1) প্রথম জীবন
অধ্যাত্ম ও আইনবিদ্যায় গভীর জ্ঞানের অধিকারী জন ক্যালভিনের জন্ম হয় প্যারিসের নিকটবর্তী নোয়ন (Noyon) শহরে। ধ্রুপদি সাহিত্য, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ এবং সম্ভদের জীবনী পড়ে তিনি চার্চের সংস্কার করার কথা চিন্তা করেন। অবশ্য ক্যাথলিকদের ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে তিনি ফ্রান্সে তাঁর মতবাদ প্রচার করতে পারেননি। দেশত্যাগ করে ক্যালভিন সুইটজারল্যান্ডে চলে যান এবং জেনেভা শহরকে কেন্দ্র করে ধর্মপ্রচারের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ডিউক অফ স্যাভয় (Duke of Savoy) ও তাঁর অনুগৃহীত বিশপের বিরুদ্ধে জেনেভার জনগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করলে ক্যালভিন সেই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন।
(2) ক্যালভিনের মতাদর্শ
- খ্রিস্টান ধর্মের পবিত্রকরণ: জন ক্যালভিন ছিলেন সহজসরল জীবনাদর্শে বিশ্বাসী যুক্তিবাদী এক পণ্ডিত। তৎকালীন চার্চ ও যাজকতন্ত্রের দুর্নীতির বিরোধিতা করে তিনি খ্রিস্ট ধর্মকে পূর্বের পবিত্রতার সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যোগী হন। তিনি মনে করতেন যে, মানুষের পবিত্র। ব্যক্তিজীবনই হল পবিত্র সমাজজীবনের বুনিয়াদ। উপাসনা, তীর্থযাত্রা বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দ্বারা এবং ঈশ্বর অনুগ্রহের দ্বারাই মানুষের আত্মার মুক্তি ঘটে।
- পূর্ব নির্ধারণবাদ : ম্যাকিয়াভেলির মতোই মানুষ সম্পর্কে ক্যালভিনের ধারণা ছিল হতাশাব্যঞ্জক। তাঁর চোখে মানুষ পাপী, দুর্বৃত্ত ও কপট। তাই মানুষ নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণের অধিকারী নয়। মানুষের জীবন ঈশ্বর কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত, পূর্বপরিকল্পিত। ক্যালভিনের এই তত্ত্ব পূর্ব নির্ধারণবাদ (Pre Destination) বা অদৃষ্টবাদ নামে পরিচিত। এর মূল অর্থ হল, ঈশ্বর সর্বজ্ঞ ও সর্বদর্শী।
- ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ: ক্যালভিনের মতে, মানুষ দুটি নিয়মের অধীন- আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ এবং পার্থিব বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ। প্রথমটি থেকে মানুষ সৎ শিক্ষা, সরল জীবন ও সদ্ধর্মের পথে চালিত হবে। ঈশ্বরের বাণী ও শিক্ষা এই জীবন নিয়ন্ত্রণের শেষ কথা। দ্বিতীয় নিয়ন্ত্রণ মানুষের পার্থিব জীবনকে শৃঙ্খলার পথে চালিত করবে।
- অপ্রতিরোধ তত্ত্ব : প্রথমে ক্যালভিন অপ্রতিরোধ তত্ত্ব (Doctrine of absolute non-resistance)-এ বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে, ঈশ্বরের অনুগ্রহে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরোধিতা উন্মত্ততা ও বর্বরতার নামান্তর। কারণ, রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে ঈশ্বর থেকে, এর শাসক হলেন ঈশ্বরেরই প্রতিনিধি। সুতরাং রাষ্ট্র নির্মম হলেও তার বিরোধিতা কাম্য নয়। পরে তিনি এই মতের কিছু সংশোধন করেন। ফ্রান্সে তাঁর অনুগামী হিউগেনট (Hugenot)-রা সরকারি নির্যাতনের শিকার হলে ক্যালভিন প্রতিরোধ তত্ত্বতে আস্থা জানান। তবে সাধারণ মানুষ নয়, বিধর্মী ও অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে প্রিন্সেস অফ ব্লাড (অভিজাত)-রা পার্লামেন্ট দ্বারা সমর্থিত হয়ে রাজার স্বেচ্ছাচার প্রতিরোধ করলে তা বৈধ বিবেচিত হবে।
(3) পুস্তিকা প্রকাশ
জন ক্যালভিন লুথার, মেলাংকথন প্রমুখ সংস্কারকদের মতোই প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের উপর গ্রন্থ লিখতে প্রয়াসী হন, যার ফলস্বরূপ ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়া জাগানো গ্রন্থ Institutes of the Christian Religion. এই গ্রন্থে ক্যালভিনের রোমান চার্চব্যবস্থার সংস্রব বর্জিত একটি বিকল্প ধর্মসংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য, প্রকৃতি ও কর্মধারার বর্ণনা করা হয়েছে। ক্যালভিন রচিত এই গ্রন্থটি ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের পক্ষে এক জোরালো সওয়াল। এখানে প্রকাশিত তাঁর বক্তব্যসমূহ ছিল- ‘A True Theory of the State’, গ্রন্থটি তিনি ফরাসিরাজ ফ্রান্সিসকে উৎসর্গ করেন। এই পুস্তক একদিকে ছিল ক্যাথলিক পোপতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ এবং অন্যদিকে রাজা ফ্রান্সিসের প্রতি কিছু উপদেশ। যাজক শ্রেণির মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা ছাড়া ধর্মচর্চা করা সম্ভব নয়- ক্যাথলিকদের এই প্রচার যে ভ্রান্ত, সেকথা ক্যালভিন প্রমাণ করেছিলেন।
(4) চার্চব্যবস্থার পুনর্গঠন
চার্চব্যবস্থার পুনর্গঠন প্রসঙ্গে ক্যালভিন বলেন যে, চার্চ পরিচালনার দায়িত্ব ও অধিকার কেবলমাত্র যাজকদের থাকবে না। ৫ জন যাজক এবং ১২ জন অযাজক খ্রিস্টানদের নির্বাচিত সভার হাতে দেওয়ার কথা বলেন তিনি। শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে যাজকেরা অভিযুক্ত হলে তিনি তাদের কঠোর শাস্তিপ্রদানের ব্যবস্থাও করতেন।
(5) বাইবেলের গুরুত্ব প্রচার
বাইবেলের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে ক্যালভিন বাইবেলের আইনকে ‘রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বোচ্চ আইন’ বলে মনে করতেন। আলোচ্য কালপর্বে ক্যালভিন ও তাঁর সহযোগীরা একলেজিয়াসটিক্যাল অর্ডিন্যান্স (Ecclesiastical Ordinances, ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দ) বা ধর্মীয় অধ্যাদেশ দ্বারা চার্চ ও রাষ্ট্রপরিচালনার ব্যবস্থা করেন। এদিক থেকে বিচার করলে জন ক্যালভিনকে চার্চব্যবস্থার সংগঠনে গণতন্ত্রের প্রবর্তক বলে অভিহিত করা যায়।
(6) আদর্শ চার্চ রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন
জন ক্যালভিন জেনেভাতে আদর্শ চার্চ-রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন করেছিলেন, যার ছিল দুটি শাখা- কাউন্সিল অফ মিনিস্টারস (Council of Ministers) এবং কনসিসটোরি (Consistory)। এই দুই শাখা নিয়ে তিনি যে সুপ্রিম কাউন্সিল (Supreme Council) গঠন করেছিলেন, সেই কাউন্সিলই চার্চ ও রাষ্ট্রপরিচালনার অধিকার লাভ করেছিল। এই ধরনের চার্চ-রাষ্ট্র জুরিখ ও বার্নে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
(7) ক্যালভিনের মতাদর্শের প্রসার
জন ক্যালভিনের ব্যক্তিগত আচার-আচরণ ও বক্তব্য খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করে, ফলে প্রোটেস্ট্যান্টবাদ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর অনুগামীরা ফ্রান্সে হিউগেনট (Huguenots), ইংল্যান্ডে পিউরিটান (Puritans) এবং স্কটল্যান্ডে প্রেসবিটারিয়ান (Presbyterians) নামে পরিচিত হন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ক্যালভিন ছিলেন লুথারের অপ্রতিরোধ তত্ত্বে বিশ্বাসী। প্রথমদিকে লুথারবাদ চরম রক্ষণশীল প্রকৃতির হলেও পরবর্তীতে তা ক্রমে র্যাডিক্যাল হয়ে ওঠে। আর এই র্যাডিক্যাল লুথারবাদের প্রভাব যখন ক্যালভিনের কিছু অনুগামীদের উপর পড়ল, তখন তাঁরাও সেই উদ্দীপনায় অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অধিকারকেই অগ্রাধিকার দিলেন। আর এইভাবেই র্যাডিক্যাল ক্যালভিনীয়বাদ হিউগেনট, পিউরিটান, প্রেসবিটারিয়ানদের মাধ্যমে ইউরোপে প্রতিষ্ঠালাভ করতে থাকল।
লুথার ও ক্যালভিনের মতাদর্শের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য
(1) সাদৃশ্য
পশ্চিম ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের দুটি অগ্রণী নাম হল মার্টিন লুথার ও জন ক্যালভিন। এঁদের চিন্তাধারার কয়েকটি ক্ষেত্রে সাদৃশ্য লক্ষণীয়। যথা-
- ধর্মসংস্কারের এই দুই প্রাণপুরুষ ঈশ্বরকেই সর্বশক্তিমান হিসেবে মান্য করতেন এবং বাইবেলের অভ্রান্ততার প্রতি আস্থা রাখতেন।
- এঁদের মতে, চার্চের নিয়মনীতি বাইবেলকে অনুসরণ করেই গড়ে তোলা উচিত।
- লুথার এবং ক্যালভিন মনে করতেন যে, চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশ ঘটে।
- পাশাপাশি বিশ্বাসের দ্বারাই যে মানুষের প্রকৃত মুক্তিলাভ সম্ভব, এ বিষয়েও উভয়ে একমত ছিলেন।
(2) বৈসাদৃশ্য
মার্টিন লুথার ও জন ক্যালভিন দুজনেরই লক্ষ্য ছিল ক্যাথলিক চার্চকে কুসংস্কার ও অনাচারমুক্ত করা। দুজনেই ছিলেন প্রোটেস্ট্যান্টবাদের প্রচারক। তবুও তাঁদের মতাদর্শের কিছু কিছু পার্থক্য লক্ষণীয়।
- লুথার মনে করতেন যে, ঈশ্বর ও বিশ্বাসী মানুষের সম্পর্কের মাধ্যম হিসেবে চার্চের কোনও ভূমিকা নেই। কিন্তু ক্যালভিন এই সম্পর্কের মধ্যস্থ হিসেবে এক বিমূর্ত চার্চের রূপ কল্পনা করেছেন।
- মার্টিন লুথার Sacrament অনুষ্ঠানের গুরুত্ব স্বীকার করতেন। কিন্তু ক্যালভিন মনে করতেন, এমন আচার অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রয়োজনীয় ও ভ্রান্ত।
- লুথার তাঁর আন্দোলনের সাফল্যের জন্য জার্মান রাজন্যবর্গের সমর্থন আবশ্যিক মনে করতেন। কিন্তু ক্যালভিন এজন্য মূলত নির্ভর করতেন উদীয়মান বুর্জোয়া, ভূস্বামী জেস্ট্রি, অভিজাত ও ব্যবসায়ী, কারিগর ইত্যাদি উৎপাদক শ্রেণির উপরে।
- মার্টিন লুথার ব্যাবসাবাণিজ্যকে স্বাভাবিক বৃত্তিরূপে মেনে নেননি। তিনি ঋণদান, সুদগ্রহণ ইত্যাদিকে অধর্মীয়, অনৈতিক মনে করতেন। কিন্তু ক্যালভিন যুগধর্ম অনুসারে ব্যাবসাবাণিজ্যকে সৎকর্ম বলে স্বীকৃতি দেন।
- লুথার শাসকের বিরুদ্ধে প্রজাদের অপ্রতিরোধ তত্ত্বের গোঁড়া সমর্থক ছিলেন। কিন্তু ক্যালভিন শর্তসাপেক্ষে অভিজাতগণ কর্তৃক প্রতিরোধ গড়ে তোলাকে স্বীকৃতি দেন।
প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনে জন নক্স-এর ভূমিকা
জন নক্স (John Knox, আনুমানিক ১৫১৪-১৫৭২ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন স্কটিশ মন্ত্রী, ধর্মতত্ত্ববিদ ও সংস্কারক। তিনি স্কটল্যান্ডে ক্যালভিনের চিন্তাকে কিছুটা ভিন্নরূপে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নির্বাসন ও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েও তিনি প্রোটেস্ট্যান্ট গোষ্ঠীর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। জন নক্স স্কটল্যান্ডে প্রেসবিটেরিয়ান চার্চ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
(1) মতাদর্শ
নক্স ছিলেন প্রকৃত অর্থে প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী। তিনি ক্যালভিনের নিষ্ক্রিয় আনুগত্যের (Passive Disobedience) তত্ত্ব নাকচ করে দেন। তাঁর চিন্তার অন্যতম দিক হল, ঈশ্বরের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য। তিনি বলেন, ঈশ্বরের মহিমা অগ্রাহ্য করলে রাজা বা প্রজা কেউই শাস্তির হাত থেকে রেহাই পাবে না। নক্সের মতে, রাজা যদি ঈশ্বরের আদেশ, সম্মান ও মহিমার প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখান, তবে তাঁকে সংশোধন ও প্রতিহত করা প্রকৃত বিশ্বাসীদের কর্তব্য।
(2) গ্রন্থ রচনা ও আন্দোলন
জন নক্সের The Appellation গ্রন্থে প্রতিবাদী ধর্মমতের বিস্তারিত ব্যাখ্যা লিখিত আছে। ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে জুইংলির উত্তরাধিকারী ও ধর্মতত্ত্ববিদ হেনরি বুলিনগার (Henry Bullinger)-কে তিনি প্রশ্ন করেন যে, ম্যাজিস্ট্রেটরা যদি প্রকৃত খ্রিস্ট ধর্মকে লঙ্ঘন করেন তাহলে প্রজারা সেই ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি আর কতটা আনুগত্য বজায় রাখবেন? নক্স ও তাঁর অনুগামীবৃন্দ ঘোষণা করেন যে, প্রতিরোধ তত্ত্ব হল পবিত্র ধর্মীয় কর্তব্য। কোনও খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ব্যক্তি যদি অত্যাচারী বিধর্মী শাসককে বাধা না দেন তাহলে তিনি ধর্মে পতিত হবেন। বিশিষ্ট রাষ্ট্রচিন্তাবিদ জর্জ হল্যান্ড স্যাবাইনের মতে, নক্সের চিন্তার রক্ষণশীল দিক হল, ঈশ্বরের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য। তিনি ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবেই প্রতিবাদী আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন, মানুষের অধিকারের দাবিতে নয়।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর