ইউরোপে সামরিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তির অগ্রগতিতে বারুদের ভূমিকা কী ছিল
অথবা, ইউরোপে সামরিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে বারুদের অবদান ও গুরত্ব লেখো

বারুদ (Gunpowder) হল মধ্যযুগের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, যা চিরাচরিত যুদ্ধবিদ্যার আমূল পরিবর্তন সংঘটিত করেছিল। বলা যেতে পারে, বারুদের আবিষ্কারই সর্বত্র সূচনা করেছিল নতুন এক রাজনৈতিক ও সামাজিক যুগের।
ইউরোপে সামরিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তির অগ্রগতিতে বাবুদের ভূমিকা
ইউরোপে সামরিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তির অগ্রগতিতে বা বলা ভালো সামরিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে বারুদের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বস্তুত বারুদের প্রযুক্তি ইউরোপে প্রবেশের পর থেকেই আগ্নেয়াস্ত্র নির্মিত হতে থাকে, শুরু হয় বিধ্বংসী কামানের বহুল ব্যবহার। যুদ্ধকৌশল, সামরিক সংগঠনের ধারণা যায় বদলে।
(1) বারুদের আবিষ্কার: পটাশিয়াম নাইট্রেট, গন্ধক এবং কাঠকয়লা মিশিয়ে বারুদ নির্মাণের পদ্ধতি প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল চিনদেশে। খ্রিস্টীয় একাদশ (মতান্তরে নবম শতক) শতকে এই বারুদ নির্মাণ প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটেছিল। অবশ্য চিনারা প্রথমদিকে বিনোদনের উদ্দেশ্যে বারুদের ব্যবহার করত। সেসময় তারা বারুদ দিয়ে তৈরি করত হাওয়াইবাজি। দ্বাদশ শতক নাগাদ সুঙ (Song) সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে থাকে ধাতু নির্মিত গোলা। চিনের একটি প্রাচীন মন্দিরে হাতে ধরা গোলাবর্ষণকারী কামান জাতীয় অস্ত্রের একটি ভাষ্কর্যকে বারুদ ব্যবহারের সর্বপ্রথম দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। পরবর্তীতে একটি চৈনিক লিপিতে ১৩৩২ খ্রিস্টাব্দে ৩০০টি কামানের সংখ্যা উল্লিখিত হয়েছে। অর্থাৎ, এর থেকে চিনে ব্যাপক হারে কামান নির্মাণের বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
(2) ইউরোপে বাবুদের ব্যবহার: ইউরোপে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যভাগে বারুদের প্রযুক্তি আরবদের হাত ধরে প্রবেশ করেছিল। বিজ্ঞানী রজার বেকন তাঁর লেখায় (১২১৪-১২৯২ খ্রিস্টাব্দ) Fire cracker বা আগ্নেয়াস্ত্রের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘পৃথিবীর নানান দেশে আগুন এবং তীব্র শব্দযুক্ত একটি শিশুদের খেলনা সদৃশ আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি হচ্ছে….।’ এরপর চতুর্দশ শতকের বিভিন্ন নথি থেকে ইউরোপে বন্দুক ও কামানের কথা জানা যায়। ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দের একটি ইউরোপীয় অলঙ্করণে উল্লেখ মেলে গোলা ছোঁড়ার যন্ত্রের। অনুমিত হয় প্রথম দিকে এই গোলা ছুঁড়ে দুর্গের কাঠের দরজা ভাঙা হত। পঞ্চদশ শতক থেকেই ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশেই কামানের ব্যবহার হতে থাকে। ক্রমে ধাতুবিদ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বারুদ তৈরির প্রযুক্তি আরও উন্নত রূপ ধারণ করে।
গুরুত্ব
- আগ্নেয়াস্ত্রের উদ্ভব: যুদ্ধক্ষেত্রে বারুদের ব্যবহার বন্দুক, কামান এবং অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রের প্রচলন করে। তলোয়ার, তিরধনুক ও বর্শার চেয়ে এই নতুন আগ্নেয়াস্ত্রগুলি ছিল অনেক বেশি কার্যকরী, যা যুদ্ধের কৌশল ও সজ্জায় পরিবর্তন আনে।
- কৌশলগত পরিবর্তন: বারুদভিত্তিক অস্ত্রের উন্নয়ন সামরিক বাহিনীতে নতুন কৌশলের প্রচলন করে। আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর জন্য স্থায়ী ও প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনী গঠনের প্রয়োজন হয়। গোলন্দাজ বাহিনী হয়ে ওঠে যুদ্ধের অপরিহার্য অঙ্গ।
- দুর্গ নির্মাণে নতুনত্ব: আগ্নেয়াস্ত্র ও কামানের শক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকলে পুরোনো ধাঁচের ইউরোপীয় দুর্গগুলি গুরুত্ব হারাতে থাকে। তার পরিবর্তে শুরু হয় নতুন ধরনের দুর্গ নির্মাণ। নবনির্মিত এই দুর্গগুলি একেবারে অভেদ্য না হলেও এগুলি জয় করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ছিল।
- অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব: বাবুদের ব্যবহার এবং আগ্নেয়াস্ত্র প্রস্তুতের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে এই অর্থের জোগান দেয়। এর ফলে রাজার হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হয় এবং ইউরোপে জাতীয় রাষ্ট্রের বিকাশ ঘটে। এইভাবে ইউরোপে সামরিক প্রযুক্তির অগ্রগতি ও বৃহত্তর সমাজের বিকাশে বারুদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা পরবর্তীতে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর