সামরিক ক্ষেত্রে ধাতুর ব্যবহারের সঙ্গে প্রযুক্তিগত উন্নতি কীভাবে সম্পর্কিত

সামরিক ক্ষেত্রে ধাতুর ব্যবহার ও প্রযুক্তিগত উন্নতির সম্পর্ক
সামরিক ক্ষেত্রে ধাতুর ব্যবহারের সঙ্গে প্রযুক্তিগত উন্নতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, যা সামরিক বিপ্লবের সময় ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দৃঢ় ভিত্তি প্রদান করেছিল। সমরক্ষেত্রে ধাতুর ব্যবহারের সূত্রে যেসব অস্ত্র তৈরি হয়েছিল, তা প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে আরও কার্যকরী হয়ে ওঠে।
(1) ইউরোপে খনিজ পদার্থের উৎপাদন বৃদ্ধি: পঞ্চদশ শতক থেকে ইউরোপে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছিল। পাশাপাশি বৃদ্ধি পেয়েছিল খনিজ পদার্থের উৎপাদনও। কামান, বন্দুক ইত্যাদি তৈরির জন্য দরকার ছিল লোহা, ব্রোঞ্জ প্রভৃতি ধাতুর উৎপাদন। আর কেবলমাত্র এই সকল অস্ত্রই নয়, উন্নত তরবারি, ছোরা, তির, যুদ্ধ হাতুড়ি (War Hammer), হেলমেট, বর্শা-এসব তৈরির জন্যও ধাতুর প্রয়োজন ছিল। এই পর্ব থেকে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ফলে খনিজ উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়তে থাকে।
ব্লাস্ট ফার্নেস, খনি থেকে জল বার করার উন্নত পদ্ধতি ও যন্ত্র ছিল এগুলির মধ্যে অন্যতম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৪৬০-১৫৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইউরোপের খনিগুলিতে লোহার উৎপাদন প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। আবার খনিজ তামা থেকে রুপো নিষ্কাশনের পদ্ধতি আবিষ্কৃত হওয়ায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছিল তামার উৎপাদনও। বস্তুত তামাই ছিল ষোড়শ শতকে লোহার কামান নির্মাণের পূর্ব পর্যন্ত কামানের অন্যতম উপাদান।
(2) উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র: সামরিক বিপ্লবের কালে ধাতুবিদ্যার উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রেরও মান উন্নত হয়ে ওঠে। আর্কেবুস নামক হাতবন্দুকের নল বানানো হত লোহা দিয়ে। অন্যদিকে মাস্কেট বন্দুকের বুলেট নির্মাণে ব্যবহৃত হত সিসা। এ ছাড়া আগেকার কামানের পাথরের গোলার তুলনায় এযুগে তৈরি লোহা বা সিসার গোলা ছিল অনেক বিধ্বংসী।
(3) পুরু পাতের বৃহদাকার কামান: ধাতুবিদ্যার উন্নতির ফলে পাথরের পরিবর্তে লোহা বা সিসার তৈরি গোলা ছোঁড়ার কাজ শুরু হয়। এর জন্য উন্নত ও পুরু পাতের বৃহদাকার কামান তৈরি শুরু হয়ে যায়। এই কামান থেকে প্রায় ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ১৫০ পাউন্ড ওজনের ধাতব গোলা নিক্ষেপ করা সম্ভব হয়। বিপুল ভারী এই সকল কামান অবরোধ ভাঙার কাজে ব্যবহার করা হত। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে এই ভারী কামান স্থানান্তর করা সম্ভব হত না। পরে কামানের তলায় চাকা লাগিয়ে কামান স্থানান্তর করার ব্যবস্থা করা হয়।
(4) কামানে নল ও গোলার অনুপাত: প্রথমদিকে কামানের গোলার পাল্লা খুব বেশি ছিল না। অর্থাৎ, তা বেশি দূরে ছোঁড়া যেত না। ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ নল এবং গোলার অনুপাত ১.৫: ১ থেকে করা হয় ৩: ১-এ। পাশাপাশি নজর দেওয়া হয় গতি এবং লক্ষ্য স্থির করার প্রযুক্তির দিকেও। ফলে কামানগুলি অনেক দূরে সঠিকভাবে নিশানা লাগাতে কার্যকরী হয়ে ওঠে।
(5) ধাতুর ব্যবহারে উন্নত দুর্গ নির্মাণ: এই সময় দুর্গ নির্মাণের ক্ষেত্রেও ধাতুর প্রয়োগের দরুন অনেক পরিবর্তন সাধন হয়েছিল। দুর্গের প্রাকার তৈরি, ধাতব গেট এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থার ব্যবহার এক্ষেত্রে লক্ষণীয়। এমনকি দুর্গের প্রাকারের মধ্যে থেকেও আগ্নেয়াস্ত্র ও কামান ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
(6) নৌযান এবং জাহাজ নির্মাণ: ইউরোপীয় নৌবাহিনীতে ধাতুর ব্যবহার নৌযান ও যুদ্ধজাহাজ নির্মাণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইস্পাত ও লোহার ব্যবহারের ফলে যুদ্ধজাহাজের কাঠামো যেমন মজবুত হয়, তেমনি এর কার্যকারিতাও বৃদ্ধি পায়। সুতরাং, ইউরোপের সামরিক বিপ্লবের পটভূমিতে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে ধাতুর উৎপাদন ও ব্যবহার নতুন নতুন আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাণ এবং উন্নত রণকৌশলের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। ক্রমে যুদ্ধ হয়ে ওঠে পূর্বাপেক্ষা ভয়ংকর ও ধ্বংসাত্মক।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর