অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত পররাষ্ট্রনীতি, এর প্রকারভেদ এবং কূটনীতি প্রয়োগের বিভিন্ন অস্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করো
প্রাচীন ভারতে পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য ও রূপায়ণ সম্পর্কে আলোচনা প্রথম পাওয়া যায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে। প্রাচীন কালে রাজাদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ ছিল খুব নিয়মিত ঘটনা। এই কারণে বিজয়ী হওয়ার দৃঢ় মানসিকতাসম্পন্ন রাজার (বিজিগীষু) পররাষ্ট্রনীতি রূপায়ণের সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে কৌটিল্য নানা পরামর্শ দিয়েছেন।
পররাষ্ট্রনীতি বা বিদেশনীতি
প্রাচীন ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এক বাস্তবিক, সুষ্ঠু ও সুসংহত আলোচনা মেলে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে। কৌটিল্য – বর্ণিত পররাষ্ট্রনীতির একটি দৃষ্টান্ত হল- রাজমণ্ডল তত্ত্ব। রাজমণ্ডল হল মূলত ১২ জন রাজার চক্রাকারে অবস্থান। বিজিগীষু রাজা, তাঁর সম্মুখভাগে ৫ জন রাজা এবং পশ্চাদ্ভাগে ৪ জন রাজা, মধ্যম ও উদাসীন-সহ ১২ জন রাজাকে দ্বাদশ রাজমণ্ডল বা রাজপ্রকৃতি রূপে অভিহিত করা হয়।
রাজমণ্ডল তত্ত্বে শত্রুরাজ্যে অভিযানকারী রাজার সামনের দিকের ৫ জন রাজা হলেন- অরি, মিত্র, অরিমিত্র, মিত্রমিত্র, অরিমিত্র মিত্র। আবার অর্থশাস্ত্রে বিজিগীষু রাজার পশ্চাদ্ভাগে যে ৪ জন রাজার কথা বলা হয়েছে, তাঁরা হলেন- পার্টিগ্রাহ, আক্রন্দ, পার্রিগ্রাহাসার, আক্রন্দাসার। এ ছাড়াও মধ্যম ও উদাসীন রাজাদের অবস্থান বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
পররাষ্ট্রনীতির প্রকারভেদ
অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য পররাষ্ট্রনীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে ৬টি পদ্ধতির উল্লেখ করেছেন। এই মতবাদ ষাড়গুণ্য নীতি নামে পরিচিত। এই ৬টি নীতি হল- সন্ধি, বিগ্রহ, যান, আসন, দ্বৈধীভাব এবং সংশ্রয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কৌটিল্য দ্বাদশ রাজমণ্ডল সূত্রেই ষাড়গুণ্য নীতি বা মতবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এর মাধ্যমেই মন্ডলতত্ত্বের অন্তর্গত রাজাদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিন্যাসগত প্রকারভেদ কীরূপ ছিল, সে সম্পর্কে জানতে পারা যায়।
(i) সন্ধি
সন্ধি হল দুজন রাজার মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে যুদ্ধ না করার বা পারস্পরিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত। কৌটিল্যের অভিমত অনুযায়ী, যখন কোনও রাজা নিজেকে অপরপক্ষের তুলনায় কম শক্তিশালী বলে মনে করবেন, তখন তিনি সন্ধি সম্পাদনে উদ্যোগী হবেন।* কৌটিল্য আরও উল্লেখ করেছেন যে, যুদ্ধ ও সবি-এই দুই উপায়ে যদি রাজ্যের স্থায়িত্ব তথা সমৃদ্ধি সম্ভব বলে মনে করা হয়, তবে রাজা সন্ধি সম্পাদন করতে পারেন। তাছাড়া অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য বিজিগীষু রাজার কখন সন্ধি করা উচিত, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
(ii) বিগ্রহ
বিগ্রহ বলতে বোঝায় শত্রু রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সাধারণভাবে কৌটিল্য যুদ্ধনীতি বর্জনের পরামর্শ প্রদান করেছেন। তবে প্রতিবেশী কোনও রাজ্য বিজিগীষু রাজ্যের ক্ষতি করতে চাইলে, সেই রাজ্যের বিরুদ্ধে তিনি বিজিগীষু রাজ্যকে পূর্বপ্রস্তুতি-সহ যুদ্ধযাত্রার পরামর্শ দিয়েছেন। যুদ্ধ শুরুর পূর্বে কৌটিল্য আক্রমণকারী রাজাকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ প্রদান করেছেন। তাঁর মতে, শত্রুপক্ষ যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত কিংবা বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অশান্তিতে জর্জরিত থাকবে তখনই হবে আক্রমণের উপযুক্ত সময়। কৌটিল্য ধর্মযুদ্ধ, কূটযুদ্ধ, প্রকাশ যুদ্ধ, স্থলযুদ্ধ, আকাশ যুদ্ধ প্রভৃতির কথা তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
(iii) যান
শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতিকে বলা হয় যান। কৌটিল্য শান্তিকালীন অবস্থার আড়ালে যুদ্ধের প্রস্তুতি চালানোর কথা বলেছেন। তিনি সন্ধায়যান, বিগ্রহযান ও সম্ভূয়যান- এই তিনপ্রকার যানের উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয়, কখন বিজিগীষু রাজা যুদ্ধের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি নেবেন সে সম্পর্কেও কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বিশেষভাবে আলোকপাত করেছেন বলে জানা যায়।
(iv) আসন
রাজা যদি মনে করেন কোনও শত্রু তাঁকে আঘাত করতে পারবেন না বা তিনি শত্রুকে ধ্বংস করতে পারবেন না, সেক্ষেত্রে তিনি নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করবেন। একে বলা হয় আসন। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, কৌটিল্য ‘আসন’ অর্থে মূলত ‘উপেক্ষা’ শব্দটির ব্যবহার করেছেন। সন্ধি আসন এবং বিগ্রহ আসন- এই দুইয়ের উল্লেখ মেলে কৌটিল্যের বক্তব্যে।
(v) দ্বৈধীভাব
দ্বৈধীভাব বা দ্বৈতনীতি হল এক বিশেষ ধরনের কূটনীতি। এই নীতি অনুসারে বলা হয়, বিজিগীষু রাজা এক শত্রুর সঙ্গে সন্ধি করবেন এবং অন্য শত্রুকে আক্রমণ করার প্রস্তুতি চালাবেন। এইভাবে ভারসাম্য রক্ষার পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবেন বিজিগীযু রাজা।
(vi) সংশয়
সংশ্রয়-এর অর্থ হল, আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয়। এই নীতি অনুসারে, দুর্বল রাজা শক্তিশালী রাজার আশ্রয় গ্রহণ করবেন অথবা রাজা তৃতীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে জোট গড়ে তুলবেন।
কূটনীতি প্রয়োগের বিভিন্ন অস্ত্র
কূটনীতি হল বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সুসম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে সমঝোতাপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ। কৌটিল্য কূটনীতি অর্থে ‘নয়’ শব্দটির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এই কূটনীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ৪টি কৌশলের কথা বলেছেন, এগুলি হল-
(i) সাম
সাম বলতে সন্তুষ্টির কথা বলা হয়েছে। এই কূটনীতির মাধ্যমে রাজা প্রতিবেশী রাজার মন থেকে অবিশ্বাস ও সন্দেহ দূর করবেন। তিনি রাজশক্তির বিরুদ্ধাচরণকারীদের সঙ্গে সমঝোতা করবেন।
(ii) দান
দান বলতে বস্তু বা অর্থের বিনিময় হতে পারে। আবার শক্তিশালী রাজা কর্তৃক দুর্বল রাজাকে অভয়দানের মাধ্যমেও হতে পারে। কূটনীতির এই পদ্ধতি অবলম্বন করে শক্তিশালী রাজা দুর্বল রাজাকে নিজের বশে রাখতে পারেন।
(iii) দণ্ড
দণ্ড কথাটির অর্থ হল বলপ্রয়োগ করা। রাজা শত্রু রাষ্ট্রকে সরাসরি আক্রমণ করে বশে আনতে পারেন বলে উল্লেখ করা হয়। দণ্ড প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য উভয় প্রকারেরই হতে পারে।
(iv) ভেদ
ভেদ বলতে বোঝায় বিভেদনীতি। মূলত রাষ্ট্রে ভাঙন সৃষ্টি করার জন্য এই কূটনীতি প্রয়োগ করা হয়। শত্রু রাজার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দেওয়ার কথা এতে বলা হয়েছে।
উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে একথা বলা যায় যে, রাজমণ্ডল তত্ত্বের মাধ্যমে আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক নির্ণয়ের পাশাপাশি কূটনীতি বিষয়েও কৌটিল্য যে সুচিন্তিত মতামত পোষণ করেছেন, তা নিঃসন্দেহে আধুনিক কালেও সর্বজনস্বীকৃত।