অটোমান সাম্রাজ্য ও বলকান জাতীয়তাবাদ

অটোমান সাম্রাজ্য ও বলকান জাতীয়তাবাদ
অটোমান সাম্রাজ্য ও বলকান জাতীয়তাবাদ

তুরস্ক সাম্রাজ্যের দুর্বলতা

পঞ্চদশ, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এশিয়া, আফ্রিকা ও ছিল। অষ্টাদশ শতক থেকে নানা কারণে তুর্কি মধ্যযুগীয় মোল্লাতন্ত্র শাসিত তুরস্ক সামাজিক, ইউরোপের বিস্তীর্ণ অংশে অটোমান তুরস্ক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। যুগোপযোগী সংস্কারের অভাবে অর্থনৈতিক, সামরিক ও প্রশাসনিক- সব দিক থেকেই ইউরোপের অন্যান্য দেশ অপেক্ষা পিছিয়ে পড়ে। তুর্কি শাসকরা ছিলেন স্বেচ্ছাচারী, দুর্বল, অকর্মণ্য, ব্যাভিচারী ও সংস্কারবিমুখ। প্রজাবর্গের মঙ্গলসাধন বা তুরস্কে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রবর্তনের কোনো আগ্রহ তাঁদের ছিল না। আধুনিক সংস্কারের দ্বারা সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করে তোলার দিকেও তাঁরা কোনো নজর দেননি। এমতাবস্থায়, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইউরোপীয় প্রতিবেশীদের পাশে তুরস্ক দুর্বল ও নিষ্প্রভরূপে প্রতিভাত হয়। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন বা বহিঃশত্রুর আক্রমণ রোধের কোনো ক্ষমতাই তুরস্কের ছিল না। এজন্য তুরস্ককে ব্যঙ্গ করে বলা হত ‘ইউরোপের রুগ্‌ণ মানুষ’। ইউরোপের আগ্রাসী বৃহৎ শক্তি রাশিয়া, ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া তুরস্কের অর্থনৈতিক দুর্বলতা আরো প্রকট করে দিয়েছিল।

বলকান জাতীয়তাবাদ

তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বলকান অঞ্চলে গ্রিক, মিশরীয়, সার্ব, বুলগেরিয়, বুমানীয়, আলবেনীয় প্রভৃতি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করত। ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি কোনো দিক থেকেই তাদের মধ্যে মিল ছিল না। তারা ইউরোপীয় ও খ্রিস্টান এবং শ্বেতকায় হলেও তাদের মধ্যে নানা দ্বন্দু ছিল। অপরপক্ষে, শাসক তুর্কিরা ছিল এশিয়াবাসী, ইসলাম ধর্মাবলম্বী। শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক ছিল তিক্ত। তুর্কি সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে এই অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী তুরস্কের অধীনতাপাশ ছিন্ন করে নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। ফরাসি বিপ্লবের জাতীয়তাবাদী ভাবধারা তাদের প্রভাবিত করে। ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসকারী স্ব স্ব জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে গ্রিস এবং ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে মিশর স্বাধীনতা ঘোষণা করে। বুমানিয়া, ক্লিট, বুলগেরিয়া, বসনিয়া, মন্টেনিগ্রো, সেরোজেভো- সমগ্র বলকান অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী বিক্ষোভের সঞ্চার হয়।

গ্রিক জাতীয়তাবাদ ও ‘হেটাইরিয়া ফিলিকে’

গ্রিস ছিল ইউরোপীয় সভ্যতার জন্মভূমি। কালক্রমে খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতকের প্রথমভাগে গ্রিস তুরস্কের পদানত হয়। দীর্ঘদিনের জড়ত্বের পর উনিশ শতকের প্রথমভাগে তাদের মধ্যে স্বাধীনতা-স্পৃহা জেগে ওঠে এবং তারা পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে অগ্রসর হয়। গ্রিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষে গ্রিক পন্ডিত অ্যাডাম্যানটিওস কোরেস এবং কবি রিগাস-এর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পেশায় চিকিৎসক কোরেস-এর উদ্যোগে গ্রিক ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয়। এইভাবে গ্রিসে জাতীয় জাগরণের সূচনা হয়। কবি রিগাস-এর কবিতা ও গান দেশবাসীর মনে নতুন চেতনা ও গৌরববোধের সঞ্চার করে। সেখানে একাধিক গুপ্ত সমিতির উদ্ভব হয়। এই সব সমিতিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল। হেটাইরিয়া ফিলিকে।

১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে স্কুপাস নামে জনৈক গ্রিক ব্যবসায়ী গ্রিসের কৃষ্ণসাগর উপকূলে ওডেসা বন্দরে ‘হেটাইরিয়া ফিলিকে’বা ‘বান্ধব সভা ‘নামে এই গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল গ্রিসের স্বাধীনতা অর্জন করা। এই সমিতির গঠন ও কার্যপদ্ধতির সঙ্গে ইতালির ‘কার্বোনারি’-র প্রচুর সাদৃশ্য ছিল। গ্রিসের বিভিন্ন অঞ্চলে এই সমিতির শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সমগ্র গ্রিসে মুক্তি আন্দোলনের ভাবধারা ছড়িয়ে পড়ে। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এর সদস্য সংখ্যা প্রায় দুই লক্ষে পৌঁছায়। ১৮২১-এর মার্চ মাসে এই সমিতির নেতৃত্বে মোলডাভিয়া ও ওয়ালেশিয়াতে তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৮৩০-এ গ্রিস স্বাধীনতা লাভ করে। .

Leave a Comment